সংকটময় জটিলতর বৈশ্বিক ক্ষণে এখন চলছে পুঁজিবাদের পুনর্মূল্যায়ন। চলছে মার্ক্স-পুনর্মূল্যায়ন, মার্ক্স-পুনর্ভাবনা। অক্টোবর বিপ্লব ১৯১৭ সালে মার্ক্সীয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা লেনিনের রাশিয়ায় আর পূর্ব ইউরোপে বিস্তৃত হয়। মাও সে-তুংয়ের লংমার্চ তৈরি করেছিল সমাজতান্ত্রিক গণচীন। বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে কেন তা লাল পুঁজিবাদের জয়ঢঙ্কা বাজাল? এক চিমটি গণতন্ত্র, এক চিমটি সমাজতন্ত্রও যেন অধরা হয়ে গেল উন্নয়নশীল দেশে দেশে।
সে প্রশ্ন তাড়িত করেছে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতির শিক্ষক প্রফেসর ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই অর্থনীতিবিদের সদ্য প্রথম বাংলায় লেখা গ্রন্থকণিকা ‘উন্নয়নশীল দেশের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র একটি রূপরেখা’ একুশের বইমেলা থেকে কিনেছি। স্যারের গুণমুগ্ধ আরেক অগ্রজ শামসুদ্দিন পেয়ারা ভাইকেও এক কপি দিয়েছি। আমরা দুজনই রাত জেগে পড়েছি। আর স্যারের অসাধারণ বিশ্লেষণ, নব্য-উদারীকরণপরবর্তী সমাজতন্ত্র নিয়ে তার মূল্যায়ন সত্যি অনন্য। তাঁর কথায়: ‘সমসাময়িক উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির সমন্বয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি রূপরেখা তৈরি করা যায় কি না, তা নিয়ে কিছু চিন্তাভাবনাই এই বইয়ের উদ্দেশ্য।’
১৯৫০-এর দশকে সদ্য স্বাধীন কিছু উন্নয়নশীল দেশ সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার আদলে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের চেষ্টা করে কিছুটা সফলও হয়, তবে ব্যর্থতাও ছিল ঢের। এরপর আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাজারভিত্তিক উদারীকরণ আর মুক্তবাণিজ্যের ঢঙ্কা বাজিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং গরিবি হটানোর নীতি এসব দেশে অনুসরণ করতে দেখা যায়।
স্যার নিজেই একে পূর্ণদৈর্ঘ্য বই বলা যাবে না বলে যতি টেনেছেন। ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ আছে কি নেই, সেই সংশয়ের সীমানা পেরিয়ে অধ্যাপক ড. মাহমুদ বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অসুখকর অভিজ্ঞতার বিপরীতে চীন-ভিয়েতনামের ‘লাল পুঁজিবাদের’ জয়জয়কারের সুলুক সন্ধান করেছেন। কল্যাণ রাষ্ট্র কিংবা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সফল উদাহরণের তালাশে নেমেছেন।
ড. মাহমুদের সবিনয় প্রতিক্রিয়া হলো: বাংলাদেশসহ নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশের শাসনতন্ত্রে বা রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে যখন গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে, তখন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সফল না হোক অন্তত ব্যর্থ উদাহরণগুলো খতিয়ে দেখতেই-বা অসুবিধা কোথায়।’ এখানে আমরা আমাদের প্রয়াত মার্ক্সবাদী কিংবদন্তি শিক্ষক প্রফেসর ড. আবু মাহমুদের বিশ্লেষণ-ছায়ার ছোঁয়া পাই!
১৯৫০-এর দশকে সদ্য স্বাধীন কিছু উন্নয়নশীল দেশ সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার আদলে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের চেষ্টা করে কিছুটা সফলও হয়, তবে ব্যর্থতাও ছিল ঢের। এরপর আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাজারভিত্তিক উদারীকরণ আর মুক্তবাণিজ্যের ঢঙ্কা বাজিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং গরিবি হটানোর নীতি এসব দেশে অনুসরণ করতে দেখা যায়।
আমাদের মনে আছে, পুঁজিবাদী বিশ্বে কী টালমাটাল অবস্থা তৈরি করেছিল ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট! তখন কিছু পুঁজিবাদী তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এলান গ্রিনস্পান, যোসেফ স্টিগলিজ, শুমপিটার পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।
আমাদের তুমুল জনপ্রিয় শিক্ষক ভুবনবিখ্যাত মার্ক্সীয় অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. আবু মাহমুদ ৪০ বছর আগে বাংলায় লিখেছেন ‘মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষা’। প্রায় হাজার পৃষ্ঠার গ্রন্থে পুঁজিবাদের সর্বাধুনিক স্তরকে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বিশ্লেষণ করেছেন বিশ্ব অর্থনীতির ক্রমবিকাশ। সুলুক সন্ধান করেছেন পুঁজিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির, পুঁজিবাদের সংকট। সমাজতন্ত্রেই নিহিত গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, অবাধ লুণ্ঠনের চির অবসান। এ কারণে প্রয়াত প্রফেসর ড. আবু মাহমুদ মার্ক্স-পুনর্মূল্যায়ন, মার্ক্স-পুনর্ভাবনার জোর তাগিদ দিয়েছিলেন বাস্তবতার নিরিখে।
আমাদের আরেক খ্যাতিমান শিক্ষক অর্থনীতিবিদ ড. আজিজুর রহমান খানও তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ ‘আমার সমাজতন্ত্র’-এ কোন চরিত্রের পুঁজিবাদ বর্তমানের নিরিখে আমাদের মতো দেশের ভবিতব্য সে আলোচনা করেছেন। ড. খানের প্রশ্ন, ‘সমতা, প্রবৃদ্ধি ও ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলো পুঁজিবাদ এবং বাস্তবে বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের বিকল্প কোনো সমাজ সংগঠনের চিন্তা করতে পারে কি?’ সে প্রশ্নের উত্তরও তিনি অন্বেষণ করেছেন।
সবশেষে বলতে পারি, আমার কাছে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ স্যারের চমকপ্রদ এই গ্রন্থকণিকা ছিল সুখপাঠ্য, তাঁর বাংলাও বেশ ঝরঝরে। সহজ-সরল করে কঠিন-জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন। বাক্যগুলোর কাটাকাটি যেন তিনি সত্তর দশকের গোড়ায় ছাত্রত্ব শেষে আমাদের ক্লাস লেকচার দিচ্ছেন। সামষ্টিক অর্থনীতি পড়াচ্ছেন, অঙ্ক কষাচ্ছেন, পরিসংখ্যান পাঠ দিচ্ছেন, উন্নয়ন অর্থনীতি সোজাসাপটা করে বোঝাচ্ছেন স্বল্প কথায়। নিচু স্বরে, পরিমিত ভাষায়। আবার যেমন তাঁরও প্রয়াত শিক্ষক ড. আবু মাহমুদ স্যার দরাজ গলায় আমাদের সমাজতন্ত্র বা উন্নয়ন অর্থনীতি পড়াতেন। তাঁদের লোকবক্তৃতার মতোই শ্রুতিমধুর। আরও গভীরে যাওয়ার খিদে জাগায়, জানার আগ্রহ উসকে দেয়। এক চিমটি গণতন্ত্রের বৃত্তের বাইরে বঙ্গবন্ধু যে বলতেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের পথনকশা আঁকতে।
প্রত্যাশা থাকবে, ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এ বিষয়ে জন-আকাঙ্ক্ষার আলোকে আরও বিস্তারিত পরিসরে মূল গ্রন্থটি শিগগিরই দেশবাসীর বৃহত্তর কল্যাণে প্রকাশ করবেন। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র অথবা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র আমাদের মতো ঊন-গণতন্ত্রের দেশগুলোতে দরবেশ-আলেমদের একচেটিয়া লুণ্ঠনের পুঁজিবাদ কিংবা রাশিয়া-চীন-ভিয়েতনামের লাল পুঁজিবাদের জয় ঢং কার কোন উপায়ে অবসান ঘটাবে, সে রূপরেখা দেবেন। আমজনতার কীভাবে অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে, শোষিতের গণতন্ত্র কোন পথে অধরা থাকবে না, সে পথরেখা বাতলাবেন।
কামরুল ইসলাম চৌধুরী অর্থনীতি, টেকসই উন্নয়ন বিশ্লেষক। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস-অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টারের সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার। ই-মেইল: [email protected]