প্রথমবারের মতো কাবুল বিদেশি কোনো পরাশক্তির নয়, বরং তার প্রতিবেশী পাকিস্তানের বিমান হামলার শিকার হয়েছে। অক্টোবরের শুরুর দিকে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান আফগান ভূখণ্ডের কাবুল, কান্দাহার ও পাকতিকা এলাকায় হামলা চালায়।
পাকিস্তানের দাবি ছিল, তারা তেহরিক–ই–তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি জঙ্গিদের লক্ষ্যবস্তু করছে। বাস্তবে এই হামলায় সাধারণ মানুষ নিহত হয়, যাদের মধ্যে নারী, শিশু এবং তিনজন তরুণ ক্রিকেটারও ছিলেন। এই ঘটনার পর কাবুল সরকার তীব্র ভাষায় নিন্দা জানায় এবং পাল্টা আক্রমণে ৫৮ পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে।
এই পুরো ঘটনার মধ্যে একটি পরিহাস স্পষ্ট। যে দেশ একসময় বিদেশি আক্রমণ থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা আফগান শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরত, এখন তারাই আক্রমণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ইসলামাবাদের সামরিক নেতৃত্ব এসব হামলার মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শন করতে চাইলেও উল্টো তাদের দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। তারা এখন নিজেদের তৈরি কৌশলগত বিরোধের জালে আরও বেশি জড়িয়ে পড়ছে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আচরণ একটি পুরোনো প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি। দেশের ভেতরের অস্থিরতা আড়াল করতে তারা বাইরের দিকে আগ্রাসন দেখায়। কয়েক দশক ধরে রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলরা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতার দায় চাপিয়ে এসেছে কাবুল, দিল্লি কিংবা পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের ওপর।
কিন্তু প্রকৃত সত্য তাদের নিজেদের ভেতরেই লুকিয়ে আছে। যে টিটিপিকে এখন পাকিস্তান বিমান হামলা ও সীমান্ত পেরিয়ে অভিযান চালিয়ে নির্মূল করতে চাইছে, তা বাইরের কোনো শক্তির তৈরি নয়। এটি ইসলামাবাদের বহু বছরের নীতির ফল, যেখানে আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখতে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীকে লালনপালন করা হয়েছে।
যেসব গোষ্ঠীকে একসময় কৌশলগত সম্পদ বা ভালো তালেবান বলে অভিহিত করা হতো, তারা এখন ছড়িয়ে পড়ে এমন এক বিদ্রোহী শক্তিতে পরিণত হয়েছে, যা আজ পাকিস্তানের নিজের নাগরিকদেরই হুমকির মুখে ফেলছে। সামরিক বাহিনীর এই দ্বিমুখী নীতির ফল এখন তাদের নিজেদের দোরগোড়ায় ফিরে এসেছে। তারা আজ লড়ছে সেই শক্তির বিরুদ্ধেই, যাদের একসময় তারা নিজেরাই তৈরি ও শক্তিশালী করেছিল।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান হারানো থেকে শুরু করে আজকের খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানের বিদ্রোহ, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বারবার বলপ্রয়োগকে নিয়ন্ত্রণ মনে করে ভুল করেছে। দেশের বাইরে শক্তি প্রদর্শনের প্রতিটি চক্র দেশের ভেতরের বিভাজনকেই আরও গভীর করেছে।
সর্বশেষ বিমান হামলা তাই শক্তি প্রদর্শনের নয়, বরং একধরনের হতাশার প্রকাশ। ডুরান্ড লাইনের ওপারে সংঘাত ঠেলে দিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আশা করছে দেশের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে, অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে মানুষের দৃষ্টি সরাতে এবং বাড়তে থাকা ভিন্নমতের মাঝেও নিজেদের জন্য নতুন করে একটি উদ্দেশ্য তৈরি করতে। কৌশলটি পুরোনো, কিন্তু এর কার্যকারিতা দ্রুত কমে যাচ্ছে।
