পানামা খাল নিয়ে ট্রাম্পের নাটকীয় হুমকি কেন

নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনোছবি এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদ পুনরায় গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্যেই হঠাৎ পানামা খাল পুনর্দখলের হুমকি দিতে শুরু করেছেন তিনি।

নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সাম্প্রতিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সেখান থেকে জানা যায়, পানামা খাল ব্যবহার করা নিয়ে ‘অযৌক্তিক’ মাশুল আরোপ করে পানামা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘প্রতারিত’ করছে।

ট্রাম্পের মতে, মধ্য আমেরিকার এই দেশের আচরণ বিশেষভাবে আপত্তিকর, কারণ, তারা জানে যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতি কোনো এককালে ‘অসাধারণ উদারতা’ দেখিয়েছে।

ট্রাম্প দাবি করেন যে চীনা সৈন্যরা বর্তমানে খাল পরিচালনা করছেন। এই দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন। প্রকৃতপক্ষে, বিশ শতকের শুরুতে খনন করা পানামা খাল একসময় যুক্তরাষ্ট্রই পরিচালনা করত। ১৯৯৯ সালে তা পানামার হাতে হস্তান্তর করা হয়।

আর যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত ‘অসাধারণ উদারতার’ বিষয়ে বলার বিশেষ কিছু নেই। শুধু ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে চালানো সামরিক অভিযান ‘অপারেশন জাস্ট কজ’-এর কথা মনে করলেই যথেষ্ট। সেই অপারেশনের ফলে পানামা সিটির দরিদ্র এলাকা এল চোরিল্লো পরিচিতি পায় ‘ছোট হিরোশিমা’ নামে।

অনেক সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই অভিযানে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক যুদ্ধের আগাম প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নৃশংসভাবে আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষমতা দেখিয়েছিল নিরস্ত্র জনতার ওপর। এর মধ্যে পানামার নেতা ও যুক্তরাষ্ট্রের একসময়ের মিত্র ম্যানুয়েল নরিয়েগা ১৯৯০ সালের ৩ জানুয়ারি মার্কিন বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি পানামা সিটির ভ্যাটিকান দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দূতাবাসের বাইরে মার্কিন ট্যাংক থেকে উচ্চ শব্দে বাজানো গানগুলোর কারণে তার পক্ষে ভেতরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ওই গানগুলোর মধ্যে ছিল লি গ্রিনউডের ‘গড ব্লেস দ্য ইউএসএ’ আর বোন জোভির ‘ওয়ান্টেড ডেড অর অ্যালাইভ’।

নরিয়েগাকে মিয়ামিতে নিয়ে যাওয়া হয় মাদক পাচারসহ অন্যান্য অভিযোগে বিচার করার জন্য। অথচ দীর্ঘদিন ধরেই নরিয়েগার সঙ্গে সিআইএয়ের সংযোগ ছিল। তাঁর মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার বিষয়টি মার্কিন প্রশাসনের জানা ছিল। এত দিন কোনো সমস্যা হয়নি। নরিয়েগাকে সরানোর পর পানামার শাসক শ্রেণির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসা আরও লাভজনকভাবে চালানোর পথ সুগম হয়।

এর আগেও পানামায় আমেরিকার দারতার নজির আছে। ১৯০৩ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পানামার একটি বড় অংশ, পানামা ক্যানাল জোন কার্যত নিজেদের উপনিবেশ হিসেবে পরিচালনা করেছিল। সেখানে জাতিগত বর্ণবাদী বৈষম্য প্রচলিত ছিল। ওই ক্যানাল জোনে যুক্তরাষ্ট্রের নানা সামরিক ঘাঁটি ও অন্যান্য স্থাপনা ছিল। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ইউএস আর্মি স্কুল অব দ্য আমেরিকাস। এই স্কুলে লাতিন আমেরিকার অনেক স্বৈরশাসক, ডেথ স্কোয়াড নেতা এবং নরিয়েগা নিজেও প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্র ১৯১৪ সালে পানামা খালের খননকাজ সম্পন্ন করে। এই প্রকল্পে হাজার হাজার মানুষ জীবন দিয়েছেন। সেসব নিহত মানুষের অধিকাংশ ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক। একেও নিশ্চয়ই আমেরিকান উদারতার মধ্যে ধরতে হবে। এই খালের খনন শুরু হয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের শাসনামলে। রুজভেল্ট মনে করতেন এই জলপথ ‘যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ভাগ্যের অপরিহার্য পথ’।

