মৌনতা পরিশ্রমবিহীন ইবাদত

মৌনতা বা নীরবতা আল্লাহর মূল ভাষা। মৌনতা জ্ঞানীদের অলংকার। মৌনতা সাধারণের জন্য নিরাপত্তা। নীরবতা পরিশ্রমবিহীন ইবাদত। হজরত সোলায়মান (আ.) বলেছেন, ‘কথা বলাটা যদি রুপা সমতুল্য হয়, তবে চুপ থাকাটা সোনা সমতুল্য।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইসলামের বা মুসলমানের সৌন্দর্য হলো তার অনর্থক কথাবার্তা ও অপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম পরিহার করা।’ (তিরমিজি)

পরিবারে ও সমাজে অশান্তি–হানাহানি-মারামারি ও হিংসা-বিদ্বেষের কারণগুলোর অন্যতম হলো অনর্থক কথাবার্তা ও অপ্রয়োজনীয় কাজে জড়ানো।

অনিয়ন্ত্রিত ও লাগামহীন কথাবার্তা ঝগড়াঝাঁটির মূল কারণ। জীবনে যারা অনর্থক কথাবার্তা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে পেরেছে, তারা ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.), ইমাম দারেমি (রহ.) ও ইমাম বায়হাকি (রহ.) সূত্রে বর্ণিত আছে, হজরত রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘যে চুপ থাকে, সে নাজাত পায়।’ (তিরমিজি: ২৪৮৫)

হজরত উমর (রা.) বলেন, ‘চুপ থাকার কারণে আমি কখনো লজ্জায় পড়িনি। তবে কথা বলার কারণে আমি অনেকবার লজ্জিত হয়েছি।’

হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে নিরাপদ থাকতে চায়, তার চুপ থাকাটা আবশ্যক।’ (মুসনাদে আবি ইয়ালা)

যত প্রকার ইবাদত আছে, এর মধ্যে ‘চুপ থাকা’ একটি নফল ইবাদত। নফল ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। অহেতুক কথাবার্তা ও অনর্থক কাজের চেয়ে চুপ থাকাটা অধিক উত্তম ও উপকারী।

এ প্রসঙ্গে হজরত নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ও আখিরাতের ওপর ইমান আনে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ও আখিরাতের ওপর ইমান আনে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ও আখিরাতের ওপর ইমান আনে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা নীরবতা অবলম্বন করে।’ (বুখারি: ৬১২০)

একবার একজন সাহাবি হজরত নবীয়ে আকরাম (সা.)–কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমার ব্যাপারে যে বিষয়ে ক্ষতির আশঙ্কা করেন, এর মধ্যে বেশি ক্ষতির আশঙ্কা করেন কোন বিষয়ে?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জিব ধরে বললেন, জবানের হেফাজত করো (কারণ, এর দ্বারাই সবচেয়ে ক্ষতির বেশি আশঙ্কা বিদ্যমান)।’ (তিরমিজি)

দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ লাভের জন্য ইসলাম মানুষকে চুপ থাকায় উৎসাহিত করেছে। তা ছাড়া অহেতুক ও অনর্থক কথাবার্তার মধ্যে মিথ্যাচার, অমূলক সন্দেহ ও অযাচিত বিষয় এবং গিবত বা পরনিন্দা থাকে। এর সবই কবিরা গুনাহ। অহেতুক ও অনর্থক কথাবার্তার মাধ্যমে মানুষ শুধু নিজের ক্ষতিসাধনই করে না, বরং অন্যের ক্ষতিও করে, অন্যকেও কষ্ট দেয়। এ ব্যাপারে মুমিন-মুসলমানদের সচেতন থাকা জরুরি।

আল্লাহর হাবিব (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার জবান হেফাজত করবে এবং চরিত্র রক্ষা করবে; আমি তার জান্নাতের দায়িত্ব নেব।’ (সহিহ্ মুসলিম)

নীরবতা মহানবী (সা.)–এর বিশেষ গুণ। তিনি দীর্ঘক্ষণ নীরবতা অবলম্বন করতেন। প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলতেন না।

পবিত্র মহাগ্রন্থ কোরআন করিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রহমান (আল্লাহ)–এর প্রকৃত বান্দা তারা, যারা জমিনে নম্রভাবে বিচরণ করে এবং অজ্ঞ লোক যখন তাদের লক্ষ্য করে কটু কথা বলে, তখন তারা শান্তিপূর্ণভাবে কথা বলে (সালাম প্রদান করে)।’ (সুরা-২৫ ফুরকান, আয়াত: ৬৩)

জবানের অপব্যবহারের ফলে অনেক অপরাধ ও গুনাহর দ্বার খুলে যায়। গালমন্দ, গিবত, পরনিন্দা ও মিথ্যা বলা— সবই জবানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। হাদিসের ভাষ্যমতে, এই সবকিছু জাহান্নামের পথকে সুগম করে দেয়।

নীরবতা পরিশ্রমবিহীন ইবাদত। ইবাদত অনেক ধরনের রয়েছে—শারীরিক ইবাদত, আর্থিক ইবাদত এবং শারীরিক ও আর্থিক উভয়টির সম্মিলিত ইবাদত। কিন্তু নীরবতা এমন একটি ইবাদত, যাতে শারীরিক ও আর্থিক কোনো কিছুই প্রয়োজন হয় না।

হজরত উমর (রা.) বলেন, ‘চুপ থাকার কারণে আমি কখনো লজ্জায় পড়িনি। তবে কথা বলার কারণে আমি অনেকবার লজ্জিত হয়েছি।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

কুমারী মাতা হজরত মরিয়ম সিদ্দিকা (আ.) যখন নবজাতক শিশুপুত্র নবী হজরত ঈসা (আ.)–কে কোলে নিয়ে জনসমক্ষে এলেন, তখন প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় আমি রহমান আল্লাহর জন্য রোজা রেখেছি, আজ আমি কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলব না।’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত: ২৬)

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

  • যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

  • [email protected]