বিএনপির নেতা-কর্মীরা কি একসঙ্গে বসে খেতে পারবেন না?

রাজধানীর বনানী ক্লাবে খেতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপির ৫৩ নেতা-কর্মী। গত জাতীয় নির্বাচনে মুন্সিগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মমিন আলীর আমন্ত্রণে তাঁরা ক্লাবটিতে গিয়েছিলেন। বনানী থানা ও ডিবি পুলিশ গিয়ে সবাইকে আটক করে নিয়ে যায়। পুলিশের ভাষ্য হলো, বিএনপির নেতা-কর্মীরা ক্লাবে বসে গোপনে রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনা করছিলেন। সে কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের আদালতে হাজির করা হলে একজন বাদে সবাইকে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।

আওয়ামী লীগ বেশ ভালোভাবে জানে বিএনপিকে আবার সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দিলে তারা রাজপথে বড় শক্তি প্রদর্শন করতে পারবে। বিএনপি রাজপথে একবার দাঁড়াতে পারলে জনগণের একটা বিরাট অংশের সমর্থন তাদের ওপর থাকবে। একটানা একদলের শাসন এবং মূল্যস্ফীতি, ঘুষ–দুর্নীতির কারণে জনগণের একটি বিশাল অংশের মধ্যেই সরকারবিরোধী মনোভাব রয়েছে। ফলে রাজপথে যাতে বিএনপি সংগঠিত হতে না পারে, সেটা যেকোনো মূল্যেই ঠেকাতে চাইবে আওয়ামী লীগ।

এ ঘটনায় প্রথম যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো বিএনপি কি একটি গোপন সংগঠন যে তাদের নেতা–কর্মীরা কোথাও একসঙ্গে হতে পারবেন না? কিংবা একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া ও আলাপ-আলোচনা করতে পারবেন না? ধরা যাক, তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে কীভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করা যায়, তা নিয়েই হয়তো আলাপ করছিলেন। তাঁদের সেই আলাপ কি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র বা পরিকল্পনা বলা হবে। তাহলে কি সরকারবিরোধিতা মানেই কি রাষ্ট্রবিরোধিতা?

এ প্রশ্ন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীরতর অসুখের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে যে ব্যাধি থেকে কোনো ক্ষমতাসীন দলই মুক্ত হতে পারেনি। অথচ সবাইই মুখে গণতন্ত্রের তুবড়ি ছোটান আর কাজে বিরোধী দল আর মত দমনকেই প্রধানতম রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বেছে নেন। এ প্রেক্ষাপট থেকেই বনানী ক্লাবে খেতে যাওয়া বিএনপির নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপির নেতা–কর্মীদের প্রতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কৌশল কী হতে চলেছে, তার একটা সম্ভাব্য সূত্র মিলবে।    

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি ঘরোয়া আলোচনা, মানববন্ধন, প্রেস কনফারেন্স, প্রেস বিবৃতি দেওয়া ছাড়া বড় কোনো সভা-সমাবেশ করতে দেখা যাচ্ছিল না। এর ফলে বেশ জোরেশোরে যে প্রশ্নটি উঠেছিল, সাংগঠনিক দিক থেকে বিএনপি কি সক্ষমতা হারিয়েছে? অবশ্য বিএনপির নেতা–কর্মীদের দাঁড়াতে না পারার যৌক্তিক কারণও ছিল। সভা-সমাবেশের মাধ্যমে রাজপথে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেই পুলিশ অথবা ছাত্রলীগ, যুবলীগ তাদের ওপর মারমুখী হয়েছে। বেশির ভাগ নেতা-কর্মীদের নামে একাধিক মামলা থাকায় তাঁরা ঝুঁকিও নিতে চাননি।

কিন্তু গত বছরের অক্টোবর–নভেম্বর মাসে পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। মানবাধিকার পরিস্থিতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এ সব ইস্যু নিয়ে পশ্চিমাদের চাপের মুখে সরাসরি বলপ্রয়োগের কৌশল থেকে সরে আসে সরকার। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপি বিভাগীয় সম্মেলনগুলো দলটির নেতা–কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা তৈরি করে। প্রতিটি বিভাগীয় সমাবেশের আগে সরকারি শ্রমিক সংগঠনগুলোর পরিবহন ধর্মঘট ডেকে বাস বন্ধ করে দেওয়ার পরও সেগুলোতে ব্যাপক জনসমাগম লক্ষ করা যায়। শুধু বিএনপির কর্মী সমর্থক নয়, রাজনীতি নিয়ে আশাহীন হয়ে পড়া জনগণের মধ্যেও রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। আওয়ামী লীগও বাধ্য হয় পাল্টা জনসমাবেশ করে নিজেদের শক্তি জানান দেয়।

রাজনীতির এই আপাতস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে আবার ফিকে হয়ে যায়। রাজনীতি শক্তি প্রদর্শন আর দমন-পীড়নের সেই পুরোনো চেনা রূপে ফিরে আসে। সমাবেশস্থল নিয়ে টানাপোড়েনের মুখে ৭ ডিসেম্বর থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকেন নেতা–কর্মীরা। শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশ থেকে নেতা–কর্মী এসে রাজধানীর কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ নয়াপল্টনে অবস্থান নিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু করে কিনা। বিএনপির দু-একজন নেতার বাগাড়ম্বর সেই ধারণাকে আরও উৎকে দেয়। ফলে আপাতছাড় দেওয়া ক্ষমতাসীনেরা সেই শঙ্কাকে অঙ্কুরে উপড়ে ফেলার কৌশল নেয়। নয়াপল্টনে অভিযানে নামে বিপুলসংখ্যক পুলিশ। চূড়ান্ত বলপ্রয়োগ করে বিএনপির নেতা–কর্মীদের হটিয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবরুদ্ধ করে ফেলে।

সারা দেশ ও ঢাকায় আন্দোলনের দুই কেন্দ্রীয় সংগঠক মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করে। সমাবেশ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। কিন্তু আগের দিন বিকেলে সমাবেশের মাঠ পেয়েও পরদিন সফল সমাবেশ করে বিএনপি তাদের সাংগঠনিক শক্তি বেশ জোরালোভাবেই জানান দিতে সক্ষম হয়।

১০ ডিসেম্বরের পর বিএনপি আবার তৃণমূল পর্যায় থেকে সংগঠন গুছিয়ে নেওয়ার কৌশল নিয়েছে। বিএনপি রক্ষণাত্মক অবস্থানে গেলেও দলটি যে সাংগঠনিকভাবে হারিয়ে যায়নি সেই বার্তাটা দিয়েছে। এই বার্তাটা কর্মী–সমর্থকেরা যেমন পেয়েছেন, আবার ক্ষমতাসীনেরাও পেয়েছেন। অভিজ্ঞতা বলে, নির্বাচনের আগে রাজপথের নিয়ন্ত্রণ যারা নিতে পারে, ভোটের সমীকরণে তারাই এগিয়ে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপিকে ঠেকাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোন কৌশলে এগোবে?

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগ বেশ ভালোভাবে জানে বিএনপিকে আবার সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দিলে তারা রাজপথে বড় শক্তি প্রদর্শন করতে পারবে। বিএনপি রাজপথে একবার দাঁড়াতে পারলে জনগণের একটা বিরাট অংশের সমর্থন তাদের ওপর থাকবে। একটানা একদলের শাসন এবং মূল্যস্ফীতি, ঘুষ–দুর্নীতির কারণে জনগণের একটি বিশাল অংশের মধ্যেই সরকারবিরোধী মনোভাব রয়েছে। ফলে রাজপথে যাতে বিএনপি সংগঠিত হতে না পারে, সেটা যেকোনো মূল্যেই ঠেকাতে চাইবে আওয়ামী লীগ।

আবার নির্বাচনের আগে বলপ্রয়োগ, দমন–পীড়ন হলে সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন, সভা–সমাবেশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের ওপর পশ্চিমাদের চাপ বাড়বে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমনিতেই বিশ্বে মেরুকরণ সুস্পষ্ট। এই উভয়সংকটের মধ্যে তাহলে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে কৌশলী পথ কী হবে?

সম্ভাব্য কৌশল হলো, বেছে বেছে বিএনপির সংগঠকদের নামে মামলা দেওয়া ও তাঁদের গ্রেপ্তার করা। বনানী ক্লাব থেকে বিএনপির যেসব নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা সবাই মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান ও শ্রীনগরের উপজেলা নেতা-কর্মী। এর মধ্যে শ্রীনগর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মমিন আলী, শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন এবং সিরাজদিখান উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন রয়েছেন।

বনানী ক্লাবে খেতে যাওয়া নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার একটা ড্রেস রিহার্সাল। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই এ ধরনের ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী’ মামলা ও গ্রেপ্তার নিশ্চিতভাবেই বাড়বে।

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী