পোশাকশিল্প নিয়ে আমরা শুধু গর্বই করে যাব?

‘বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্পে বিশ্বে দ্বিতীয়, সে প্রথম হতে চায়, কিন্তু মজুরি দিতে চায় না।’

বাংলাদেশে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ দিনমজুর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, দেশের দিনমজুরের সংখ্যা প্রায় সোয়া এক কোটি, যাঁদের মজুরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর বাইরেও আছেন সোয়া এক কোটি মানুষ, যাঁরা পরিবারের মধ্যে কাজ করেন, কিন্তু কোনো মজুরি পান না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, আইএলও এবং আন্তর্জাতিক মান সংজ্ঞায় এঁরা মূলত বেকার।

দিনমজুররা প্রতিদিনের মজুরিতে কাজ করেন, বিশেষ করে কৃষি, নির্মাণশিল্প, পরিবহন এবং উন্নয়নমূলক কাজের শ্রমিকেরা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। তাঁদের প্রতিদিন কাজ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত নয়। ঢাকা, জেলা শহর, মফস্বল শহরসহ এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শ্রমিকের হাট গড়ে উঠেছে, এসব হাটে শ্রমিকেরা কাজের আশায় সকালে গিয়ে হাজির হন। আর যাঁদের শ্রমিক দরকার, তাঁরা সেখান থেকে শ্রমিকদের নিয়ে যান, দৈনিক মজুরি অঞ্চলভেদে সর্বোচ্চ ৫০০-৭০০ টাকা।

তবে সমস্যা হলো প্রতিদিন তাঁরা কাজ পান না, অসুস্থ হলে, রাজনৈতিক অস্থিরতায় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাঁরা অলস এবং আয়হীন থাকেন বলে গড় মজুরি অনেক কম, যা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। আয়ের স্থায়ী অনিশ্চয়তার কারণে এই শ্রমিকদের কেউ কেউ এবং তাঁদের সন্তানেরা একটা পর্যায়ে শিল্পশ্রমে, তৈরি পোশাকশিল্পে যুক্ত হয়।  

বাংলাদেশের অধিকাংশ শিল্পকারখানাই শ্রমঘন, শ্রমিকের ঘামেই সচল আছে অর্থনীতি। শ্রমঘন পোশাকশিল্প সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত, কিন্তু সেই শ্রমিক মুনাফার কিছুই পান না, উল্টো মজুরিও ন্যায্য হারে পান না। জীবনের চাকা সচল রাখতে তাঁরা কাজ করেন কাকডাকা ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত, তথাপি তাঁরা সচ্ছল নন।

বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন মাত্র ৮ হাজার ৪০০ টাকা, গত পাঁচ বছরের ক্রমাগত মূল্যস্ফীতিতেও মজুরি সমন্বয় হয়নি। মালিকেরা এটা বাড়িয়ে  মাত্র ১০ হাজার ৪০০ টাকা করতে চান। এটা বাঁচার মোট মজুরি নয়।

আরও পড়ুন

বাঁচার মতো মজুরি দাবি করতে গেলে, ৩০ ও ৩১ অক্টোবর ২০২৩ শ্রমিকদের বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অনেক শ্রমিক আহত হন। একজন শ্রমিক আহত হয়ে হাসপাতালে মারা যান, আরেকজ নিহত হন কারখানায় আগুন দেওয়ার ঘটনায়।

এ দেশে চাকরি চাইতে গেলে গুলি, মজুরি চাইতে গেলে গুলি, দাম কমানোর দাবি জানালে গুলি, কোটা বাতিল চাইলে গুলি, নিরাপদ সড়ক চাইলে গুলি, ভোটের অধিকার চাইতে গেলে গুলি। জনমানুষের ক্ষোভ ঠেকাতে এ দেশে গুলি চালানো ছাড়া যেন কোনো সমাধান নেই।

