রাজশাহী নাকি ঢাকার পথে রংপুর সিটি করপোরেশন?

রাজশাহীর চেয়ে অনেক সহজে রংপুর শহরকে আদর্শ শহরে পরিণত করা সম্ভব
ছবি: প্রথম আলো

গত ১৮ ও ১৯ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ছোটকাগজ চিহ্ন–এর আয়োজনে ছোটকাগজ মেলা। বাংলাদেশ থেকে ১০২টি এবং ভারত থেকে ৬৮টি ছোগকাগজের স্টল ছিল মেলায়। ছাত্রজীবনে আমরা ‘চিহ্ন’ পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলাম।

মেলা উপলক্ষে গিয়েছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেলা শেষে চিহ্নর পুরোনো কর্মী কবি কুমার দীপ, গবেষক নিত্য ঘোষসহ রাতের রাজশাহী দেখতে গিয়েছিলাম। রাত তখন সাড়ে ১১টা। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিকশাযোগে আমরা আলুপট্টি হয়ে সাহেববাজারে গেলাম। প্রথমেই নজর কাড়ল আলোর সৌন্দর্য। পদ্মার পাড় ঘেঁষে সড়কের দুই ধারে আলোর এমন রূপ বাংলাদেশে আর কোথাও নেই।

ঘড়ির কাঁটায় যখন ঠিক ১২টা, তখন একদিকের আলো নিভে গেল। এতেও সৌন্দর্যে কোনো ঘাটতি নেই। দেখলাম সড়কের পাশে সারি সারি চন্দ্রপ্রভা ফুল হলুদ আভা ছড়াচ্ছে। হলুদ, খয়েরি রাধাচূড়া, রঙ্গন, করবী, কাঠগোলাপসহ বিচিত্র ছোট ছোট সৌন্দর্যবর্ধক গাছের সমাহার। লাল পাতার অনেক গাছের সারির ফাঁকে ফাঁকে রূপ বিলাচ্ছে।

রাতের রাজশাহী এতটাই ভালো লাগছিল যে আমরা সাহেববাজার, কোর্ট-জেলখানা পার হয়ে কাশিডাঙা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। আমাদের রিকশাচালক ছিলেন আরিফুল ইসলাম। তিনি বলছিলেন, ‘ছারা রাত ঘুরে বেড়ালেও একজন ছিনতাইকারী পাবেন না।’ সাহেববাজার পার হয়ে দেখলাম সড়কের পাশে অসংখ্য শিউলি ফুলের গাছ। গাছভর্তি ফুল। আরও কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলাম সারি সারি পলাশগাছ।

পলাশ ফোটার সময় এটি নয়। তরুণ বয়সী গাছগুলো ফুল ছাড়াও সুন্দর লাগছে। পলাশের সারির পরই দেখলাম কাঞ্চন ফুলের সারি সারি গাছ। দেবকাঞ্চন কিংবা শ্বেতকাঞ্চন হবে হয়তো। সড়ক বিভাজকের মাঝখানে বিচিত্র রঙের ফুল। সাদা, লাল, গোলাপি, খয়েরি, হলুদ। বর্ণালি সিনেমা হলের পাশের সড়কের সড়কবাতিগুলো আরেক রকম। এখানে সড়ক বিভাজকের মাঝখানে একধরনের পামগাছ চোখে পড়ল। আমরা তিনজনে বিস্ময়ে বলাবলি করছি, রাজশাহী শহর বাংলাদেশের একখণ্ড স্বর্গে পরিণত হয়েছে।

রাতে প্রায় ২০ কিলোমিটার রিকশায় ঘুরলাম। অবিশ্বাস্য পরিষ্কার এই শহর। রাতে দেখছিলাম পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নগর পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত। রিকশা দাঁড় করিয়ে আমরা শিউলিতলে খানিকটা দাঁড়িয়ে ছিলাম। পাশে একটি অপরিচিত গাছ দেখলাম। মনে হলো কাইনজাল। সেই সময়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গেও কথা হয়। তাঁরা আনন্দের সঙ্গে কাজ করছেন। আজিজুর রহমান নামের এক ময়লা বহনকারী গাড়িচালকের সঙ্গে কথা হয়।

২০ বছর ধরে তিনি গাড়ি চালান। বাংলা–ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলছিলেন। তিনি জানালেন, রাত দুইটার পর শিক্ষিত-ভদ্র পরিবারের অনেকেই শহরের সৌন্দর্য দেখার জন্য গাড়ি নিয়ে বের হন। দোকানগুলো আটটায় বন্ধ হওয়ার কারণে অনেক আগেই শহর ফাঁকা হয়। আমরা প্রায় জনশূন্য শহরেই ঘুরে বেড়ালাম। আজিজুর রহমান কিছুটা মন খারাপের সুরে জানালেন ২০ বছর ধরে তাঁরা মাস্টাররোলে কাজ করছেন।