১৯০১ সালে রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময় পানামা তখনো কলম্বিয়ার অংশ ছিল। কিন্তু খাল খনন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও কলম্বিয়া সরকারের মধ্যে আলোচনা তেমন মসৃণ ছিল না। শেষমেশ ১৯০৩ সালে নতুন দেশ পানামার জন্ম হয়। এর পেছনে মূলত বড় ভূমিকা রেখেছিল রুজভেল্টের কূটনৈতিক উদ্যোগ। বিনিময়ে পানামা তাদের ভূমি ও সার্বভৌমত্বের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

বিশ্বের ১ নম্বর সাম্রাজ্যবাদী সুপারপাওয়ার নিজেকে শক্তিশালী দেখাতে চায় আবার অন্যের অন্যায় সিদ্ধান্তের শিকার হওয়ার অভিনয়ও করে।

জন উইকস ও ফিল গানসন তাঁদের Panama: Made in the USA বইয়ে লিখেছেন, পানামাকে ‘ল্যাটিন আমেরিকার হৃদয় থেকে কেটে বের করা হয়েছিল একটি বিদেশি শক্তির লক্ষ্য পূরণের জন্য’। আজও সেই অস্ত্রোপচারের ক্ষত বহন করে পানামা। পানামা সিটির একটি প্রধান সড়ক এখনো রুজভেল্টের নামে রয়েছে। তবে আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের নামে রাখা ফোর্থ অব জুলাই অ্যাভিনিউয়ের নাম বদলে এখন শহীদ অ্যাভিনিউ রাখা হয়েছে। এই শহীদেরা হচ্ছেন ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসের পতাকা দাঙ্গার শহীদ। ওই দিনে খাল অঞ্চলের একটি স্কুলে পানামার ছাত্ররা যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার পাশে নিজেদের পতাকা উড়ানোর চেষ্টা করলে মার্কিন বাহিনী ২১ জন ছাত্রকে হত্যা করে।

ট্রাম্পের নিজেরও পানামা সিটির সঙ্গে সম্পর্ক আছে। ট্রাম্পের সেখানে একটি বিলাসবহুল ওয়াটারফ্রন্ট কন্ডো আছে। একসময় এটি ট্রাম্প ওশেন ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড টাওয়ার নামে পরিচিত ছিল। যদিও সাইনবোর্ড থেকে এখন ট্রাম্পের নাম সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে স্থানীয়ভাবে এটি এখনো ‘ট্রাম্প’ নামেই পরিচিত। ২০১৭ সালে ট্রাম্প অর্গানাইজেশন এই ৭০ তলা ভবনে তাদের নাম ব্যবহার করার লাইসেন্স দিয়েছিল। ভবনটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল মাদক পাচার ও আন্তর্জাতিক অপরাধের।

তবে ট্রাম্প কখনো পানামা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং পানামা খাল পুনরুদ্ধারের হুমকিগুলো তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’, মানে ‘সবার আগে আমেরিকা’ নীতিরই অংশ। এর মাধ্যমে তিনি নিজের সমর্থকদের একধরনের অহংকারী মনোভাব এবং ভুয়া হুমকির ওপর ভিত্তি করে উসকে দিচ্ছেন। আর অজুহাত হিসেবে টানছেন আমেরিকার ‘উদারতা’র প্রসঙ্গ।

আমেরিকা ইতিমধ্যেই পৃথিবীর ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ক্ষেত্রে ‘প্রথম’ হয়ে আছে, এ কথা কি ট্রাম্প ভুলে গেছেন? বিশ্বের ১ নম্বর সাম্রাজ্যবাদী সুপারপাওয়ার নিজেকে শক্তিশালী দেখাতে চায় আবার অন্যের অন্যায় সিদ্ধান্তের শিকার হওয়ার অভিনয়ও করে।

১৯০২ সালে ওয়াশিংটনে পানামা খাল নিয়ে ব্যর্থ আলোচনা চলাকালে কলম্বিয়ান কূটনীতিক ড. জোসে ভিসেন্তে কনচা আমেরিকানদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘অন্যের অধিকারকে খুব সম্মান করে, এমন জাতি হিসেবে নিজেদেরকে জাহির করার খাতিরে এই ভদ্রলোকরা শিকারকে গিলে ফেলার আগে একটু খেলা করে। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা কোনোও না কোনোভাবে শিকারকে গিলে খাবেই’।

ট্রাম্প হয়তো সম্মান দেখানোর ভান করতেও আর রাজি নন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শিকার নিয়ে খেলার অভ্যাস কিন্তু এখনো যায়নি।

  • বেলেন ফার্নান্দেজ আল–জাজিরার কলাম লেখক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন