নতুন শিক্ষাক্রমে কি নন্দলালদের মন্দ কপাল বদলাবে

বেশির ভাগ শিক্ষকই স্বকীয় ক্ষমতা চূর্ণকারী সেই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাঁরাও একইভাবে আক্রান্ত হয়েছেন
ছবি : প্রথম আলো

সুকুমার রায় তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘নন্দলালের মন্দ কপাল’-এ ‘নন্দলাল’ চরিত্রটিকে চিত্রণ করতে গিয়ে হয়তো নিজের অলক্ষ্যেই শিক্ষার্থীদের প্রতি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার একপেশে দৃষ্টিকে উপস্থাপন করেছেন। সব শিক্ষার্থীই তো কিছু না কিছু বা কোনো না কোনো সক্ষমতা নিয়ে স্কুলে আসে। কিন্তু শিক্ষকেরা তাদের মধ্যে যে গুটিকয় পারদর্শিতা দেখতে চান, সেগুলো বাদে তাদের আর যে গুণই থাক, সেটিকে মূল্যহীন মনে করেন। ওই প্রার্থিত পারদর্শিতা না থাকলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব, মা-বাবা, এমনকি সমাজের সবার কাছে অযোগ্য ও অপদার্থ বলে বিবেচিত হয়।

বলতে হয়, বেশির ভাগ শিক্ষকই স্বকীয় ক্ষমতা চূর্ণকারী সেই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাঁরাও একইভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু সেই ব্যবস্থাকে অতিক্রম করতে পারেননি। ফলে তাঁরাও যে শিক্ষার্থীদের খুব উপকারে আসতে পারছেন, তা নয়। কারণ, তাঁদের পক্ষে প্রচলিত একচোখা শিক্ষাব্যবস্থার উল্টো স্রোতে গিয়ে তেমন কিছু করা সম্ভব নয়।

সুকুমার রায় লিখলেন: ‘নন্দলালের ভারী রাগ, অঙ্কের পরীক্ষায় মাস্টার তাহাকে গোল্লা দিয়াছেন। সে যে খুব ভালো লিখিয়াছিল, তাহা নয়, কিন্তু তা বলিয়া একেবারে গোল্লা দেওয়া কি উচিত ছিল?...ওই যে ত্রৈরাশিকের অঙ্কটা, সেটা তো তার প্রায় ঠিকই হইয়াছিল, কেবল একটুখানি হিসেবের ভুল হওয়াতে উত্তরটা ঠিক মেলে নাই।...আরও অন্যায় এই যে এই কথাটা মাস্টার মহাশয় ক্লাসের ছেলেদের কাছে ফাঁস করিয়া ফেলিয়াছেন। সে যে ইতিহাসের এক শর মধ্যে পঁচিশ পাইয়াছে, সেটা বুঝি কিছু নয়? খালি অঙ্ক ভালো পারে নাই বলিয়াই তাহাকে লজ্জিত হইতে হইবে? সব বিষয়ে যে সকলকে ভালো পারিতে হইবে, তাহারই বা অর্থ কী? স্বয়ং নেপোলিয়ান যে ছেলেবেলায় ব্যাকরণে একেবারে আনাড়ি ছিলেন, সে বেলা কী? সে অঙ্ক পারে না, অথচ অঙ্কের জন্য দুই-একটা প্রাইজ আছে; এদিকে ভূগোল, ইতিহাস তাহার কণ্ঠস্থ, কিন্তু ওই দুইটার একটাতেও প্রাইজ নাই।’

দেখা যাচ্ছে, নন্দলাল ইতিহাস, ভূগোল বা অন্য বিষয়ে ভালো হলেও শুধু অঙ্কে কাঁচা বলে ছাত্র হিসেবে সে নিতান্তই অপদার্থ। অথচ বিখ্যাত গণিতবিদ রামানুজনের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, কলেজে উঠে গণিতে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে অন্য বিষয়ে ফেল করলেন বলে তাঁর বৃত্তি পাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। যা-ই হোক, রামানুজন তো শেষ পর্যন্ত রামানুজন হলেন, কিন্তু নন্দলালের মতো অনেকে এ ধরনের দৈব-দুর্বিপাকে পড়ে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হয় যে তারা আসলে অকালকুষ্মাণ্ড।