১ নভেম্বর ২০২৩, ডেইলি স্টার বাংলায় এক নারী শ্রমিক বলেছেন, ১১ বছর ধরে ৮-৫টা কাজ করে ভাতাসহ তিনি ১০ হাজার টাকা পান। এই শোষণমূলক পোশাকশিল্প নিয়েই এত গর্ব আমাদের, এর ওপরেই টিকে আছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দুটি স্তম্ভের একটি।

পোশাকশিল্পে চীনের ৩০৩ ডলার, ভারতের ১৭১ ডলার, ভিয়েতনামের ১৭০ ডলারের গড় মজুরির বিপরীতে বাংলাদেশের গড় মজুরি মাত্র ৭২ ডলার। বাঁচার জন্য ওভারটাইমসহ ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয় শ্রমিকদের। অর্থাৎ একজন শ্রমিক দিনে দুজন শ্রমিকের সমপরিমাণ কাজ করেন, এই দিয়ে শ্রমিকেরা সর্বোচ্চ ১৩০-১৪০ ডলার টাকা আয় করেন, তাঁদের ব্যক্তিগত পারিবারিক ও সামাজিক কোনো জীবন নেই। যাঁরা ওভার টাইম কম করেন, তাঁদের আয় আরও অনেক কম।

এই অমানবিক কাজ তাঁদের স্বাস্থ্য, জীবন ও যৌবন, কর্মশক্তি কেড়ে নেয়। ৩৫-৪০ বছরের মধ্যেই বিভিন্ন রোগে শ্রমিকের কাজ ছেড়ে, ওয়ার্ক মাইগ্রেশন করতে হয় অর্থাৎ শ্রমিকদের একটা অবধারিত ইকোনমিক ডিসপ্লেইসমেন্ট হয়, নতুন কাজে তাঁর পুরান দক্ষতা কাজে আসে না এবং এতে আয় আরও কমে যাওয়ার কারণ ঘটে। অনেকে কৃষিতে বাঁচার তাগিদে গ্রামে যান, কিন্তু সেখানে এমনিতেই ছদ্ম বেকারত্বের মহড়া।

গত এক দশকের সব আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশের গড় মজুরি শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয় বরং আফ্রিকাসহ পুরো পৃথিবীতে সর্বনিম্ন। অথচ আমাদের ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার পৃথিবীতে হয় সর্বোচ্চ না হয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অর্থাৎ নিম্ন মজুরি এ দেশে সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণের সমস্যা তৈরি করেছে, যা পাচার ও ধনবৈষম্যের মোট মৌলিক সমস্যাগুলোর জন্য দায়ী। নিম্ন মজুরি সুস্পষ্ট বৈষম্য ও শোষণের এক ভয়াবহ সংকট, যা সমাধান না করলে দেশের রপ্তানি আয় টেকসই হবে না, কারণ ক্রেতাদের শ্রম অধিকার ও পরিবেশ সচেতনতা উভয়ই বাড়ছে।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি শ্রমজীবীদের দারিদ্র্য যাপনকে ন্যায্যতা দিতে পারে না। উচ্চ প্রবৃদ্ধির কালে মজুরি না বাড়ার অর্থ রাষ্ট্র প্রযোজিত বৈষম্যকে জিইয়ে রাখা মাফিয়াগিরি। ডলারের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে এক বছরে, দেশের দুই অঙ্কের খাদ্য মূল্যস্ফীতি, যা ১২ বছরের মধ্যে শীর্ষে। কিন্তু ৫ বছরে মজুরি বাড়েনি, হয়নি মূল্যস্ফীতি এবং অপরাপর জীবনযাপন খরচ বৃদ্ধির খাতের সমন্বয়। এ যেন এক জঙ্গলের শাসন। শুধু গড় মূল্যস্ফীতি আমলে নিলে এই পাঁচ বছরে শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে অন্তত ৫০ শতাংশ। বাস্তবে ৫ বছরে টাকার ক্রয়ক্ষমতাও সে রকমই কমেছে।

আরও পড়ুন

শ্রমিকেরা ন্যূনতম মজুরি করার দাবি করেছেন ২৩ হাজার টাকা বা ২২০ ডলার, যা চীনের গড় মজুরি থেকে ৯৩ ডলার কম। সিপিডি বিশদ গবেষণা করে পোশাকশিল্পে ন্যূনতম মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা বা ১৬০ ডলার করার প্রস্তাবনা করেছে, যা ভারত ও ভিয়েতনামের গড় মজুরির চেয়েও ১০-১১ ডলার কম। কিন্তু এই দুই দেশের নিত্যপণ্যের দাম বাংলাদেশের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সস্তা।

সিপিডি প্রস্তাবিত ১৬০ ডলার মজুরিও কিন্তু চীন (৩০৩ ডলার), ইন্দোনেশিয়া (২৪৩ ডলার), কম্বোডিয়া (২০০ ডলার ), ভারত (১৭১ ডলার ), ভিয়েতনাম (১৭০ ডলার) এদের সবার চেয়ে কম (পোশাকশিল্পে সবচেয়ে কম মজুরি বাংলাদেশে, অক্টোবর ০৯, ২০২৩, বণিক বার্তা)। এই দেশগুলোকে একটি ছাড়া মোট রপ্তানিতে বাংলাদেশ সবাইকে ছাড়িয়ে। সেটাও সরকার-মালিকপক্ষ নেক্সাস মানতে নারাজ।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্পে বিশ্বে দ্বিতীয়, সে প্রথম হতে চায়, কিন্তু মজুরি দিতে চায় না। তারা মাসিক মজুরি ৭০ ডলার থেকে বাড়িয়ে করতে চায় মাত্র ১০০ ডলার। অথচ একবার ১০০-১১০ ডলার ঠিক হয়ে গেলে আগামী ৫ বছর এটা আর বাড়বে না, যেভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এবং  টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমছে, বাস্তবে ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার হওয়া উচিত। অন্যথায় আগামী পাঁচ বছরেও শ্রমিক শোষণ ও বৈষম্যের স্টিম রোলার চলতে থাকবে, মানুষ চাকরি করেও ঋণগ্রস্ত ও অধিক হারে দরিদ্র হবেন।  

ন্যায্য মজুরি দাবি করলে শ্রমিক ছাঁটাই হয়, দেশের একটাও সচল ট্রেড ইউনিয়ন নেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে ট্রেড ইউনিয়নের মেম্বার হওয়া শ্রমিকদের কাজ থেকে ছাঁটাই করা হয়, বকেয়া মজুরিটাও দেওয়া হয় না। ন্যায্য মজুরি দাবি করলে কারখানা ও বেতন বন্ধের হুমকি আসে। অথচ তাঁরা পোশাক বানান বিনা আমদানি শুল্কের সুবিধা নিয়ে, দেশের নদী-পানি-মাটি পরিবেশ—সব দূষণে বিপর্যস্ত করে।

এ রকম শ্রমিক শোষণনির্ভর, পরিবেশ ধ্বংসকারী শিল্পের দরকার কী, যা ডলার আয় করে তার অধিকাংশ আমদানিতে চলে যায়, বাকিটা যায় পাচারে, রপ্তানি আয়ের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার থেকে যায় বিদেশে। এমন শিল্পের রূপান্তর অবশ্যই  দরকার।  

জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিশেষজ্ঞ অলিভিয়ার ডি শুটার বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন মূলত তৈরি পোশাকশিল্পের মতো একটি রপ্তানি খাত দ্বারা ব্যাপকভাবে চালিত, যা সস্তা শ্রমের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদা থেকে প্রত্যাশিত স্তরে উন্নীত হওয়ার পর একটি অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। মানুষকে দরিদ্রতার মধ্যে রেখে একটি দেশ তার আপেক্ষিক সুফল বা উন্নয়ন ভোগ করতে পারে না। (বিবিসি বাংলা ২৯ মে ২০২৩)

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য। ই-মেইল: [email protected]