মাননীয় মন্ত্রী, কত ডলার ফিরল দেশে

‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,

অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!

মানুষের অধিকারে

বঞ্চিত করেছ যারে,

সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,

অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’

আমরা গরিবদের ঘৃণা করি। লুঙ্গি পরা লোকদের সিনেমা হলে ঢুকতে দিই না। বিমানবন্দরে আমাদের শ্রমিকেরা একই রঙের টি–শার্ট পরে একজনের গায়ে লেগে আরেকজন যখন চলেন, দল বেঁধে, মনে হয় যেন গড্ডলিকাপ্রবাহ। তাঁরা নিয়মকানুন জানেন না, ইমিগ্রেশনের ফরম পূরণ করতে পারেন না, এর কাছে ছুটে যান, ওর কাছে ধরনা দেন। (সুখবর হলো, বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের আর যাওয়ার সময় ফরম পূরণ করতে হয় না।) তাঁরা কমোড ব্যবহার করেননি এর আগে, এয়ারপোর্টের এথিকস জানেন না। তাঁরা সদ্য বিবাহিত বধূ, চোখে ছানিপড়া বাবা, আঁচলে ধোঁয়ার গন্ধ আর মায়াজড়ানো মা, আদরের ভাইবোনদের ছেড়ে অজানার উদ্দেশে বের হন। মরুভূমির দেশে আউটডোরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন, কষ্টার্জিত পাওনার কিছু পান, কিছু–বা পান না। তাঁরা জেলে যান, কোটরে বন্দী থাকেন, নির্যাতিত হন।

কিন্তু এই দেশের রেমিট্যান্সের তাঁরাই বীর। দেশটা যে এখনো চলছে, তার কারণ তাঁদের পাঠানো ডলার। করোনার মধ্যে তাঁরা বিপুল ডলার পাঠিয়েছেন। বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় হুন্ডি কমে গিয়েছিল আর প্রবাসেও টাকা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছিল। তার চেয়ে বড় কথা, তাঁরা দেশের স্বজনদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে চেয়েছিলেন। করোনার পর সেই ডলার আসার হার গেছে কমে। তার ফলে বাজারে ডলারের সংকট। তাতে
ব্যাংকের চেয়ে বাইরে ডলারের দাম পাওয়া যায় বেশি। ফলে তা আবারও হুন্ডি করে টাকা পাঠানোকে উৎসাহিত করছে। এটা অচ্ছেদ্য চক্র। ব্যাংকের চেয়ে বাইরে দাম বেশি বলে বৈধ চ্যানেলে ডলার আসছে কম। আর বৈধ চ্যানেলে ডলার কম আসছে বলে বাইরে ডলারের দাম বেশি পাওয়া যাচ্ছে। একবার এই চক্র ভেঙে দিতে পারলেই ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে। যদি ব্যাংক আর বাইরের বাজারে ডলারের দামের পার্থক্য কমে আসে, তাহলেই হবে।

তো আমাদের রেমিট্যান্স আনেন গরিব মানুষেরা। শ্রমিকেরা। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিক। মালয়েশিয়ার শ্রমিক। আর দেশ থেকে ডলার বিদেশে পাচার করেন বড়লোকেরা, মধ্যবিত্তরা, শিক্ষিতরা। কানাডায় যাঁরা গেছেন, তাঁরা পেশাজীবী, শিক্ষিত। তাঁরা সেখানে যান, গিয়ে সাধারণত সরকারের ওয়েলফেয়ার খান আর বাড়ি–গাড়ি করার জন্য দেশের জমিজমা, ফ্ল্যাট বিক্রি করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কানাডায় নিয়ে যান। গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি থেকে যে প্লটের মালিকেরা কানাডায় বা অস্ট্রেলিয়ায় গেছেন, তাঁদের অনেকেই ডলার পাচার করেছেন। তাঁদের আয় বৈধ, টাকা পাচার অবৈধ। কিন্তু যাঁরা দেশে অবৈধ আয় করেন, সরকারি চাকরি করে কোটি কোটি টাকা ঘুষ খেয়েছেন; ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন এবং সেই টাকা শোধ করেননি, চোরাকারবারি করেছেন, মাদকের ব্যবসা করেছেন, শেয়ারবাজারের টাকা লুট করেছেন, ফাটকা ব্যবসা করে গরিব মানুষের পকেট কেটে টাকা করেছেন, বিদেশে লোক পাচার করে টাকা করেছেন, জমি দখল করেছেন, চাঁদাবাজি করেছেন, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই করেছেন, তদবির–বাণিজ্য করেছেন, সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করে শতকোটি টাকা লুট করেছেন, তাঁদের টাকা তাঁরা দেশে রাখতে পারেন না। তাঁদের একমাত্র কাজ হলো বিদেশে টাকা পাচার করা। কানাডার বেগমপাড়া তাঁরাই বানিয়েছেন। দুবাই–সিঙ্গাপুরে তাঁরাই আবাস গেড়েছেন। ম্যানহাটানে তাঁরাই ফ্ল্যাট কিনে থাকেন।

বিদেশে টাকা পাচারে বাংলাদেশ শীর্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) ২০২০ সালে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়।

অর্থমন্ত্রী সেই টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা রাখলেন বাজেটে? মাননীয় মন্ত্রী, কত ডলার ফিরল দেশে?

এবার তাহলে এই বাংলাদেশ, হে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, তুমি গরিবদের সালাম করো, পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি করো। তাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাকা ঘোরান, ফসল ফলান, রেমিট্যান্স আনেন। তাঁরা অল্প মজুরির পোশাকশ্রমিক—আমাদের অর্থনীতি চাঙা রাখেন। আর আমরা তাঁদের শোষণ করি, পায়ে দলি, পশুর দলে নামিয়ে দিই।

রবীন্দ্রনাথের কথা শুনতে কি পাচ্ছি?

‘দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে,

অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।

সবারে না যদি ডাক’,

এখনো সরিয়া থাক’,

আপনারে বেঁধে রাখ’ চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান—

মৃত্যুমাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান।’

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক