পশ্চিমবঙ্গে নতুন বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানে কার লাভ

পশ্চিমবঙ্গে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত বাতিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভছবি: বাংলা পক্ষের ফেসবুক থেকে

পশ্চিমবঙ্গে একটা আঞ্চলিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হচ্ছিল। কিন্তু ধীরে। হঠাৎই সেটা সুনামিতে পরিবর্তিত হলো গত কয়েক মাসে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অপেক্ষাকৃতভাবে খারাপ হওয়ার পর, ভারতে একটা প্রচার শুরু হলো যে বাংলাভাষী মানুষের অনেকেই আসলে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। এই প্রচারণার ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালিদের গ্রেপ্তার বা হেনস্তা করা হচ্ছে।

যাঁরা হেনস্তার শিকার হলেন, তাঁদের বড় অংশ বাঙালি মুসলমান। একটা অংশ হিন্দুও বটে। প্রধানত যাঁরা খেটে খান, ইংরেজিতে যাঁদের বলা হয় ‘ওয়ার্কিং ক্লাস’, মূলত পরিযায়ী শ্রমিক। দু–একজন মধ্যবিত্তও বিপদে পড়লেন। বাঙালির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে—এই ভয় ও আবেগ ছড়িয়ে পড়ল। মিটিং, মিছিল, গান-কবিতা, সভা-সমিতি, যা এখনো বাঙালির প্রধান অস্ত্র—সেসব শুরু হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে রাস্তায় সারাক্ষণই শোনা যাচ্ছে মোহিনী চৌধুরীর ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ থেকে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি বাংলায় গান গাই’। আবেগ গণ-আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে।

আরও পড়ুন

এতে কার লাভ

এ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে এই নতুন বাঙালি বা আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিকভাবে ২০২৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে একটাই দলকে সাহায্য করবে। তৃণমূল কংগ্রেস। গত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যে ‘অ্যান্টি ইনকামবেন্সি’ বা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে যে স্বাভাবিক বিরোধিতার হাওয়া তৈরি হয়েছে, সেটাকে অনেকটাই স্তিমিত করছে এই নব্য বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

দ্বিতীয়ত, বিজেপি যখন পশ্চিমবঙ্গে তাদের উত্তর ভারতের ফর্মুলা প্রয়োগ করে হিন্দু বনাম মুসলমানের ‘বাইনারি’ তৈরি করে ভোট টানতে চাইছে, তখন তৃণমূল চাইছে ‘বাঙালি বনাম অবাঙালি–বহিরাগত’র বাইনারি তৈরি করতে। এই বাইনারি অন্তত দুটি নির্বাচনে, ২০২১–এর বিধানসভা এবং ২০২৪–এর লোকসভায় তৃণমূলকে সাহায্য করেছে। কিন্তু তখনো ভারতের অন্য প্রান্তে বাঙালিদের বহিষ্কারের এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

কেন্দ্র তথা দিল্লিবিরোধী এই আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ট্র্যাডিশন যে অক্ষুণ্ন তা মাইকে ‘আমি বাংলায় গান গাই’-এর প্রাবল্য থেকে স্পষ্ট। সেই ঐতিহ্যের হাত ধরেই জনপ্রিয় হয়েছেন মমতা। নানান অভিযোগের কারণে এই জনপ্রিয়তা সম্প্রতি কমলেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে হেনস্তা করার পর জাতীয়তাবাদের যে হাওয়া উঠেছে, তাতে পরের নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশেষ অসুবিধা হবে না বলেই শরৎকালের প্রাক্কালে মনে হচ্ছে।

এবার সেটা তৈরি করল বিজেপি। অনুপ্রবেশকারী ধরা হচ্ছে বলে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে রাজ্যে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। সম্প্রতি আরএসএসের এক নেতাকে বলছিলাম, এর ফলে বিজেপিরই তো ক্ষতি হচ্ছে। তিনি মানলেন না। বললেন, বেআইনি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার প্রয়োজন আছে। ভালো কথা। প্রায় ১০ বছর ধরে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ৩৫-৪০ শতাংশ হারে ভোট পাচ্ছে, গত বিধানসভা নির্বাচনে পেয়েছে রেকর্ড ৭৭টি আসন। বাঙালি ‘আইডেন্টিটি’কেন্দ্রিক যে আবেগ তৈরি হয়েছে, তাতে বিজেপি এই হার ও আসন ধরে রাখতে পারলে অবাক হতে হবে।

অন্যদিকে ভয়ের বিষয় হলো, দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তৃণমূলের নিপীড়ন চরমে পৌঁছেছে। এবারও তারা যদি এককভাবে ক্ষমতায় আসে, তবে নিপীড়নের মাত্রা বাড়বে। সেটিও আশঙ্কার কারণ।

বিজেপি বাঙালি বিরোধিতায় অনড়

কিন্তু বিজেপি মনে করছে এটাই সঠিক পথ। অন্তত এখন পর্যন্ত। তাই তাদের নেতারা অন্য রাজ্যে বাঙালি হেনস্তার প্রতিবাদ সজোরে করছেন না। হয়তো এর কারণ সেসব রাজ্যে বিজেপিই ক্ষমতায় রয়েছে। আবার এ–ও হতে পারে, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আগামী বছর জেতার আশা ত্যাগ করেছে; কারণ, পশ্চিমবঙ্গে দলীয় নেতৃত্বের নড়বড়ে অবস্থা।

বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে যে অবস্থায় আছে, তাতে তাদের পক্ষে রাজ্যের আনুমানিক ৮০ হাজার বুথে পোলিং এজেন্ট দেওয়া মুশকিল। কিন্তু বাঙালিবিদ্বেষ কাজে লাগিয়ে আসাম ও বিহারে তারা ভালো ফল করতে পারে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে বিহার ও আসামে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। ওই দুই রাজ্যে বিরোধিতার হাওয়া বইছে বিজেপির বিরুদ্ধে। কারণ, সেখানেও এককভাবে বা অন্যদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে। এই দুই রাজ্যে অনুপ্রবেশের বিষয়টিকে অন্যতম প্রধান ইস্যু হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তাদের পশ্চিমবঙ্গ ছাড়তে হবে, যেটা সম্ভবত তারা ছাড়ছে।

যেটাই কারণ হোক, আপাতদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে এই বাঙালিবিরোধী রাজনীতির জেরে সমাজের সব স্তরের মানুষ, এমনকি যারা ঘোর তৃণমূল কংগ্রেসবিরোধী, তারাও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মঞ্চে আসতে বাধ্য হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের কেন্দ্রবিরোধী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আধুনিক ভারতে গত ১০০ বছরের বেশি সময় পশ্চিমবঙ্গের যেসব নেতা-নেত্রীকে মানুষ মনে রেখেছে, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই কেন্দ্র অর্থাৎ দিল্লির বিরোধিতা করেছেন। সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাস, শরৎচন্দ্র বসু—তাঁরা সবাই নেহরু-গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের বিরোধিতা করেছিলেন। শরৎচন্দ্র বসু তো হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মিলে অবিভক্ত বাংলা গঠনের দিকে অনেকটা এগিয়েও গিয়েছিলেন। রাসবিহারী বসু সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা আনতে চেয়েছিলেন, নেহরু-গান্ধীর অহিংসার রাস্তা থেকে সরে। পশ্চিমবঙ্গ তাদের মনে রেখেছে। বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের আবার ফিরিয়েও আনা হচ্ছে। অন্যদিকে দিল্লির সঙ্গে মিশে রাজনীতি করার ফলে অনেক বড় নেতা প্রায় হারিয়ে গেছেন। যেমন অতুল্য ঘোষ, প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু সুভাষ বসু বা বিধান রায় হারাননি।

সংবিধান রচনা হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় একদিকে নেহরুর ব্যক্তিগত বন্ধু ও চিকিৎসক ছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে নেহরুর নীতির কট্টর বিরোধীও ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গকে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের শিল্পকাঠামোকে ধ্বংস করার নেহরুর নীতির তীব্র সমালোচনা করে নেহরুকেই একাধিক চিঠি লিখেছেন বিধান রায়। এসব চিঠিতে দেখা যায়, দেশভাগের পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে চূড়ান্ত বিত্তশালী পশ্চিমবঙ্গকে কীভাবে রুগ্‌ণ অর্থনীতিতে পরিণত করেছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু।

সাংবাদিক ও গবেষক রণজিৎ রায় তাঁর প্রবল জনপ্রিয় দ্য অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল (১৯৭১) বইয়ে বলেছেন, ১৯৪৭ সালে ভারতের মোট শিল্প উৎপাদনের (গ্রস ডোমেস্টিক আউটপুট) প্রায় ২৭ শতাংশ আসত পশ্চিমবঙ্গ থেকে। কংগ্রেসের তৎকালীন শিল্পনীতির ফলে ১৯৬০-৬১ সালে এই ‘আউটপুট’ ১৭ দশমিক ২০ শতাংশে নেমে আসে। অন্যদিকে বেড়েছিল মহারাষ্ট্র, গুজরাট বা তামিলনাড়ুর শিল্প উৎপাদন। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের মূল্যে উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারতকে সমৃদ্ধিশালী করেছিলেন নেহরু।

এ কারণেই সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন বাম ফ্রন্ট তাদের তিন দশকের শাসনকালে বারবার ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী এবং কংগ্রেসকে আক্রমণ করেছে। আর এক কেন্দ্র বা দিল্লিবিরোধী বাঙালির জেরে পশ্চিমবঙ্গে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিলেন জ্যোতি বসু।

কেন্দ্র তথা দিল্লিবিরোধী এই আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ট্র্যাডিশন যে অক্ষুণ্ন তা মাইকে ‘আমি বাংলায় গান গাই’-এর প্রাবল্য থেকে স্পষ্ট। সেই ঐতিহ্যের হাত ধরেই জনপ্রিয় হয়েছেন মমতা। নানান অভিযোগের কারণে এই জনপ্রিয়তা সম্প্রতি কমলেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে হেনস্তা করার পর জাতীয়তাবাদের যে হাওয়া উঠেছে, তাতে পরের নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশেষ অসুবিধা হবে না বলেই শরৎকালের প্রাক্কালে মনে হচ্ছে।

  • শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা

মতামত লেখকের নিজস্ব