ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছেন, গাছ লাগানোর এই তো দারুণ সুযোগ

গাছ রোপণের দৃষ্টান্তমূলক কাজ হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। আমি তখনো মাধ্যমিকের গণ্ডি অতিক্রম করিনি। বড় ভাইয়ের বিয়ে হলো। বিয়েতে গেট ধরে যে টাকা পেয়েছিলাম, তা দিয়ে গাছ কিনে রোপণ করেছিলাম। সেই গাছ বড় হয়েছিল। ৩০ বছর পর এসে সেই চারা রোপণের আনন্দ বহুগুণ বেড়েছে।

আমাদের এক বন্ধুর মামার বিয়ের অনুষ্ঠানে একবার ভ্যানভর্তি করে চারা নিয়ে গেলাম বিয়ে খেতে। তার বছর দশেক পর একদিন ওই মামা বললেন, ‘তোমাদের দেওয়া গাছগুলো সব আছে। বড় হচ্ছে। লাগলে দুই-চারটা কাটি আনতে পারো।’

একইভাবে একবার বন্ধুর বিয়েতে অনেক চারা নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই সময়ে এটি তাঁর কাছে হাস্যরসাত্মক মনে হলেও এখন বলে, এটাই ছিল সেরা উপহার। কোনো উপহারের খবর নেই, কিন্তু গাছগুলো বড় হচ্ছেই।

যদি কারও বাড়িতে গাছ লাগানোর জমি থাকে, তাহলে তাকে গাছের চেয়ে বই ছাড়া আর কোনো উপহারই ভালো হতে পারে না। আমাদের উপহারের তালিকায় গাছ নেই। অথচ গাছ এমনই উপহার, যেটি প্রতিদিনের চেয়ে প্রতিদিন বড় হয়, বৈশিষ্ট্যভেদে ফল, ফুল দেয়। ছায়া তো দেবেই। ঔষধি গাছ হলে তারও মূল্য অনেক। পরিবেশের জন্য যে গাছ অমূল্য, সে কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কোনো কারণ ছাড়াই ভুলতে বসেছি।

গাছ রোপণের সবচেয়ে ভালো সময় বর্ষা মৌসুম। এবারের ঈদ চলতি বর্ষায় হলো। যাঁরা বাড়ি থকে দূরে গিয়ে চাকরি করেন, তাঁদের অধিকাংশই বাড়িতে ফিরেছেন। এই বাড়িতে ফেরা অর্থবহ করে তোলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে পারে বৃক্ষরোপণ। যাঁদের বাড়ি গ্রামে, তাঁদের কোনো না কোনো জায়গা আছে গাছ রোপণ করার। শতভাগের এই সুযোগ না থাকলেও অধিকাংশের তো আছে। তাঁরা বাড়ির ফাঁকা স্থানে গাছ লাগাতে পারেন।

আরও পড়ুন

গাছ যে কেবল নিজেদের বাড়িতে লাগাতে হবে, এমন কথা নেই। অন্যের বাড়িতে যাঁর জায়গা আছে, তাঁর বাড়িতে গাছ লাগানো দোষের নয়। সরকারি স্থানে এবং সড়কের দুই ধারেও চারা রোপণ করা যাবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিংবা সমন্বিত উদ্যোগে সরকারি স্থানে চারা রোপণ করলে সেটি জনকল্যাণমূলক হবে। কেউ যদি একবার এ রকম জনকল্যাণমূলক আনন্দ পান, তাহলে এমন কাজের সঙ্গে সারা জীবন থাকতে চাইবেন।

কী গাছ লাগাবেন, তারও একটি পরিকল্পনা থাকা চাই। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্র সঞ্জয় চৌধুরী লেখাপড়া শেষ করে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছেন। গ্রীন ইকো নামে তাঁর একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে কুড়িগ্রামের কয়েকটি উপজেলায় কয়েক হাজার সুপারির চারা রোপণ করেছেন। বলে রাখা ভালো, কুড়িগ্রাম অঞ্চলে সুপারির গাছ বড় অর্থকরী।

এ বছর তিনি ১০ হাজার কাঁঠালের চারা রোপণ করবেন। এই ১০ হাজার চারাই তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করবেন। যেসব প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হবে, সেখানে বৃক্ষবিষয়ক ১৫ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি দেখানো হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা যে গাছটি পাবে, তা যেন বড় করে তোলে। সঞ্জয় চৌধুরীর গাছ রোপণবিষয়ক দর্শন আছে। তাঁর কথা হলো, এমনভাবে গাছ লাগাতে হবে, যেন সারা বছর বাড়িতে কোনো না কোনো ফল থাকে। বাড়ির ফলেই মিটবে চাহিদা।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চার শতাধিক প্রজাতির যে সবুজ-শ্যামল ক্যাম্পাস, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ খুব সামান্য। বরং পরিবেশপ্রেমী ছাত্র–শিক্ষক, ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগেই সেটি হয়েছে।

কোভিডকালীন আমরা বোতলার পাড় নামক একটি গ্রামে বোতলারপাড় সুরক্ষা কমিটি গঠন করেছিলাম। বছর দুয়েক আগে ওই গ্রামের সব বাড়িতে একটি ভালো আম ও একটি পেয়ারার চারা দিয়েছি। এই গ্রামের সব বাড়িতে এখন গাছ দুটিতে ফল হচ্ছে। কয়েক বছর আগে লালমনিরহাটের একটি স্কুলের সব বাচ্চাকে পেয়ারার চারা দিয়েছিলাম। পরের বছরই ওই পেয়ারাগাছগুলোতে পেয়ারা ধরতে শুরু করেছে।

গাছ রোপণের দৃষ্টান্তমূলক কাজ হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৩৭ হাজার গাছ নিয়েছিলাম। ২০১৩ সাল থেকে আমরা এই কাজ শুরু করি। আমাদের এই কাজে কয়েকজন শিক্ষার্থীও ছিল। উদ্যোগে শাহা ফরিদের নাম উল্লেখযোগ্য। যাঁরা বৃক্ষ, সার ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছেন, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কৃতজ্ঞতা স্মারক প্রদান করা হয়। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চার শতাধিক প্রজাতির যে সবুজ-শ্যামল ক্যাম্পাস, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে সামান্যই সবুজ হয়েছে ক্যাম্পাস। এ ছাড়া অনেকেই ক্যাম্পাসে গাছ রোপণ করেছেন।

গাছ রোপণ করলেই কাজ শেষ হয় না। এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত সবার চোখের সামনেই আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুর খোকসাঘাঘট নদীর তীরে পরপর দুই বছর গাছ রোপণ করেছে। একটি গাছও নেই। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা প্রায় ১০ লাখ গাছ এক দিনে রোপণ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। ৫-৭ বছর পর এসে তাঁর ১০০ গাছও আছে কি না, সন্দেহ। অন্তত আমি যেসব চারা রোপণ করতে দেখেছি, তার একটিও নেই। বিশাল অনুষ্ঠান করে সেই কর্মসূচি পালন করা হয়।

গাছ রোপণ করলেই কাজ শেষ হয় না। এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত সবার চোখের সামনেই আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুর খোকসাঘাঘট নদীর তীরে পরপর দুই বছর গাছ রোপণ করেছে। একটি গাছও নেই। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা প্রায় ১০ লাখ গাছ এক দিনে রোপণ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। ৫-৭ বছর পর এসে তাঁর ১০০ গাছও আছে কি না, সন্দেহ। অন্তত আমি যেসব চারা রোপণ করতে দেখেছি, তার একটিও নেই। বিশাল অনুষ্ঠান করে সেই কর্মসূচি পালন করা হয়।

বিভাগীয় কমিশনার থেকে শুরু করে বিভাগ, জেলা, উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘ সময়-শ্রম দিয়ে গাছ রোপণ করা হয়েছিল। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ একেবারেই হয়নি। ফলে ওই ইউএনওর আগ্রহ থাকলেও গাছগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

প্রকৃতিবিষয়ক লেখক ও গবেষক মোকারম হোসেন তরুপল্লবের সাধারণ সম্পাদক। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্লভ গাছ সংগ্রহ করে দেওয়ার প্রধান ব্যক্তি। তিনি সব সময়ই বলেন ‘গাছ লাগাই , গাছ বাঁচাই।’ এই স্লোগান ধারণ করেই গাছ রোপণ করা প্রয়োজন। গাছ লাগালেই দায়িত্ব শেষ হয় না। গাছ বাঁচিয়ে রাখাও নিশ্চিত করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে ক্ষেত্রবিশেষে দুই বছর পানি দিতে হয়। গাছে ওঠা লতাপাতা পরিষ্কার করতে হয়। শুকনা গোবর সার গাছের জন্য খুব উপকারী। রোপণের সময় বেশি পরিমাণ গোবর সার দিতে পারলে ভালো হয়।

আরও পড়ুন

সরকারি স্থানে দুর্লভ গাছ লাগানো বেশি ভালো। জমির পরিমাণ ভেদে ছোট ঔষধি বাগানও থাকতে পারে। বাড়িতে সারা বছর ফল থাকবে, এমন কয়েকটি গাছ লাগানো ভালো। সড়কের পাশে সৌন্দর্য এবং ছায়া দেবে, এমন গাছ লাগাতে হবে। সড়ক প্রশস্তকরণের কারণে দেশে পুরোনো গাছ উজাড় হয়েছে। মনে রাখতে হবে, অনেক পাখি এবং অনেক ছোট ছোট প্রাণীও ফল খেয়ে বেঁচে থাকে। ফলে পাখিদের খাওয়ার জন্য গাছও লাগাতে হবে। সরকারি উদ্যোগে দেশের সব উপজেলায় একটি করে বাগান থাকা প্রয়োজন, যেখানে সব জাতের ন্যূনতম দুটি করে গাছ থাকবে।

বলতে গেলে আমাদের গোটা দেশটাই ছিল বনভূমি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বন উজাড় করে বসতি করেছি, ফসলি জমি করেছি। সেই জনগণকেই বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের বৃক্ষরোপণ করতে হবে। ঈদের ছুটিতে সেই কাজের শুভ সূচনা হতে পারে। আর যাঁরা বৃক্ষরোপণের কাজে নিয়োজিত তাঁদের প্রতি ভালোবাসা। ঈদ হোক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির অনন্য দৃষ্টান্ত। বৃক্ষরোপণ একই সঙ্গে নিজের এবং দেশের কাজ।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক