শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের গুলিতে আপনি অবাক হয়েছেন কি

ডা. রায়হান শরিফছবি: সংগৃহীত

মেডিকেল শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের গুলি—এমন সংবাদের শিরোনাম যখন চোখের সামনে এল, তখনো বুঝে উঠিনি কোথাকার ঘটনা এটি।

তৎক্ষণাৎ মনে হলো, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্কুল বা কলেজে গুলি ছোড়ার ঘটনা হয়তো। মানুষ মুহূর্তের মধ্যে কত কিছু ভেবে ফেলতে পারে। ভাবনা বা কল্পনার জাল বিস্তারে ন্যানো সেকেন্ডও মনে হয় দেরি হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রে কখন, কোথায় বন্দুক হামলা হয়েছিল, কত শিক্ষার্থী নিহত হলো, সেই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকদের হাতে অস্ত্র দেওয়ার দাবি বা সেই দাবির প্রতি ট্রাম্পের সমর্থনের বিষয়গুলো একের পর এক খেলে গেল মাথায়।

এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন অনেকেই সংবাদটি প্রচার করছিলেন, তখন মনোযোগ দিতে বাধ্য হলাম। এ ঘটনা বাংলাদেশেই—আমার সোনার বাংলায়।

একটা সময় স্কুলে শিক্ষার্থীদের শেখানোর একটি তরিকা ছিল বেত দিয়ে পেটানো। অভিভাবকেরাও সেটিতে সায় দিতেন। শিক্ষকের কাছে সন্তানকে গছিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘মাংস আপনার, হাড্ডি আমার’। শিক্ষকেরা বলতেন, ‘কত গরু পিটিয়ে মানুষ করে ফেললাম, এ আর এমন কী।’

আরও পড়ুন

যদিও শেখানোর সেই ‘নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া’ থেকে শিক্ষকদের বের করে আনা হয়েছে। তাঁদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে বেত। কিন্তু বেতের বদলে কোনো শিক্ষকের হাতে পিস্তল উঠে যাবে, সেটি কীভাবে কল্পনা করি!

ওই শিক্ষকের নাম রায়হান শরীফ। নাম শুনলেই চট করে জেমস বন্ড সিনেমার বিখ্যাত অভিনেতা ওমর শরীফের নাম মনে পড়ে যেতে পারে অনেকের। তো আমাদের এই ‘ওমর শরীফ’ সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক।

‘অবাধ্য’ শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দিতে শ্রেণিকক্ষেই এক শিক্ষার্থীকে গুলি করেন তিনি। গুলি পায়ে লাগায় কোনোমতে প্রাণে বাঁচেন শিক্ষার্থী আরাফাত আমিন। তিনি ওই মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।

শিক্ষক রায়হান শরীফ রুটিনে ক্লাস না থাকা সত্ত্বেও সময়-অসময়ে শিক্ষার্থীদের ডেকে এনে তাঁর ক্লাস করতে বলতেন। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত ছিলেন। গত রোববার অসময়ে এমন এক ক্লাস ডাকায় শিক্ষার্থীরা তাতে হাজির হননি। পরের দিন সেই বিষয়টি তুলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা করতে করতে একপর্যায়ে সঙ্গে থাকা একটি ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করেন তিনি।

গুলিবিদ্ধ হয়ে আরাফাত আমিন চিৎকার করলে তাঁকে সাহায্যের জন্য বন্ধুরা এগিয়ে আসেন। তাঁরা তাঁকে জরুরি বিভাগে নিতে চাইলে শিক্ষক রায়হান অস্ত্র উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে বলেন, ‘তোরা যদি ওকে চিকিৎসার জন্য জরুরি বিভাগে নিয়ে যাস, তাহলে তোদের গুলি করে মেরে ফেলব।’

যদিও ওই শিক্ষককে কোনো না কোনোভাবে তালাবদ্ধ করে রাখতে সক্ষম হন শিক্ষার্থীরা। পরে খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাঁকে ওই পিস্তলসহ নিয়ে যায়।

এ দেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কত কাণ্ড-ই না ঘটে। কিছুদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নানা অপকর্ম নিয়ে নানা সমালোচনা তৈরি হয়েছে। যৌন নিপীড়ন থেকে শুরু করে শিক্ষক-কর্মচারী মারামারি পর্যন্ত। মেডিকেল কলেজও এসব অনাচার থেকে কখনো বাইরে ছিল না।

তবে শিক্ষক রায়হান শরীফ যা দেখালেন, তা একেবারেই নতুন! শিক্ষকেরা এত কিছু করে দুর্নাম কুড়িয়ে যাচ্ছেন যে, সেখানে ‘নতুনত্ব’ কিছু না থাকলে বিষয়টি আসলে আর জমে না। ফলে রায়হান শরীফ সেখানে ‘আদর্শ শিক্ষক’ হিসেবে হাজির হয়েছেন, তা-ও একেবারে ফিল্মি কায়দায়।

আরও পড়ুন

এমন দৃশ্য আসলে সিনেমাতেই দেখা যায়। এ মুহূর্তে হিন্দি সিনেমা ‘আ থার্সডে’ এবং রাশিয়ান সিনেমা ‘দ্য টিচার’-এর কথা মনে পড়ছে।

দুটি সিনেমাতেই দেখা যায়, শিক্ষক বন্দুক নিয়ে ক্লাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে ফেলেন। যদিও এসব সিনেমা বেশির ভাগ থ্রিলার বা সাইকোলজিক্যাল ঘরানারই হয়। সিনেমা দুটিও তেমন। সিনেমা শেষ করার পর শিক্ষকের প্রতি একধরনের সিমপ্যাথি বা সহানুভূতি তৈরি হবে। দেশ বা সমাজকে বড় ধরনের শিক্ষা দিতে বা ধাক্কা দিতে বা নাড়া দিতে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে জিম্মি করেন তাঁরা।

তবে রায়হান শরীফ যা ঘটালেন, তাতে তাঁর প্রতি কোনো প্রকার সহানুভূতি তৈরি হওয়ার সুযোগ নেই। বরং তাঁর এ ঘটনা আমাদের যতটা বিস্মিত করতে পারত, সেটিই করল না। শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীকে গুলি করবেন— এমন ঘটনা আমরা আগে শুনিনি। কিন্তু এই ঘটনাটি ঘটনার পর আমাদের হাবভাবে মনে হচ্ছে এটি যেন স্বাভাবিক একটি বিষয়।

রায়হান শরীফ রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ৫২তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। সেখানকার ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন তিনি। তাঁর এই অতীত পরিচয়টুকু না থাকলে কি তিনি অবৈধ অস্ত্র পকেটে বা ব্যাগে নিয়ে ঘোরার সাহস পেতেন? শিক্ষার্থীরা অস্ত্র নিয়ে ক্লাসে আসতে আপত্তি জানালে তিনি ভয়ভীতি ও গুলি করে হত্যার হুমকি দিতেন। ভয়ের সংস্কৃতি তৈরিতে এর চেয়ে মোক্ষম পন্থা আর কী হতে পারে!

আসলে পেশিশক্তি ও ক্ষমতার চর্চা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে আমরা সবাই কোনো না কোনো পর্যায়ে নানাজনের কাছে জিম্মি হয়ে আছি। আমরা সম্ভবত অপেক্ষা করতে থাকি এমন ঘটনার, যা আগে কখনো ঘটেনি। একের পর এক ঘটনার পর আমাদের মধ্যে এমন নির্বিকারত্ব ভর করে যে কোনো ‘নতুনত্বেই’ আমরা আর অবাক হই না। ধাক্কা খেয়েও আমরা কেউ জেগে ওঠার তাগিদ অনুভব করি না।

এ ঘটনা খবর হওয়ার পরপরই একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এ শিক্ষক ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করতেন।’ সে কথাই সত্যি হয়ে ওঠে ঘটনার বিস্তারিত আরও খবরে।

রায়হান শরীফ রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ৫২তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। সেখানকার ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন তিনি। তাঁর এই অতীত পরিচয়টুকু না থাকলে কি তিনি অবৈধ অস্ত্র পকেটে বা ব্যাগে নিয়ে ঘোরার সাহস পেতেন?

আরও পড়ুন

তাঁর হেফাজত থেকে পুলিশ কয়েক ডজন গুলিসহ দুটি বিদেশি পিস্তল ও এক ডজন বিদেশি চাকু উদ্ধার করেছে। তাঁর মুঠোফোনের হোয়াটসঅ্যাপ ঘেঁটে দেখা গেছে, তিনি অস্ত্র বেচাকেনার ব্যবসা করেন, এমন কথা বলছেন আরেকজনকে। সেটি সত্যি হয়ে থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ গুগলে সার্চ দিলেই এমন খবর পাওয়া যায়, কত ছাত্রলীগ নেতা অস্ত্র ব্যবসা করে গিয়ে ‘ইতিহাসে সোনার অক্ষরে’ নাম লিখিয়ে গিয়েছেন।

এক সময় বাংলা সিনেমায় ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের বিষয়টি চিত্রায়িত করার একটি সাধারণ দৃশ্য ছিল এ রকম; পরীক্ষার হলে টেবিলে পিস্তল রেখে রংবাজ শিক্ষার্থীর নকল করছে। বাংলা সিনেমার সেই যুগ কি এখন আছে? এই পাল্টানো সময়ে শিক্ষক তাই টেবিলে অস্ত্র রেখে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেন।

হ্যাঁ, রায়হান শরীফ এ কাজই করতেন। শিক্ষার্থীরা অস্ত্র নিয়ে ক্লাসে আসতে আপত্তি জানালে তিনি ভয়ভীতি ও গুলি করে হত্যার হুমকি দিতেন। ভয়ের সংস্কৃতি তৈরিতে এর চেয়ে মোক্ষম পন্থা আর কী হতে পারে!

এ ছাড়া তিনি কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের হুমকি, রূঢ় আচরণ করা, ছাত্রীদের সঙ্গে আপত্তিকর আচরণ করতেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক সেবনের অভিযোগও আছে। কলেজ প্রশাসনকে এগুলো জানানো হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুন

২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মেডিকেল কলেজটিতে এক বছরেরও বেশি সময় আগে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরই মধ্যে এত অভিযোগ পেয়েও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। তাঁকে কী কারণে এভাবে আশকারা দেওয়া হলো? শিক্ষার্থীকে গুলি করার দায় কি প্রশাসনের ঘাড়েও পড়ে না?

আবার বিষয়টি এমনও হতে পারে, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বন্দুকধারী এই শিক্ষকের কাছে বাকি শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন। বিচারহীন সংস্কৃতি জারি থাকা এ রাষ্ট্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলে কে কখন আবার বিপদে পড়েন!

জেলায় জেলায় মেডিকেল কলেজ করার সরকারি নীতি নিয়ে অনেকে সমালোচনা করেন। এক যুগ আগে প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজেও ভালো কোনো অবকাঠামো হলো না, শিক্ষক-সংকট লেগেই থাকে, সেখানে জেলায় জেলায় মেডিকেল কলেজ করে কী বা কার ফায়দা, সেই প্রশ্ন নতুন নয়।

তবে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ করলে রায়হান শরীফের মতো ছাত্রলীগ নেতাদের কর্মসংস্থানে সহজ হয়, সেটি না বোঝার কোনো কারণ নেই। ছাত্রসংগঠনের লেজুড়বৃত্তি ও মাস্তানতন্ত্রের সঙ্গে মিলে তাঁরাই ক্যাম্পাসকে নিয়ন্ত্রণ করেন, কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা জারি রাখেন। একেকটি ক্যাম্পাসকে তৈরি করেন নাগরিক অধিকারহীন ও বাক্‌স্বাধীনতাহীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে!

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: [email protected]