আমাদের দেশে তো নয়ই, অন্যান্য দেশেও অনেক স্কুলেই নাচ বা গানের জন্য শিক্ষক থাকেন না। কিংবা থাকলেও প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় তিনি যে নন্দলালের শিক্ষকের চেয়ে ভালো কিছু একটা করতে পারেন, তা মনে হয় না। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ কেইন রবিনসন বিখ্যাত গানের দল বিটলসের দুই সদস্য জর্জ হ্যারিসন ও পল ম্যাককার্টনির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, তাঁরা লিভারপুল ইনস্টিটিউটে একই সংগীত শিক্ষকের কাছে গান শিখতেন।

১৯২৬ সালে ইংল্যান্ডের কেন্টে জন্ম নেওয়া জিলিয়ান লিন নামের একটি মেয়েরও নন্দলালের মতো অবস্থা হয়েছিল। মেয়েটার শিক্ষক একদিন তার মাকে ডেকে বললেন, ‘দেখুন, আপনার মেয়ে আসলে লেখাপড়া করতে পারবে না। ও সারাক্ষণ নড়াচড়া করে, ও অসুস্থ। ওকে ডাক্তার দেখান।’ লিনের মা তাকে ডাক্তারের কাছেই নিয়ে গেলেন। ডাক্তার রেডিও চালু করে লিনকে চেম্বারে রেখে তার মাকে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন, লিন একা হলে কী করে। একটু পরই লিন উঠে দাঁড়াল এবং রেডিওতে বাজতে থাকা মিউজিকের সঙ্গে নাচতে শুরু করল। ডাক্তার ব্যাপারটা বুঝলেন। লিনের মাকে বললেন যে তাঁর মেয়ে অসুস্থ নয়, সে জাত নাচিয়ে। সে হচ্ছে এমন মেয়ে যে মাথা নয়, পুরো শরীর দিয়ে চিন্তা করে। তাকে নাচের স্কুলে ভর্তি করতে হবে। তার মা সেটাই করলেন এবং কালক্রমে এই মেয়েই একদিন পৃথিবী বিখ্যাত ব্যালে ড্যান্সার হয়ে উঠেছিলেন।

আমাদের দেশে তো নয়ই, অন্যান্য দেশেও অনেক স্কুলেই নাচ বা গানের জন্য শিক্ষক থাকেন না। কিংবা থাকলেও প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় তিনি যে নন্দলালের শিক্ষকের চেয়ে ভালো কিছু একটা করতে পারেন, তা মনে হয় না। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ কেইন রবিনসন বিখ্যাত গানের দল বিটলসের দুই সদস্য জর্জ হ্যারিসন ও পল ম্যাককার্টনির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, তাঁরা লিভারপুল ইনস্টিটিউটে একই সংগীত শিক্ষকের কাছে গান শিখতেন। কিন্তু তাঁদের শিক্ষক টেরই পাননি, যে গানের দল একদিন দুনিয়া কাঁপাবে, সেই দলের অর্ধেকসংখ্যক সদস্য তাঁর ক্লাসেই তাঁর কাছে গান শেখার চেষ্টা করছে। এই দুজনের যে আদৌ কোনো সংগীত প্রতিভা আছে, তাঁদের পুরো স্কুলজীবনে তিনি সেটা ঠাওর করে উঠতে পারেননি। হয়তো সে কারণেই স্কুলে থাকতে ম্যাককার্টনি বা হ্যারিসন নিজেরাও তাঁদের নিজেদের প্রতিভা সম্পর্কে জানতেন না। এলভিস প্রিসলির অবস্থাও তথৈবচ। তাঁর গলাকে অশ্রাব্য বিবেচনা করে স্কুলের গ্লি ক্লাবে তাঁকে গান গাইতে দেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুন

শোনা যাচ্ছে, অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমও ২০২৩ সাল থেকে স্কুলের এসব সীমাবদ্ধতা কাটানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু শত শত বছরের এই অচলায়তন ভাঙা সহজ নয়। শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থী-শিক্ষা কর্মকর্তা নয়, সবাই মিলে কোমর বেঁধে না নামলে নন্দলালদের মন্দ কপাল এমন মন্দই থাকবে, বদলানো যাবে না।
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক, মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক