আমাদের বাবাদের জুতা

‘আমার বাবার জুতা’ নামের একটা মর্মস্পর্শী গল্প আছে হুমায়ূন আহমেদের:
আমার বাবার এক জোড়াই জুতা ছিল। লাল রঙের চামড়ার জুতা। মাল্টিপারপাস জুতা। সাধারণভাবেও পরতেন, আবার তাঁর পুলিশের ইউনিফর্মের সঙ্গেও পরতেন। জুতা জোড়ার সঙ্গে আমরা খুব পরিচিত। কারণ, আমাদের প্রায়ই তাঁর জুতা কালি করতে হতো।...ঝকঝকে জুতা দেখে বাবা বলতেন, ‘আরে বাপ রে, এক্কেবারে আয়না বানিয়ে ফেলেছে।’

১৯৭১ সালের ৫ মে আমার বাবা তাঁর লাল জুতা পরে বরিশালের গোয়ারেখো গ্রাম থেকে বের হলেন। সেদিন জুতাজোড়া কালি করে দিল আমার ছোট বোন। বাবা যথারীতি বললেন, ‘আরে বাপ রে, এক্কেবারে আয়না বানিয়ে ফেলেছিস দেখি।’ সেই তাঁর জুতা পরে শেষ বের হয়ে যাওয়া।

সন্ধ্যার সময় খবর এল, বলেশ্বর নদের তীরে দাঁড় করিয়ে মিলিটারিরা তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। মানুষকে যে এত সহজে মেরে ফেলা যায়, তা আমার মা তখনো জানতেন না। তিনি খবরটা বিশ্বাস করলেন না।...

একজনের বিশ্বাস অন্যের মধ্যে সংক্রমিত হয়। আমরা সবাই মায়ের কথা বিশ্বাস করলাম। এর মধ্যে মা এক রাতে স্বপ্নেও দেখলেন, মিলিটারিরা বাবাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে সেখানের এক জেলে আটকে রেখেছে। বাবা স্বপ্নে মাকে বললেন, ‘দেশ স্বাধীন হলেই এরা আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। এই কদিন একটু কষ্ট করে থাকো।’

...আমরা তখন গ্রামে পালিয়ে আছি। মে মাস প্রায় শেষ হতে চলছে। ...এক লোক নাকি বলেশ্বর নদ দিয়ে ভেসে যাওয়া একটা লাশ তুলে কবর দিয়েছে। তার ধারণা, এটা পিরোজপুরের পুলিশপ্রধান ফয়জুর রহমান আহমেদের লাশ। সে লাশটা কবর দিয়েছে, তবে প্রমাণের জন্য লাশের পা থেকে জুতাজোড়া খুলে রেখেছে। এই জুতাজোড়া সে আমাদের হাতে তুলে দিতে চায়। আমার মা বললেন, ‘অসম্ভব! এটা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই অন্য কারও জুতা।’ তবু পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য আমাকে জুতা আনতে শহরে পাঠালেন।...

আমি শহরে গেলাম লুঙ্গি, পাঞ্জাবি এবং টুপি মাথায় দিয়ে, যেন কেউ চিনতে না পারে। ওই লোককে খুঁজে বের করলাম। আমাকে জুতাজোড়া দেওয়া হলো। হ্যাঁ, আমার বাবারই জুতা। ভুল হওয়ার কোনোই কারণ নেই। জুতা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরলাম। আমার মা জুতা দেখলেন, তিনিও বুঝলেন এটা কার জুতা, তারপরও বিশ্বাস করলেন না।...

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর মা ঢাকা থেকে পিরোজপুরে গেলেন। নদীর পাড়ে যেখানে বাবাকে কবর দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে, সেই জায়গা নিজে উপস্থিত থেকে খোঁড়ালেন। কবর থেকে লাশ তোলা হলো। শরীর পচেগলে গেছে, কিন্তু নাইলনের মোজা অবিকৃত। মা পায়ের মোজা, দাঁত, মাথার চুল দেখে বাবাকে শনাক্ত করলেন। দীর্ঘ ছয় মাস পর তিনি স্বীকার করলেন, তাঁর স্বামী বেঁচে নেই।...

সন্ধ্যাবেলা মা কাগজের মোড়ক থেকে জুতাজোড়া বের করলেন। অনেক সময় নিয়ে পরিষ্কার করলেন। লাল কালি কিনে এনে জুতা কালি করা হলো। আমরা দেখলাম, তাঁর বিছানায় বালিশের পাশে জুতাজোড়া রাখা হয়েছে। সেই রাতে তিনি বাবার জুতাজোড়া জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুতে গেলেন। (বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১, প্রথমা প্রকাশন)

সালাহউদ্দিনের এই উক্তি কেবল সাংবাদিকদের অপমান করেনি, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষকেই অপমান করেছে। নিজের অপমান সহ্য হয়, বাবার অপমান যে সইতে পারি না!

এ গল্প থেকে তুলে ধরতে গিয়ে আবারও চোখ মুছছি। আমাদের বাবাদের কারও জুতা ছিল, মাত্র এক জোড়া, কারও–বা ছিলই না। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন একেবারে মোক্ষম জায়গাটায় আঘাত করতে পেরেছেন। বাফুফে অফিসে ঢুকতে গেলে সাংবাদিকদের ছবি দিতে হবে আগে, শুধু তাঁদের ছবি নয়, তাঁদের বাবাদের ছবি দিতে হবে, আর সেই ছবি হতে হবে জুতা পরা। আমার বাবার জুতা পরা ছবি আমি এখন কই পাই?

