দীর্ঘদিন ধরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে একসঙ্গে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের দাবি চলে আসছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে আসছে। তবে রাষ্ট্রপতির সেই ডাকে তখন সাড়া দেয়নি শীর্ষ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের সাড়া না দেওয়ার কারণে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ‘গুচ্ছ বা একক’ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন অনেকটা অধরা থেকে যায়।
তবে গত ১৫ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক প্রজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলরের অভিপ্রায় অনুযায়ী, বিগত সময়ে যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় যুক্ত ছিল, তাদের অংশগ্রহণে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করার এবং ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে একক ভর্তি পরীক্ষার আওতায় নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) দায়িত্ব দেওয়া হলো।
এই প্রজ্ঞাপন জারির পর বস্তুত যেসব বিশ্ববিদ্যালয় এবার গুচ্ছে আসতে টালবাহানা শুরু করেছিল, তারা শেষ পর্যন্ত মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ মানতে গুচ্ছে অংশ নিয়েছে। একই সঙ্গে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে ইউজিসি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল বলে সংবাদমাধ্যমে খবরও এসেছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা প্রায় শেষের দিকে। এরই মধ্যে আগামী এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ১৭ আগস্ট থেকে শুরু হবে বলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঘোষণা করেছে। ঘোষিত রুটিনে বলা হচ্ছে তত্ত্বীয় পরীক্ষা চলবে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আর ব্যবহারিক শেষ হবে ৪ অক্টোবরের মধ্যে। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, পরীক্ষার কয়েক মাস পর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বসছেন।
তবে এইচএসসি পরীক্ষা ঘনিয়ে এলে, ইউজিসির কাঁধে পড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে ‘একক ভর্তি’ পরীক্ষার আয়োজনের পদ্ধতি কেমন হবে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা বা বিজ্ঞপ্তি এখনো পত্রপত্রিকায় আসেনি। ধারণা করছি, বিষয়টি নিয়ে ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কাজ করছে। তবে এইচএসসি পরীক্ষার শুরুর আগেই শিক্ষার্থীদের পরবর্তী ভর্তি পরীক্ষার মেথডোলজি জানাতে না পারলে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন নিয়ে একধরনের আলোচনা-সমালোচনা শুরু হতে পারে।
যদিও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের দিকনির্দেশনা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয়। তবে যেহেতু এবার নতুন আঙ্গিকে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হবে, সেহেতু এই বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা এমনকি একধরনের প্রচারণা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির পক্ষ থেকে থাকা উচিত। যাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক, এমনকি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা নিতে পারে।
তবে গত ২৯ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সংবাদমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তিনি ভবিষ্যতে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন নিয়ে একধরনের সংশয় প্রকাশ করেছেন। উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু বলেছেন, ‘এবার মহামান্য রাষ্ট্রপতি অভিপ্রায় করেছেন, “একক” পদ্ধতিতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। একক পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হলে তখন সেটি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী চলে। ভর্তিবিষয়ক যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র একাডেমিক কাউন্সিলের। একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করবে। যদি একক ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়ন করা না হয়, অবশ্যই আমরা চেষ্টা করব বিভাগীয় পর্যায়ে পরীক্ষা নিতে। এটা আমরা এখন থেকেই চিন্তাভাবনা করছি।’ (মে ২৯, প্রথম আলো)।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একক ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন কেবল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য। এমন কোনো কিছু নীতিমালায় থাকা উচিত নয়, যা নিয়ে এই ভালো উদ্যোগটা নষ্ট হয়ে যায়। দেশে কয়েক দশক ধরে এ ধরনের পরীক্ষা মেডিকেল কলেজগুলো আয়োজন করে আসছে। এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমরা একক ভর্তি পরীক্ষায় কাজে লাগাতে পারি।
আমার বিশ্বাস মাননীয় উপাচার্য শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমাতে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না। তবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তিনি ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারটি একাডেমিক কাউন্সিলের কাঁধে তুলে দিয়েছেন। তাঁর কথায় দ্বিমত পোষণ করছি না, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাদেশের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের যেকোনো পরামর্শ ও আদেশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানতে বাধ্য—এমনটা ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের প্রধান চার বিশ্ববিদ্যালয় যে আইনে পরিচালিত হয়, সেই ১৯৭৩ অ্যাক্টের ১০ ধারায় ২ উপধারায় সেটাই বলা আছে।
হ্যাঁ, এ কথা সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য ৭৩-এর অধ্যাদেশের ভর্তি পরীক্ষার ধরন সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। ওই অধ্যাদেশের ৪৬ ধারা (১) বলা হয়েছে, কলা, ব্যবসায় প্রশাসন, বিজ্ঞান ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য একাডেমিক কাউন্সিল একটি ভর্তি কমিটি গঠন করবে। তবে কীভাবে ভর্তি পরীক্ষার শর্তারোপ করা হবে, তা ওই ধারায় ৩ উপধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে ইনিয়ে-বিনিয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বরং তাঁদের উচিত হবে দেশের যুগান্তকারী এই সিদ্ধান্তের পক্ষে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে একক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করা। ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গুচ্ছের যে আয়োজন চলছিল, যে সংকট তৈরি হয়েছিল, সেসব সংকট মোকাবিলা করে আসন্ন একক ভর্তি পরীক্ষায় সব ধরনের জটিলতা পরিহার করার দিকনির্দেশনা তৈরি করে যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করা।
যদিও ইউজিসি বলছে তারা ‘ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ) ’ অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একক ভর্তি পরীক্ষার সুপারিশ করবে। তবে কীভাবে এই ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি নির্ণয় হবে, তার ব্যাখ্যা আমরা এখনো জানি না। এরই মধ্যে ২০১৭ সালের দিকে ভারতে চালু হওয়া ‘ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি’ তৈরি করে জয়েন্ট ইনট্যান্স এক্সামিনেশন বা জেইই, ন্যাশনাল এলিজিবিলিট টেস্ট বা এনইটিসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করে আসছে। বাংলাদেশ যদি নিজেদের মস্তিষ্ক না কাজে লাগিয়ে কেবল ভারতে আদলে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের কৌশল অনুসরণ করে, তাহলে সেটি মোটেই প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করি না। বাংলাদেশের উচিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বাস্তবমুখী নীতিমালায় হাত দেওয়া। যাতে এই নীতিমালা সব মহলে গৃহীত হয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একক ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন কেবল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য। এমন কোনো কিছু নীতিমালায় থাকা উচিত নয়, যা নিয়ে এই ভালো উদ্যোগটা নষ্ট হয়ে যায়। দেশে কয়েক দশক ধরে এ ধরনের পরীক্ষা মেডিকেল কলেজগুলো আয়োজন করে আসছে। এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমরা একক ভর্তি পরীক্ষায় কাজে লাগাতে পারি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো তৎপর না হলেও তাঁদের এই একক ভর্তি পরীক্ষার কাতারে আনা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলতে পারে।
আমরা চাই একক ভর্তি পরীক্ষার সঠিক বাস্তবায়ন। সময় নেই, এমন অজুহাতে লেজেগোবরের নীতিমালা যেন না হয়, সেদিকে নজর দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় ‘বাণিজ্যিকীকরণে’ মনোভাব যেন না তৈরি হয়, সেটি আমাদের অবশ্যই কাম্য থাকবে। এমন উদ্ভট নীতিমালা যেন না তৈরি হয়, যার কারণে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিশ্বাস করি, শিগগিরই একটি নির্ভুল, যুগোপযোগী, শিক্ষার্থী-অভিভাবকবান্ধব ভর্তিকাঠামোর সুপারিশমালা দেখতে পাব।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: nadim. ru@gmail. com