পাহাড়ি নারীর শিকল ভাঙার গল্প

পুরুষতান্ত্রিকতার আধিপত্য কেবল পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বা রাজনীতিতে নয়—এই আধিপত্য ধর্মীয় ক্ষেত্রেও প্রবলভাবে বিদ্যমান।ফাইল ছবি

ফাগুনের এক পড়ন্ত বিকেলে খাগড়াছড়ি শহর পেছনে রেখে আমাদের সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি যখন ছোট ছোট টিলার ওপর দিয়ে ইট বিছানো রাস্তা ধরে পেরাছড়ার নীলকান্ত পাড়ার দিকে ছুটছিল, তখন রাস্তার ওপর পড়ে থাকা শুকনো ঝরাপাতার মচমচ শব্দ প্রকৃতির নিঃশব্দতাকে ভেঙে খানখান করে দিচ্ছিল।

আমাদের গন্তব্য পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র নারী ভিক্ষু দ্বারা পরিচালিত বিহার ‘সঞ্জীবনা ভাবনা কুঠির’। এ ভাবনা কুঠিরের পরিচালনা কমিটির সদস্য পরিচিতা খীসাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম আমার সেখানে যাওয়া। অন্য রকম আনন্দ আর আগ্রহ নিয়ে সেদিন আমি যেন এক অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছি! 

২০১৫ সালে এ ভাবনা কুঠিরটি স্থাপিত হয়েছে। বৌদ্ধ নারীদের এ প্রবজ্যা গ্রহণকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাই শুরুতেই তাদের বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। সে সময় তাঁদের নিরাপত্তাও হুমকির মধ্যে পড়েছিল। কিন্তু এত সব প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা দমে যাননি, নিজেদের লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল।

ত্যাগের ব্রতকেই তাঁরা সব ধরনের অনিত্য থেকে মুক্তির সিঁড়ি হিসেবে বেছে নিয়েছেন। দীর্ঘ কয়েক বছরে বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়ে এসে তাঁরা এটা প্রমাণ করতে পেরেছেন যে সংসার, পরিবার-পরিজন, সমাজ, রাজনীতির বাইরে ধর্মপ্রচারেও নারীরা নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। 

আমাদের সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে নারীর সম–অধিকারকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না বলেই ধর্মীয় ক্ষেত্রেও নারীরা বারবার বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন

সঞ্জীবনী ভাবনা কুঠিরটি খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কুঠিরের চারপাশে সবুজ গাছগাছালি আর উত্তর দিকে রয়েছে আদিগন্ত ধানখেত ও সবুজের সারি। ছোট্ট একটা সেমি পাকা ঘরে পাঁচজন ভিক্ষুণী ও শ্রমণীরা বাস করেন। ভেতরে বসার পরিসরটিও খুবই ছোট। তাই ভিক্ষুণীদের আসন গ্রহণের পরে সাকল্যে হয়তো চার থেকে পাঁচজন অতিরিক্ত মানুষ বসতে পারবেন। জায়গার অভাবে বিহারের একমাত্র বুদ্ধমূর্তিটিও মূল ভবনের বাইরে রাখা হয়েছে। 

সূর্যি নন্দা ভিক্ষুণী এই ভাবনা কুঠিরের অধ্যক্ষ। তাঁর তত্ত্বাবধানে কুঠিরটি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। সূর্যি নন্দার গৃহী নাম ছিল রজনী সুপ্তা চাকমা। তিনি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই ২০০৪ সাল থেকে বৌদ্ধধর্মের প্রতি পুরোপুরি আকৃষ্ট হন। শৈশব থেকেই ধর্মের প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল। ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়াকালে তিনি বয়স্ক নারীদের সঙ্গে বিহারে গিয়ে অষ্টশীল গ্রহণ করতেন।

এভাবে বিহারে আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে পঞ্চশীল, অষ্টশীল, দশশীল সম্পর্কে ধারণা লাভ করার পরে ধর্মের প্রতি আরও গভীর টান অনুভব করেন। অবশেষে ২০১৪ সালে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামীতে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রবজ্যাধারী গৌতমীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। সে সময় সূর্যি নন্দার সঙ্গে আরও চারজন নারী প্রবজ্যা গ্রহণ করেছিলেন। প্রবজ্যা গ্রহণের পরেই তাঁরা দীঘিনালার সাধনা টিলা বনবিহারে চলে যান, যেখানে সূর্যি নন্দা প্রবজ্যা গ্রহণের আগে ‘সাধু’–মা হিসেবে ৯ বছর অবস্থান করেছিলেন। 

কিন্তু প্রবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাঁদের এ প্রবজ্যা জীবনকে সহজভাবে মেনে নেয়নি। তাই শ্রমণীরা যখন সাধনা টিলা বনবিহারে অবস্থান করছিলেন, তখন অন্য বিহারের কিছু ভিক্ষুর (পুরুষ) প্ররোচনায় বিভিন্নভাবে তাঁরা হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন। এমনকি তাঁদের ঘরে তালা দিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। শ্রমণীদের ‘সিয়ং’ (খাবার) দাতাদেরও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে তাঁরা সেখান থেকে প্রথমে খাগড়াছড়ি ও পরে আবার চট্টগ্রামে ফিরে যান। উল্লেখ্য, তাঁদের এ প্রবজ্যা গ্রহণকে অনেকে মানতে না পারলেও সাধনা টিলা বনবিহারের ভিক্ষু সংঘসহ আরও কিছু ভিক্ষু ও খাগড়াছড়ির নেতৃস্থানীয় কিছু ব্যক্তি এঁদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন।

খাগড়াছড়ির সমাজকর্মী প্রিয় কুমার চাকমা স্বেচ্ছায় ভিক্ষুণীদের জন্য ২০ শতক জমি দান করেন, যেখানে বর্তমান কুঠিরটি করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে কয়েকজন ভিক্ষুর তত্ত্বাবধানে পাঁচ শতাধিক লোক স্বেচ্ছাশ্রমে এক দিনেই ভিক্ষুণীদের জন্য বর্তমান কুঠিরটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি গৌতমী শ্রমণীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ শ্রমণী শ্রীলঙ্কায় গিয়ে থাইল্যান্ডের বর্তমান প্রধান ভিক্ষুণী ধম্মানন্দার কাছে ভিক্ষু হিসেবে প্রবজ্যা গ্রহণ করেন। 

২. 

আজ থেকে সাড়ে তিন দশক আগে আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীদের ওপর নিপীড়ন–নির্যাতনের প্রতিবাদে ‘হিল উইমেন্স ফেডারেশন’ গঠিত হয়েছিল। এরও আগে ১৯৭৫ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’ নামে নারীদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছিল। পাহাড়ি নারীদের জন্য সেই পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। তাঁদের অধিকার আদায়ের এ লড়াইয়ে রাষ্ট্রের বাধা তো ছিলই, সেই সঙ্গে পারিবারিক, সামাজিক বাধাকেও পেরিয়ে আসতে হয়েছে। 

এ বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্যে নারীর সম–অধিকার, নারীর সমসুযোগের কথা বলা হয়েছে। একটা বিষয় আমাদের সব সময় মনে রাখা দরকার, নারী অধিকারের অর্থ এই নয় যে পুরুষের অধিকার খর্ব করে নারীর জন্য অধিকার অর্জন বা পুরুষের বিরুদ্ধে লড়াই। নারী অধিকারের লড়াইটা হলো পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। পুরুষতান্ত্রিকতার আধিপত্য কেবল পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বা রাজনীতিতে নয়—এই আধিপত্য ধর্মীয় ক্ষেত্রেও প্রবলভাবে বিদ্যমান। 

মোদ্দাকথা হলো আমাদের সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে নারীর সম–অধিকারকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না বলেই ধর্মীয় ক্ষেত্রেও নারীরা বারবার বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। 

সবশেষে আমাদের প্রত্যাশা—পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, ধর্মীয়—সব ক্ষেত্রেই নারীর সম–অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর সমসুযোগ তৈরি হলে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই নিজ যোগ্যতায় স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হতে পারবে। 

ইলিরা দেওয়ান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক

[email protected]