রংপুর সিটি করপোরেশনের আয়তন অনেক বড়। ২০৫ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটার। রাজশাহী পুরোনো সিটি করপোরেশন। অপরিকল্পিতভাবে প্রথমে বেড়ে উঠেছিল। মাত্র ২০ বছর আগেও বাংলাদেশের একটি অন্যতম নোংরা শহর ছিল এটি। রাজশাহীর চেয়ে অনেক সহজে রংপুর শহরকে আদর্শ শহরে পরিণত করা সম্ভব। এর জন্য যে হাজার হাজার কোটি টাকা অনিবার্য, তা নয়। সদিচ্ছা থাকা চাই। স্বপ্ন থাকা চাই।

কীভাবে এই শহর এত সুন্দর হলো তার উত্তরে বললেন, ‘আগে কাজের জন্য জনবল কম ছিল। ময়লাও পরিষ্কার করতে হতো হাতে। এখন লোক বেশি, ময়লা পরিষ্কার করার মেশিনও আছে।’ ময়লার গাড়িতে বসে থাকা সুমন রহমান নামের একজন সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা হলো। তাঁর ভাষ্য, ‘আমরা ভোররাত চারটা পর্যন্ত শহরের সব ময়লা পরিষ্কার করার পর বাসায় যাব।’

প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদের কাছে ভালো নার্সারির সন্ধান চেয়েছিলাম, যেখানে দুর্লভ গাছের চারা পেতে পারি। তিনি মাহবুব পলাশের সঙ্গে পরিচয় করান। তিনি বৃক্ষরোপণ কৃষি পদক লাভ করেছেন। তাঁর সঙ্গে শালবন পার হয়ে একটি নার্সারিতে গিয়েছিলাম। দুটি দুর্লভ গাছের চারাও পেলাম। যাওয়া–আসার পথে তাঁর সঙ্গে কথা হলো রাজশাহী শহরের উন্নয়ন নিয়ে। তিনি বলছিলেন, ‘মূল শহর থেকে অনেক দূরের সড়ক এখন অনেক প্রশস্ত।’

রংপুর সিটি করপোরেশন তুলনামূলক নতুন। নগরায়ণ খুব দ্রুত হচ্ছে। রংপুর কোন সিটি করপোরেশনকে অনুসরণ করবে, এটাই বড় জিজ্ঞাস্য। রাজশাহীর মতো দৃষ্টিনন্দন নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন শহর এখন কাছেই। ঢাকার চেয়েও কাছে। সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসা যায়। এই শহরকে অনুসরণ করতে পারে রংপুর। কিন্তু গত ১০ বছরে সেটি আমাদের কাছে পরিলক্ষিত হয়নি; বরং ঢাকার মতো অপরিকল্পিত শহরের দিকেই এগোচ্ছে এই শহর। এক যুগে একটি মহাপরিকল্পনা হয়নি। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে শতভাগ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে রংপুর। শহরের উন্নয়নের জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দ নেই। এ শহরের উন্নয়নকাজে সমন্বয়ের বড় অভাব। রংপুর এখন জলাবদ্ধতারও সড়কে পরিণত হয়েছে। শহরের ভেতরে দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যামাসুন্দরী নদী তো সবার সামনেই নির্যাতিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন

আমরা যখন ঢাকা যাই, তখন থেকে মনের মধ্যে শঙ্কা কাজ করে। কোথাও দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বললে যেকোনো সময়ে ছিনতাইকারী মুঠোফোন ছিনিয়ে নিতে পারে। হাতের ছোটখাটো কোনো ব্যাগও টেনে নিতে পারে। শখ করে আসল গয়না পরাও কঠিন। বিশুদ্ধ পানির ভীষণ অভাব। ঢাকা একটি ময়লার শহর। অনিরাপদ তো বটে। ঢাকায় থাকা মানে বাংলাদেশের নরকবাস। সৌন্দর্যের বালাই নেই। বিশ্বের খারাপ শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষের কাছাকাছি থাকে এই শহর। ঢাকা শহর থেকে এই শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন—একটি অপরিকল্পিত-অনিয়ন্ত্রিত শহর বসবাসের জন্য কতটা অনুপযোগী হতে পারে। তা না করে সেই পথেই যেন রংপুর সিটি করপোরেশন।

রংপুর সিটি করপোরেশনের আয়তন অনেক বড়। ২০৫ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটার। রাজশাহী পুরোনো সিটি করপোরেশন। অপরিকল্পিতভাবে প্রথমে বেড়ে উঠেছিল। মাত্র ২০ বছর আগেও বাংলাদেশের একটি অন্যতম নোংরা শহর ছিল এটি। রাজশাহীর চেয়ে অনেক সহজে রংপুর শহরকে আদর্শ শহরে পরিণত করা সম্ভব। এর জন্য যে হাজার হাজার কোটি টাকা অনিবার্য, তা নয়। সদিচ্ছা থাকা চাই। স্বপ্ন থাকা চাই।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদীবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক। ইমেইল: [email protected]