এই আক্রমণাত্মক আচরণের পেছনে রয়েছে আরও গভীর সংকট। পাকিস্তানের অর্থনীতি দেউলিয়া হওয়ার প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, মূল্যস্ফীতি মধ্যবিত্তকে নিঃশেষ করে দিয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ইতিহাসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। বেসামরিক কর্তৃত্ব কার্যত শূন্য হয়ে গেছে এবং সেই জায়গা দখল করেছে সেনাবাহিনী, যারা এখন দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের একমাত্র স্থপতি ও বিচারক। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি সংঘাত তৈরি করা একটি সুবিধাজনক উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাতে অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও জাতীয় ঐক্যের একটি ভান সৃষ্টি করা যায়।
কিন্তু এই সামরিক প্রবৃত্তি বারবার দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান হারানো থেকে শুরু করে আজকের খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানের বিদ্রোহ, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বারবার বলপ্রয়োগকে নিয়ন্ত্রণ মনে করে ভুল করেছে। দেশের বাইরে শক্তি প্রদর্শনের প্রতিটি চক্র দেশের ভেতরের বিভাজনকেই আরও গভীর করেছে।
ইসলামাবাদের বর্তমান হিসাব বলছে, তারা এখনো কাবুলকে অধীন একটি পক্ষ হিসেবে দেখে। মনে করে তাদের সরকারকে চাপ দিয়ে বা শর্ত আরোপ করে নিজের ইচ্ছামতো পরিচালনা করা যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু সেকেলে নয় বরং বিপজ্জনকভাবে আত্মঘাতী।
তালেবান সরকার তাদের আদর্শগত ত্রুটি সত্ত্বেও আফগান সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অত্যন্ত কঠোর। দোহায় আগের বৈঠকের পর তালেবান প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব ঘোষণা করেন যে আফগানিস্তান অন্য কারও হয়ে যুদ্ধে লড়বে না। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের সম্মান করি, কিন্তু কোনো দেশকে আমাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করতে দেব না।’
এমন অস্থির পটভূমিতে তুরস্ক ও কাতারের উদ্যোগে সাম্প্রতিক ইস্তাম্বুল শান্তি প্রচেষ্টা উত্তেজনা কমানোর একটি বিরল সুযোগ এনে দিয়েছিল। যৌথ বিবৃতিতে যুদ্ধবিরতি অব্যাহত রাখার প্রশংসা করা হয় এবং ডুরান্ড লাইনের পাশে নতুন করে সহিংসতা প্রতিরোধের অঙ্গীকার করা হয়।
কাগজে–কলমে এটি অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয়। বাস্তবে এটি এখনো অত্যন্ত অনিশ্চিত। আলোচনার আগে এবং পরে ইসলামাবাদের বক্তব্য ছিল সহযোগিতার চেয়ে বেশি হুমকিমূলক।
যখন পাকিস্তান বিমান হামলা চালায়, তখন এটি আফগানদের মধ্যে এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করে যে ইসলামাবাদ আলোচনার নয়, চাপ প্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছে। প্রতিটি হামলা কাবুলে জাতীয়তাবাদী আবেগকে উসকে দেয় এবং নিজ দেশে তালেবানের অবস্থানকে শক্তিশালী করে। কারণ, এতে তারা সার্বভৌমত্বের রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ পায়।
পরিহাসের বিষয় হলো, যে আন্দোলনকে একসময় পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে ধরা হতো, এখন সেই আন্দোলনই পাকিস্তানের ক্ষতির বিনিময়ে নৈতিক অবস্থানে লাভবান হচ্ছে।
এ ধরনের আচরণ ও ভাষা আলোচনাকে বাস্তব সমাধানের পথে নয়, বরং অভিনয়ে পরিণত করে। যখন কোনো পক্ষ আস্থার বদলে হুমকির ভাষায় কথা বলে, তখন কূটনীতি সত্যিকারের শান্তির প্রচেষ্টা হয়ে উঠতে পারে না।
আজিজ আমিন অক্সফোর্ড গ্লোবাল সোসাইটি থিঙ্কট্যাংক এবং ব্রেন্টহার্স্ট ফাউন্ডেশনের ফেলো
আতিফ মাশাল আফগান কূটনীতিক ও মহাপরিচালক, আফগানিস্তান ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড রিজওনাল স্টাডিজ
দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত