এরদোয়ান জিতলেন, কিন্তু তুরস্ক কি জিতল

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিলিচদারওলুকে দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে হারিয়ে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আরও পাঁচ বছরের জন্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হিসেবে থেকে গেলেন।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তুরস্কের অর্থনীতি যখন খারাপের দিকে, মূল্যস্ফীতি যখন বেড়েই চলেছে এবং অর্থনীতি শিগগিরই ভালো হবে বলে মনেও হচ্ছে না, সেই মুহূর্তে বেশির ভাগ তুর্কি নাগরিক এরদোয়ানকে ভোট দিলেন। সে কারণে সবার মনে প্রশ্ন ঘুরছে, এরদোয়ান এই নির্বাচনে জিতলেন কীভাবে এবং ‘দৃশ্যমান ভবিষ্যতে’ দেশটির কপালে কী ঘটতে যাচ্ছে। আসলে নির্বাচন অবাধ হলেও স্বচ্ছতা অধরাই ছিল।

নির্বাচনে স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী দিতে পেরেছে; সভা–সমাবেশও অবাধে করতে পেরেছে। ভোট যাতে ঠিকমতো গণনা করা সম্ভব হয়, তার জন্য প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সব দলেরই নিজস্ব প্রতিনিধি থাকতে পেরেছেন।

আরও পড়ুন

সবচেয়ে বড় কথা ভোটাররা তাঁদের ভোটদানে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছেন। তারপরও এই নির্বাচনে স্বচ্ছতার অভাব ছিল। কারণ, এই নির্বাচনে প্রথম সারির প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজন একরেম ইমামোলুকে ‘সরকারি লোকদের অপমান করার’ অপরাধে গত ডিসেম্বরে দুই বছরের কারাদণ্ড সাজা দেওয়া হয়।

ইমামোলু ২০১৯ সালে এরদোয়ানের সমর্থিত প্রার্থীকে হারিয়ে ইস্তাম্বুলের মেয়র হয়েছিলেন। জরিপে দেখা গেছে, তিনি আইনি ঝামেলামুক্ত থাকলে ভালোভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানকে হারাতে পারতেন। অনেকে বলছেন, ইমামোলুকে দৃশ্যপট থেকে দূরে রাখতেই আদালত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে এ কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছে।

তুর্কি গণমাধ্যম এরদোয়ানের মুঠোর মধ্যে থাকায় তিনি নির্বাচনী প্রচারে সর্বোচ্চ সুযোগ পেয়েছেন। সর্বোপরি, যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের ফল ঘোষণা হয়েছে, তাতে যথেষ্ট অস্বচ্ছতা ছিল। ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর ব্যালট ও রেজাল্ট শিট পুলিশ অথবা সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠিয়েছে। এখানেই মূল সন্দেহের বিষয়; কারণ পুলিশ এবং সেনাবাহিনী দুটোই এরদোয়ানের নিয়ন্ত্রণে আছে। এরপর নির্বাচন কমিশন শুধু রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সির মাধ্যমে সেই ফল ঘোষণা করেছে; অথচ ইতিপূর্বে স্বতন্ত্র সংবাদমাধ্যমগুলো ফল ঘোষণা করতে পারত।

আরও পড়ুন

নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো জালিয়াতি হওয়ার প্রমাণ এখনো না পাওয়া গেলেও গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সমন্বিত রূপ দেওয়াকে সন্দেহের চোখে দেখার যথেষ্ট অবকাশ আছে। এরদোয়ানের জেতার পেছনে ধর্মীয় অনুভূতি–সংশ্লিষ্ট দুটো বড় কারণ আছে। প্রথমটি হলো প্রথম রাউন্ডের নির্বাচনে ৫.২ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে থাকা সিনান ওগানের সমর্থন পেয়েছেন এরদোয়ান। ওগানকে সমর্থন দিতে এরদোয়ান প্রথম থেকেই অনুরোধ করে আসছিলেন।

এরদোয়ানের জেতার পেছনে জোরালো কারণ হিসেবে যা কাজ করেছে, তা হলো ধর্মপরায়ণ ভোটারদের অকুণ্ঠ সমর্থন। কট্টর ইসলামপন্থী ভোটারদের কাছে এরদোয়ান একজন ত্রাতা ও ধর্মীয় নায়ক হিসেবে বিবেচিত হন। এই ধর্মপরায়ণ ও ইসলামি অনুশাসন চর্চাকারী জনগোষ্ঠী ইতিপূর্বে সেক্যুলারিজমের নামে চালানো শাসনব্যবস্থায় অত্যাচার–নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের কাছে কিলিচদারওলু ও রিপাবলিকান পিপলস পার্টি হলো মুসলিম উৎপীড়নের প্রতীক। যদিও কিলিচদারওলু তাঁর দলের সাবেক অনেক সেক্যুলার নীতি বিসর্জন দিয়েছেন, কিন্তু ভোটাররা মুসলমান নারীদের মাথায় স্কার্ফ পরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া এবং কয়েক দশক ধরে রাজনীতি থেকে ইসলামকে দূরে সরিয়ে রাখার কথা ভুলতে পারেনি।

রক্ষণশীল ও ধর্মভিত্তিক দক্ষিণপন্থীরা এরদোয়ানকে ইসলাম ও তুর্কি জাতির বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে বসে চক্রান্ত করা লোকদের মোকাবিলা করতে সক্ষম একজন বিশ্বনেতা মনে করেন। এই ভোটাররা ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করে এরদোয়ানকে ভোট দিয়েছেন।

৬৯ বয়সী এরদোয়ান নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না, কণ্ঠও ক্ষীণ হয়ে আসছে। হয়তো মেয়াদ শেষের আগেই তাঁকে তাঁর ডেপুটির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ফলে তুরস্কের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে।

 এখন প্রশ্ন হচ্ছে সামনের দিনগুলো কেমন যাবে? তুরস্কবাসীকে মুক্ত নিশ্বাস নেওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন দরকার, কেননা তুর্কি সমাজে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বদ্ধাবস্থায় পড়ে ধুঁকছে।

এরদোয়ান অঙ্গীকার করেছিলেন, নতুন তুরস্ক প্রতিষ্ঠার শততম বর্ষে, অর্থাৎ ২০২৩ সালের মধ্যে তিনি তুরস্ককে পাল্টে দেবেন। সবার আশা ছিল, তুরস্ক ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর ১০টির মধ্যে একটি থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশটি এখন সবচেয়ে ধনী দেশের ২০টির মধ্যে ১৯ নম্বরে রয়েছে। গত তিন বছরে তুরস্কের অর্থনীতি ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে। লিরা ডলারের বিপরীতে মূল্য হারাচ্ছে।

এ অবস্থায় এরদোয়ান অর্থনীতির গতি ফেরাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। এটিই এরদোয়ানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শেষ কার্যকাল। ৬৯ বয়সী এরদোয়ান নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না, কণ্ঠও ক্ষীণ হয়ে আসছে। হয়তো মেয়াদ শেষের আগেই তাঁকে তাঁর ডেপুটির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ফলে তুরস্কের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনূদিত

  • মেহমেত ওজাল্প অস্ট্রেলিয়ার চার্লস স্টার্ট ইউনিভার্সিটির পাবলিক অ্যান্ড কনটেক্সচুয়াল থিওলজির নির্বাহী সদস্য