সেচে বাড়তি ডিজেল খরচ, খাদ্যনিরাপত্তার কী হবে

ডিজেল, সার ও শ্রমিকের বাড়তি খরচ পুষিয়ে নেওয়ার জন্য কৃষকেরা যাতে তিন থেকে চার বছরের মতো ধানের ভালো দাম পান, সেদিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবেছবি : প্রথম আলো

জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এটা ঠিক কি বেঠিক হয়েছে, তা নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে। অনেকে পেট্রল-অকটেনের দাম বাড়ানো মেনে নিলেও ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানো সমর্থন করেননি। মূলত, এ দুটি জ্বালানি পরিবহন ও সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ ব্যবহার করে। আমার এ লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে ডিজেলের দাম কখন কতটুকু বাড়ানো উচিত বা অনুচিত, তা নিয়ে নয়; আমার উদ্দেশ্য ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচের ওপর কী প্রভাব এখনই এই আমন রোপণের সময় পড়ছে এবং আগামী ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী বোরো ধানে সেচের সময় কৃষকের পকেট থেকে যে বাড়তি খরচ হবে, তার বিরূপ প্রভাব কী হতে পারে এবং তা কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। অস্থির বৈশ্বিক খাদ্যবাজার পরিস্থিতিতে সেচের বিষয়টি আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধানের উৎপাদন ও দেশের খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধায় এটি বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে।

শুরু করা যাক প্রধান সেচযন্ত্র শ্যালো পাম্পের অর্থনীতি দিয়ে। মোট সেচকৃত জমির প্রায় ৬০ শতাংশের সেচে ব্যবহার করা হয় শ্যালো পাম্প। বাকিটা গভীর নলকূপ ও লো-লিফট পাম্প দ্বারা সেচ হয়। দেশে চলমান প্রায় ১৪ লাখ শ্যালো পাম্পের মধ্যে প্রায় ১১ লাখই চলে ডিজেল পুড়িয়ে। বাকি লাখ তিনেক বিদ্যুৎ–চালিত। এগুলো বেশ কিছুর আবার স্ট্যান্ডবাই ডিজেল ইঞ্জিনও রাখতে হয়, যাতে প্রচণ্ড গরমের সময় বোরো ধানের থোড় আসার সময় বিদ্যুৎ চলে গেলেও অতি আবশ্যকীয় সেচকাজ অব্যাহত রাখা যায়। একটি শ্যালো পাম্প চালাতে পুরো বোরো মৌসুমে গড়পড়তা ৩০০ লিটার ডিজেল লাগে। জমির পরিমাণ ও মাটিভেদে কমবেশি হতে পারে। ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ৩৪ টাকা বাড়ায় একটি শ্যালো পাম্পমালিকের খরচ বাড়বে ১০ হাজার ২০০ টাকা। এ হিসাবে মোট ১১ লাখ শ্যালো পাম্পের জন্য বাড়তি খরচ গুনতে হবে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ঠিক একইভাবে, প্রায় দুই লাখ লো-লিফট পাম্পে চালিত ভূ–উপরিস্থ সেচকাজের জন্য পাম্পমালিকদের বাড়তি খরচ হবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। তাহলে খুব সাদামাটা হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বোরো ধান আবাদের জন্য কেবল শ্যালো পাম্প ও লো-লিফট পাম্প সেচের জন্যই ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষকের মোটামুটি ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় করতে হবে। ইতিমধ্যে আবার ইউরিয়া সারের দামও বেড়ে গেছে। এটাও মনে রাখতে হবে, খুচরা পর্যায়ে সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে একটু বেশি দামেই কৃষককে ডিজেল ও সার কিনতে হয়। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় কৃষিশ্রমিকের মজুরিও গেছে বেড়ে। কৃষিকাজটাই খুব ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে।

এবারের বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে দীর্ঘ অনাবৃষ্টিজনিত খরায়। শ্রাবণ মাস প্রায় শেষ। বৃষ্টির দেখা নেই। যাঁরা আলু আবাদের জন্য আগাম আমন ধান লাগাবেন, তাঁরা চারা রোপণ করতে পারছেন না পর্যাপ্ত পানির অভাবে। কেউ কেউ সেচ দিয়ে কোনোভাবে চারা রোপণ করছেন। বিলম্বে রোপণ করা হলে এবং সামনে খরা আরও প্রলম্বিত হলে আমনের ফলন হ্রাস পাবে। খাদ্যনিরাপত্তার দিকে থেকে এটা বেশ আশঙ্কাজনক। এর জন্যও কৃষকের বাড়তি খরচ হচ্ছে ডিজেলের দাম বাড়ায়। নদী–নালা, খাল–বিলে পানি নেই বিধায় পাটচাষিরা পাট কেটে জাগ দিতে পারছেন না। খেতের পাট খেতেই শুকিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে পরে লিখব।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যেহেতু নিম্নমুখী, সেহেতু যথাসম্ভব আগামী বোরো মৌসুমের আগেই ডিজেলের দাম সমন্বয় করে নেওয়া সমীচীন হবে। মনে রাখতে হবে, আমন ফসল নানা কারণে আশাপ্রদ না–ও হতে পারে। তাই জাতীয় খাদ্য সার্বভৌমত্ব ও খাদ্যনিরাপত্তার স্বার্থে সামনের প্রধান বোরো ফসলের প্রতি যেকোনো মূল্যে বাড়তি মনোযোগ দিতেই হবে। খাদ্য উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিয়ে যেতেই হবে।

এ অবস্থায় ভুক্তভোগী কৃষকদের হচ্ছে মরণ। পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য তাঁদের ধান উৎপাদন চালিয়ে যেতেই হয়। আর তাঁদের উৎপাদন ব্যাহত হলে জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। আমরা মনে করি, সরকার ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক যথেষ্ট তৎপর এসব বিষয়ে। এ অবস্থায় কৃষকদের ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিজনিত ব্যয়ভার লাঘব ও ধান উৎপাদনে তাঁদের উৎসাহ ধরে রাখার জন্য কিছু পদক্ষেপ বিবেচনা করা যেতে পারে।

এক. ডিজেলের জন্য বাড়তি যে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার একটা গ্রস হিসাব ওপরে দেওয়া হলো, তার সঙ্গে আমনে সম্ভাব্য আরও সম্পূরক সেচের প্রয়োজন হতে পারে, সেটা বিবেচনায় রেখে মোট ২ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন ফান্ড তৈরি করা যেতে পারে। সেখান থেকে ডিজেলচালিত শ্যালো পাম্পমালিকদের বাড়তি ডিজেল খরচ বাবদ প্রতি পাম্পে ১০ হাজার টাকা পুনর্ভরণ এককালীন প্রদানের ব্যবস্থা বিবেচনা করা যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে পাম্পমালিকদের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। এটির নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে এবং প্রক্রিয়াগত কারণে কিছু সময় লাগতে পারে। তবে সরকার এমন একটি ঘোষণা এখনই দিয়ে দিতে পারলে সেচযন্ত্রের মালিকেরা অনেকটা স্বস্তি পাবেন এবং আমার বিশ্বাস, এতে কষ্ট হলেও বাড়তি খরচে সেচ দিয়ে চলমান আমন ধান রোপণ করতে কৃষকেরা উৎসাহ পাবেন। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই শর্ত থাকবে যে পাম্পমালিকেরা সেচ ব্যবহারকারী কৃষকদের কাছ থেকে বাড়তি সেচের চার্জ আদায় করতে পারবেন না।

দুই. আমন ধানের চারা রোপণের জন্য পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে অনতিবিলম্বে পরামর্শ দিতে হবে, যাতে তারা তাদের আওতাভুক্ত সেচযন্ত্রগুলোয় এখন দাম না বাড়িয়েই বিদ্যুৎ সরবরাহ করে যেতে পারে। ৩৫ হাজার গভীর নলকূপের প্রায় সব কটিই বিদ্যুৎ-চালিত এবং ভূগর্ভস্থ পানি সেচের প্রায় ২৬ শতাংশ গভীর নলকূপ থেকে হয়। অতএব এ দুই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব অনেক।

আরও পড়ুন

তিন. ডিজেল, সার ও শ্রমিকের বাড়তি খরচ পুষিয়ে নেওয়ার জন্য কৃষকেরা যাতে তিন থেকে চার বছরের মতো ধানের ভালো দাম পান, সেদিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য উৎপাদন ও মজুতের সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে চাল আমদানি–রপ্তানির বিষয়টি দেখতে হবে এবং ধানের দাম যেন পড়ে না যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। অনিশ্চিত এ খাদ্যবাজারে নিজেদের ভুল তথ্য যেন আমাদের বিপদে ফেলে না দেয়, সেদিকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে।

চার. সবশেষে বলব, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যেহেতু নিম্নমুখী, সেহেতু যথাসম্ভব আগামী বোরো মৌসুমের আগেই ডিজেলের দাম সমন্বয় করে নেওয়া সমীচীন হবে। মনে রাখতে হবে, আমন ফসল নানা কারণে আশাপ্রদ না–ও হতে পারে। তাই জাতীয় খাদ্য সার্বভৌমত্ব ও খাদ্যনিরাপত্তার স্বার্থে সামনের প্রধান বোরো ফসলের প্রতি যেকোনো মূল্যে বাড়তি মনোযোগ দিতেই হবে। খাদ্য উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিয়ে যেতেই হবে।

এম এ সাত্তার মণ্ডল ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের এপিএ পুলের পরামর্শক