আমার আব্বার এক জোড়া পাম্প শু ছিল বটে। পিটিআইয়ের সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে অবসর নেন, তার আগে বার্ষিকীতে অধ্যক্ষের বাণী দেওয়ার জন্য তিনি তাঁর চেম্বারের বড় টেবিলের ওপারে বসে টেলিফোন কানে ধরে ছবি তুলেছিলেন। আব্বার জুতাজোড়া টেবিলের আড়ালে থাকায়, দুঃখিত, সালাহউদ্দিন সাহেব, আমি আমার বাবার জুতা পরা ছবি জমা দিতে পারছি না।

আরও পড়ুন

তবে আমাদের প্রায় সবার শৈশব ছিল রবীন্দ্রনাথের শৈশবের মতো। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমাদের চাল ছিল গরিবের মতো...পরনের কাপড় ছিল নেহাত সাদাসিধে। অনেক সময় লেগেছিল পায়ে মোজা উঠতে।’ ‘আমাদের চটিজোড়া এক জোড়া থাকিত, কিন্তু পা দুটা যেখানে থাকিত, সেখানে নহে। প্রতি পদক্ষেপে তাহাদিগকে আগে আগে নিক্ষেপ করিয়া চলিতাম, তাহাতে যাতায়াতের সময় পদচালনা অপেক্ষা জুতাচালনা এত বহুল পরিমাণে হইত যে পাদুকাসৃষ্টির উদ্দেশ্য পদে পদে ব্যর্থ হইয়া যাইত।’

স্কুলে যেতাম এক জোড়া বাটার স্যান্ডেল পরে। একবার ঈদের আগে সেই স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেলে প্রত্যাশা করেছিলাম নতুন স্যান্ডেল পাব। পাইনি বলে চানরাতে কাঁদতে কাঁদতে পুরা বাড়ি মাথায় তুলেছিলাম। সবাই বলছিল, ‘এখন কেন কাঁদছিস, আগে বলতে পারিসনি।’ ‘আগে বলব কেন, তোমরা দেখতে পেলে না আমার স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে।’ এখন আমি প্রায়ই জুতার দোকানে ঢুকে একসঙ্গে দুই জোড়া স্যান্ডেল কিনে আনি। আমার স্ত্রী বলেন, ‘সমস্যা কী! তুমি কি ইমেলদা মার্কোসের মতো তিন হাজার জোড়া জুতা এনে বাড়ি ভরাবে!’ আমি কিছু বলি না।

আমরা ছিলাম ‘চিলড্রেন অব হেভেন’। মজিদ মাজিদির সিনেমার মতো। আলী আর জাহরা দুই ছোট্ট ভাই–বোন। জাহরার জুতা হারিয়ে ফেলে বড় ভাই আলী। বাড়িতে তারা সেই তথ্য গোপন করে। এরপর সকালের শিফটে এক জোড়া জুতা পরে বোন যায় স্কুলে। বোন ফিরে এলে সেই জুতা পরে যায় আলী। স্কুলে যাওয়ার সময় দৌড়াতে দৌড়াতে যেতে হয় আলীকে। তবু তার লেট হয়ে যায়। শহরের দৌড় প্রতিযোগিতায় তৃতীয় পুরস্কার ছিল এক জোড়া জুতা। দৌড়ে আলী ফার্স্ট হয়। জুতা পায় না, পায় কাপ। ফটোগ্রাফার তাঁকে হাসতে বলে, কিন্তু ট্রফি হাতে আলী কাঁদতে থাকে। আমরাও কাঁদতে থাকি।

সেদিন সার্ক চ্যাম্পিয়ন ফুটবলার মেয়েদের বললাম, ‘তোমরা নাকি একদিন অনুশীলনে যাওনি। কী হয়েছিল?’ একজন বললেন, ‘মাসে বেতন দেয় ১০ হাজার টাকা। সেই ফান্ডও জোগাড় করতে হিমশিম খায়। আমাদের এক জোড়া জুতা কিনতে লাগে ৩০ হাজার টাকা। আমরা সভাপতিকে বলেছি, অন্তত জুতাজোড়া আপনারা দেন। ১০ হাজার টাকা বেতনে ৩০ হাজার টাকার জুতা কিনলে আমাদের থাকে কী!’

আরও পড়ুন

১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েও ভারত খেলতে যায়নি। প্রচলিত আছে, খেলোয়াড়েরা তখন খেলতেন খালি পায়ে, বুট পায়ে তাঁরা খেলতে চাননি। নতুন বই থেকে জানা যাচ্ছে, আসল সমস্যা ছিল অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের সিদ্ধান্তহীনতা। ৭৩ বছর পর একই ঘটনা বাংলাদেশে। বাফুফে টাকার অভাবে মেয়েদের ফুটবল টিম বাইরে পাঠানো যাচ্ছে না বলে জানালেও আসল সমস্যা অদক্ষতা, দুর্নীতি ও সিদ্ধান্তহীনতা।

বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষের গল্প প্রায় একই রকমের। আমরা কয়লা দিয়ে দাঁত মেজে বড় হয়েছি। স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেলে ল্যাম্পোর আলোয় গলিয়ে নিয়ে জোড়া দিয়েছি। এই আমাদেরই কেউ হয়েছি বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার, কেউবা নাসার বিজ্ঞানী, কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, কেউ বিশাল শিল্পপতি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের পায়ে জুতা ছিল না। এ দেশের সংগ্রামশীল জুতাবিহীন বাবার সংগ্রামী ছেলেরা দেশে বা প্রবাসে অমানুষিক পরিশ্রম করে দেশটাকে মধ্যম আয়ের দেশ বানিয়েছেন। বিপুলসংখ্যক মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উত্তীর্ণ হয়েছে।

সালাহউদ্দিনের এই উক্তি কেবল সাংবাদিকদের অপমান করেনি, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষকেই অপমান করেছে। নিজের অপমান সহ্য হয়, বাবার অপমান যে সইতে পারি না!

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক