ভর্তি পরীক্ষা শেষে প্রশ্নপত্র দেখছেন দুই পরীক্ষার্থী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য এখন বহুনির্বাচনী প্রশ্নের (এমসিকিউ) পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষাও দিতে হয়। এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো এভাবে পরীক্ষা হচ্ছে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকেই আপত্তি করা হচ্ছিল, কেবল এমসিকিউ প্রশ্নের মাধ্যমে যথাযথ মেধা যাচাই হচ্ছে না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে লিখিত পরীক্ষাও যোগ করা হয়। কিন্তু এই এমসিকিউ ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন কতটুকু মেধা যাচাইয়ের উপযোগী হচ্ছে, তা এবারের বাংলা প্রশ্ন দিয়ে যাচাই করা যাক।

গত বছর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে; এ বছর হয়েছে চারটি ইউনিটে। প্রতিটি ইউনিটেই বাংলা প্রশ্ন আছে; এমনকি চ ইউনিটের সাধারণ জ্ঞানের ৪০টি প্রশ্নের মধ্যে ১৩টি বাংলা বিষয় থেকে করা। চার ইউনিটে মোট ৫৫টি বাংলা বহুনির্বাচনী প্রশ্ন আছে। এসব প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে বোঝা কঠিন, এগুলো দিয়ে আসলে পরীক্ষার্থীর কোন দক্ষতা যাচাই করা হয়।

বহুনির্বাচনী প্রশ্নগুলোর উত্তর এক শব্দে না হয়ে একটু দীর্ঘ ও ব্যাখ্যামূলক হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, গতানুগতিক ধারার প্রশ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা করা সম্ভব না হলে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি করে কোচিং ও গাইডমুখী হবে

প্রশ্ন বিশ্লেষণের আগে আমাদের বোঝা দরকার, বিভিন্ন অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় ‘বাংলা’ থাকে কেন। বাংলা প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষার্থীর সাহিত্যজ্ঞান যাচাই করার কথা নয়। কোনো বিষয়ে ভর্তির পর পড়ালেখা, গবেষণাসহ অন্যান্য ভাষিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তাকে বাংলা ব্যবহার করতে হয়। সুতরাং ভর্তি পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নে শিক্ষার্থীর ভাষাদক্ষতা যাচাইয়ের কাজটিই প্রধান হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

এ বছরও সাহিত্য থেকে অনেক প্রশ্ন এসেছে। এসব প্রশ্নের বেশির ভাগই এমন, যা কেবল মুখস্থ থাকলে পারা যায়। যেমন একটি গল্প বা প্রবন্ধ প্রথম কবে কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, কবিতার কোন লাইনের আগের বা পরের লাইন কোনটি, গদ্যের তুলে দেওয়া অর্ধেক লাইনের অসমাপ্ত অংশে কী হবে—এ রকম প্রশ্ন আছে অন্তত ৫টি। কে, কী, কার, কোথায়—এ–জাতীয় প্রশ্ন দিয়ে সাধারণত স্মৃতিশক্তি যাচাই করা হয়; সে রকম প্রশ্ন আছে ৪টি। তা ছাড়া শব্দ ও চরিত্রের আলংকারিক তুলনা নিয়ে প্রশ্ন হয়েছে আরও ৪টি।

ব্যাকরণের প্রশ্নগুলোও ভাষাদক্ষতা যাচাইয়ের উপযোগী হয়নি। তিনটি ইউনিটের বাংলা প্রশ্নে শব্দের উৎসগত পরিচয় জানতে চাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ একটি শব্দ দিয়ে বলা হয়েছে, সেটি কোন ভাষা থেকে এসেছে? শব্দের উৎসগত পরিচয় পুরোপুরি প্রামাণ্য নয়।

তা ছাড়া একই ভাষাগোষ্ঠীর অসংখ্য শব্দে মিল বা সাদৃশ্য থাকা স্বাভাবিক। সুতরাং প্রায়ই অনুমাননির্ভর এ ধরনের প্রশ্ন না থাকাই ভালো। আবার ইংরেজি শব্দের বাংলা পরিভাষা কী হবে, এমন প্রশ্ন আছে তিনটি ইউনিটে। পরিভাষা সব সময় সুনির্দিষ্ট হয়, সুতরাং মুখস্থ ছাড়া এগুলো পারা কঠিন। বিভিন্ন বিষয়ের হাজার হাজার পরিভাষা আছে; এগুলো মুখস্থ করার জন্য আমরা পরীক্ষার্থীকে উৎসাহিত করতে পারি না। এবার প্রচুর ব্যাকরণের প্রশ্ন আছে বটে, কিন্তু সেগুলো গতানুগতিক ধারার। ফলে ভর্তি গাইড পড়ে বা কোচিং করে সেগুলোর উত্তর করা সম্ভব। সমাস, উপসর্গ, প্রত্যয় বাংলা শব্দ গঠনের প্রধান উপায়। এখান থেকে প্রশ্ন করতে পারলে পরীক্ষার্থীর শব্দ গঠনক্ষমতা যাচাই করা যায়। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার ব্যাকরণ প্রশ্নের বেশির ভাগই হয়েছে ভাষিক পরিচয় জানতে চেয়ে।

লিখিত প্রশ্ন নিয়েও খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যায় না। ক ইউনিটের একটি লিখিত প্রশ্নে পাঁচটি শব্দ দিয়ে বাক্য রচনা করতে বলা হয়েছে। আরেকটি প্রশ্নে ‘প্লাস্টিক দূষণ’ বিষয়ে পাঁচ বাক্যের অনুচ্ছেদ লিখতে দেওয়া হয়েছে। এ দুটি প্রশ্ন এমন, যেখানে বাক্য লিখতে পারলেই পরীক্ষককে নম্বর দিতে হবে—এখানে বাক্যের ভালো-মন্দ বিচারের সুযোগ নেই।

আবার খ ইউনিটের একটি প্রশ্নে কিছু অংশ উদ্ধৃত করে যেসব প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মূল্যায়ন পরীক্ষকভেদে মোটেও এক রকম হবে না। ফলে একই মানের খাতার মধ্যে প্রাপ্ত নম্বরের পার্থক্য ঘটে যাবে। যেখানে ১ নম্বরের ব্যবধানে শত শত পরীক্ষার্থী অবস্থান করে, সেখানে এ ধরনের প্রশ্ন শিক্ষার্থীকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এদিক থেকে গ ইউনিটের বাংলা থেকে ইংরেজি এবং ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষান্তরের প্রশ্ন ভালো।  

ক ও খ ইউনিটের লিখিত প্রশ্নে ভাবসম্প্রসারণ ও সারমর্ম আছে। প্রচলিত ব্যাকরণ বই থেকে তুলে দেওয়া এসব ভাবসম্প্রসারণ ও সারমর্ম দিয়ে পরীক্ষার্থীর বোধগম্যতা কিংবা ভাষাদক্ষতা যাচাই করা সম্ভব নয়। এর বিপরীতে কোনো একটি আলোচনা বা বক্তব্য তুলে দিয়ে সেটির সারসংক্ষেপ লিখতে দেওয়া যায়। আবার সেই আলোচনা বা বক্তব্যের কোনো একটি বাক্যকে ব্যাখ্যা করে দীর্ঘ করতে দেওয়া যায়। আর বানান ও বাক্যশুদ্ধির জন্য খ ও গ ইউনিটে বিচ্ছিন্ন কিছু বাক্য দেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে একটি গদ্যাংশ উপস্থাপন করে সেটির ভাষা-সম্পাদনার কাজ দেওয়া যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য অনুকরণীয় হয়। এমনকি বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায়ও প্রশ্নের এই ধরন অনুসরণ করা হয়। তাই প্রশ্নের কাঠামো নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার।

বহুনির্বাচনী প্রশ্নগুলোর উত্তর এক শব্দে না হয়ে একটু দীর্ঘ ও ব্যাখ্যামূলক হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, গতানুগতিক ধারার প্রশ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা করা সম্ভব না হলে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি করে কোচিং ও গাইডমুখী হবে। এমনকি তাদের সব প্রবণতা গিয়ে ঠেকবে মুখস্থ করার দিকে। আর প্রচলিত ধারার প্রশ্নেই যদি মেধা যাচাই করা হবে, তবে আলাদা করে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কারণ কী থাকতে পারে?

  • তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক