ইউক্রেন নিয়ে ইউরোপীয়দের নিস্পৃহ থাকার সময় ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গেছে। কারণ, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনই যে সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠেছেন, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ইউক্রেন নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেওয়া দৃষ্টিভঙ্গি ইউরোপীয় নেতাদের স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কিত করেছে। কিন্তু নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়ার বদলে তারা বেশির ভাগ সময়ই ঘটনাপ্রবাহের পেছনে ছুটেছেন এবং ক্ষতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
চলতি বছরের শুরুতে অনেক ইউরোপীয় আশা করেছিলেন, আরও বেশি আমেরিকান অস্ত্র ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস কিনলে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের পাশে রাখা যাবে। তাঁরা এটাও দেখিয়েছেন যে, ট্রাম্পকে সামলাতে তাঁরা একজোট হয়ে কাজ করতে পারেন, যেমনটি তাঁরা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বিপর্যয়কর ওভাল অফিস বৈঠকের পর করেছিলেন। আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজে ট্রাম্প ও পুতিনের ঘনিষ্ঠ বৈঠকের পরও ইউরোপীয় নেতারা এক হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপের ভাগ্য একসময় না একসময় ফুরোবেই, কারণ ট্রাম্পের মূল স্বার্থ ইউরোপের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ‘মাগা’ উপদেষ্টা ও অনুসারীদের তিনটি বড় লক্ষ্য আছে: যেকোনো মূল্যে ইউরোপে একটি ‘শান্তি’ চাপিয়ে দেওয়া; রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে সেখান থেকে ব্যবসায়িক লাভ তোলা; এবং মার্কিন সেনাদের পশ্চিম গোলার্ধে ফিরিয়ে আনা।
কিছু ইউরোপীয় নেতা এত দিন ট্রাম্পের এই লক্ষ্যের কথা স্বীকার করতে চাননি। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশ হওয়ার পর তা অস্বীকার করার আর কোনো উপায় নেই।
অন্যদিকে, রাশিয়ার বিপুল পরিমাণ সেনা ও সম্পদ ব্যয় করার ঘটনা প্রমাণ করে, পুতিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি রাষ্ট্রযন্ত্র ও বৃহত্তর অর্থনীতিকে দখলযুদ্ধের উপযোগী করে পুনর্গঠন করেছেন। এ লক্ষ্যেই প্রতিবছর রাশিয়া ইউক্রেনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি গোলাবারুদ উৎপাদন করছে। ড্রোন উৎপাদনেও তারা ইউক্রেনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি তারা গ্লাইড বোমার মতো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও পুতিনের কৌশল (ইউরোপীয়দের শান্তিচুক্তির বাইরে রাখা, আমেরিকানদের চুক্তির ভেতরে রাখা, আর ইউক্রেনীয়দের এই চুক্তির মাধ্যমে চেপে ধরা) কার্যকর হচ্ছে। জেলেনস্কিকে প্রতিকূল শর্ত মেনে নিতে ট্রাম্পের ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যেই এর প্রমাণ মিলছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইউক্রেনের জনগণ (যারা যুদ্ধের শুরু থেকেই অবিশ্বাস্য সাহস দেখিয়ে এসেছে) এখন হয়তো সহ্যের শেষ সীমায় যাচ্ছে।
চলতি বছরের জুলাই ও আগস্টে ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তা ৪৩ শতাংশ কমে গেছে। এর পাশাপাশি, বাধ্যতামূলক সামরিক নিয়োগের বিরুদ্ধে জনসাধারণের প্রতিরোধ বাড়তে থাকায় ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী তীব্র জনবল সংকটে পড়েছে।
এ অবস্থায় দীর্ঘ মেয়াদে কীভাবে বিপর্যয় ঠেকানো যায়, তা নিয়ে ইউরোপকে এখন থেকেই ভাবতে হবে।
এই পটভূমিতে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত সাম্প্রতিক ২৮ দফার পরিকল্পনাটি ইউরোপের জন্য স্বাভাবিকভাবেই এক বড় ধাক্কা ছিল। কারণ, এতে ইউক্রেনের দুর্বল অবস্থানকে কাজে লাগানোর প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তবু এই পরিকল্পনাটি অনিচ্ছাকৃতভাবেই দেখিয়ে দিয়েছে—যেকোনো বাস্তবসম্মত শান্তি উদ্যোগে কোনো কোনো মৌলিক প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ এবং রুশ দূত কিরিল দমিত্রিয়েভের কাছ থেকে পরবর্তী ‘ভয়াবহ নাটক’ কী আসবে, শুধু সেটার জন্য প্রস্তুতি নেওয়াই যথেষ্ট নয়। বরং ইউরোপীয়দের নিজেদের পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে এবং স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে হবে, ইউক্রেন ইস্যুতে তারাই প্রকৃত শান্তির পক্ষের শক্তি।
ইউরোপের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত রাশিয়ার জব্দ করা সম্পদ কাজে লাগানো। এই সম্পদ অন্তত আগামী দুই বছর ইউক্রেনকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর (এমনকি ইউক্রেনের ওপরও) ইউরোপের সবচেয়ে বড় চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার এটিই। কিন্তু এই অর্থ কোথায় রাখা হয়েছে—এ নিয়ে বেলজিয়ামের সঙ্গে (যেখানে প্রযুক্তিগতভাবে তহবিলটি রাখা আছে) অশোভন তর্ক-বিতর্ক ইউরোপকে অদক্ষ ও দুর্বল হিসেবে তুলে ধরেছে।
ইউক্রেনের জন্য নতুন ঋণের ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পর ইউরোপীয় নেতৃত্বের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে এই সুযোগ নষ্ট না করা। বাস্তবতা হলো, ইউক্রেনীয় সমাজ ও রাষ্ট্র আর দীর্ঘ সময় ধরে এই ব্যয়বহুল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না।
কয়েক বছর তো দূরে থাক, আর কয়েক মাসের মধ্যেই ইউক্রেনের সহনক্ষমতা গুরুতর সীমায় পৌঁছাতে পারে। তাই ইউক্রেন ও তার মিত্রদের এখনই নিজেদের কাছে কঠিন প্রশ্নটি তুলতে হবে—এই যুদ্ধের পরিণতি তারা কীভাবে দেখতে চায়?
এই প্রেক্ষাপটে ইউরোপের জন্য বিশ্বাসযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা কেমন হবে, তা নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে স্পষ্ট ও বাস্তব আলোচনা শুরু করা দরকার।
অন্তত এমন একটি ‘স্ন্যাপব্যাক ব্যবস্থা’ তৈরি করতেই হবে, যাতে রাশিয়া ভবিষ্যতে আবার আগ্রাসন চালালে সঙ্গে সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা, অর্থায়ন এবং অস্ত্র সরবরাহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল করা যায়।
একই সঙ্গে ইউরোপকে কূটনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার প্রস্তুতিও রাখতে হবে।
এই পটভূমিতে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত সাম্প্রতিক ২৮ দফার পরিকল্পনাটি ইউরোপের জন্য স্বাভাবিকভাবেই এক বড় ধাক্কা ছিল। কারণ, এতে ইউক্রেনের দুর্বল অবস্থানকে কাজে লাগানোর প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তবু এই পরিকল্পনাটি অনিচ্ছাকৃতভাবেই দেখিয়ে দিয়েছে—যেকোনো বাস্তবসম্মত শান্তি উদ্যোগে কোনো কোনো মৌলিক প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপীয়দের খুব পরিষ্কার করে জানাতে হবে, একটি গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম ও নিরাপদ ইউক্রেনের অস্তিত্ব কোনোভাবেই আপসযোগ্য নয়। তবে অন্যান্য কিছু প্রশ্নে কঠিন সমঝোতায় যেতে হবে।
রাশিয়ার দখলদারি ইউক্রেন কখনোই স্বীকৃতি দেবে না। তবু বাস্তবে ইউক্রেনের কিছু ভূখণ্ডে রাশিয়ার ডি-ফ্যাক্টো নিয়ন্ত্রণ তাদের মেনে নিতে হতে পারে। একইভাবে, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ বাস্তবে সম্ভব নয় বলেই মনে হয়।
এ অবস্থায় ইউরোপীয় নেতাদের এখনই নীরবে ইউক্রেনীয়দের সঙ্গে কাজ শুরু করা উচিত। কারণ, একই সঙ্গে এটি ইউরোপের জন্যও অস্তিত্বগত প্রশ্ন।
মার্ক লিওনার্ড পরিচালক, ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