আশি-নব্বই দশক পর্যন্ত দেশের জনপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। তখন দেশের ফুটবল অঙ্গনের মোড়ল আবাহনী-মোহামেডান আর ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব। ভক্ত-অনুরাগীদের অন্ধ সমর্থনকে পুঁজি করে দাপুটে বড় এই তিন দল ‘জেন্টলম্যান অ্যাগ্রিমেন্ট’ নামক নতুন নিয়ম প্রবর্তন করে।
ফুটবলারদের পেশাগত স্বাধীনতার ওপর ছড়ি ঘোরানোর বন্দোবস্ত ছিল এই অ্যাগ্রিমেন্ট। এই অচলায়তন ভাঙতে জাতীয় দলসহ দেশের তারকা ফুটবলাররা ‘বিদ্রোহ’ করেন। এই খেলোয়াড়দের দলে টানার বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেয় তখনকার মধ্যম মানের দল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র। বিক্ষুব্ধ খেলোয়াড়দের সাহসী আন্দোলন তিন মোড়লের অপতৎপরতা রুখে দেওয়ার পথ তৈরি করে। হঠাৎই মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র হয়ে উঠল ঢাকার ফুটবলের সবচেয়ে শক্তিমান দল, একই সঙ্গে খেলোয়াড়দের বিপ্লবের অনুপ্রেরণাস্থল।
আদর্শগত দৃঢ়তা ও নৈতিকতার দায় থেকে তুলনামূলক কম টাকায় তারকা ফুটবলাররা মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে খেলে বড় দলগুলোর ভিত নাড়িয়ে দেন। ২০০৩ সাল পর্যন্ত অন্যতম সেরা দল হয়ে থাকে বিদ্রোহী খেলোয়াড়দের দল মুক্তিযোদ্ধা। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে পেশাদার ফুটবল লিগ চালু হয়। যদিও ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ফুটবল এগোতে পারেনি।
ছাত্র–জনতার আন্দোলনে আওয়ামী জোট সরকারের পতন হয়। নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। বিগত মাসগুলোতে চলমান দৃশ্যপটের সঙ্গে ফুটবলারদের সেই ঘটনার মিল রয়েছে। সে থেকে কিছু প্রশ্ন মনে উঁকি দিতে পারে।
যা শেখাল, শিখল ও অনুশীলন করবে তারা?
রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের ভালো কাজের চেয়ে কূটকৌশল ও উদ্ভাবনীগুলো সাদরে গ্রহণ করে থাকে প্রতিদ্বন্দ্বী দল। যেমন অতীতে বিএনপির ‘মাগুরা নির্বাচনী মডেল’, ‘ছিয়ানব্বইয়ের ভোটারবিহীন নির্বাচন’। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন নিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান অনেকের মনে থাকার কথা। পরে এগুলো কীভাবে বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে এবং প্রয়োগ হয়েছে তাদের বিপক্ষে, তা বিএনপির চেয়ে ভালো কে বলতে পারবে?
২০০৮–এর ডিসেম্বরে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসেই আওয়ামী লীগ বিএনপির কৌশলগুলোকে নানামুখী প্রয়োগের মাধ্যমে জাতির সামনে ভয়ংকর বিভীষিকা উপহার দেয়। যেমন বিনা ভোট, রাতের ভোট ও আমি-ডামি নির্বাচন।
দেশের রাজনীতি ও সামনে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনী মাঠ বিএনপির জন্য এখন সম্ভাবনাময়। সারা দেশে চাঁদাবাজির উর্বর ক্ষেত্রগুলোয় তাদের দখল–কায়েমের ব্যাপক অভিযোগ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দেওয়ার দাবি তুলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ তৈরি করে চলেছে তারা। পূর্বসূরিকে তারা রেকর্ড কম সময়ের মধ্যে ছাড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে জাতিকে আরও নতুন কিছু দেখিয়ে দেবে না তো?
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানসহ কর্ম ও পেশাগত নিজ নিজ ক্ষেত্রে দেশ ও জাতির জন্য অবদান রাখা দেশের কৃতী সন্তানদের বিভিন্ন পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। আমাদের এত দিন জেনে আসা সেই তালিকায় যোগ হলো ‘অসামান্য অবদান’। নানা রকম ‘ডিজিটাল’ ও ‘স্মার্ট’ উদ্ভাবনী বিদ্যার প্রয়োগের মাধ্যমে ‘অসামান্য অবদান’ রাখা ব্যক্তিরা তাঁদের কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পূর্বাচল ঝিলমিলের মতো জায়গায় কোটি কোটি টাকা দামের ৮৩০টি প্লট উপহার পেয়েছেন।
‘অসামান্য অবদান’–এর প্লটগুলোর বরাদ্দ কি বাতিল করা হবে?
আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের কুশলী খেলায় কোণঠাসা হয়ে ওএসডি অবস্থায় পদোন্নতিবিহীন চাকরির জীবন শেষ করা অনেক কর্মকর্তা আগস্ট ২০২৪–এর পর নানাভাবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছেন। কিন্তু রাজনীতিমনস্কতা ও অনৈতিকতার চর্চায় সুশাসনের যে ব্যত্যয় ঘটেছে, তা মেরামত হবে কী করে?
সরকারি অফিসের দরকারি এসব কর্মচারি দেশ–জনগণের একনিষ্ঠ সেবক হয়ে দায়িত্ব পালনের চর্চা করবেন কি আদৌ? তোষামোদ ও আনুগত্যের সংস্কৃতি কি বন্ধ হবে? আমলারা কি নানা হাস্যকর অজুহাতে বিদেশভ্রমণ থেকে বিরত থাকবেন?
রাজনৈতিক নেতারা কেবল ‘জনগণ’ নাম জপ করেন। কিন্তু জনগণের মনের খবর কতটা তাঁরা রাখেন, জানেন বা বোঝেন? অতীতে আওয়ামী লীগের লোকেরা কথাবার্তা, আলাপ–আলোচনা, বক্তৃতায় কেবলই জনগণকে নিজেদের সঙ্গী–সাথি, সহমতের লোক ভাবতেন। কিন্তু বাতাস ঘুরে যেতেই সেই জনগণকে রেখে তাঁরা কেউ পালালেন, কেউবা গেলেন আত্মগোপনে। আর পেছনে রেখে যাওয়া তাঁদের কর্মী–সমর্থকেরা নিপীড়িত জনগণের রোষানলে পড়লেন কেন? বর্তমানে মাঠে থাকা নানা পক্ষের নেতারাও ‘জনগণ’ ‘জনগণ’ করছেন।
কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনে ‘সুইং ভোটার’দের যে অংশটার ভোটে যে ফলাফল হয়ে যায়, যেমনটি দেখা গেছে ’৯১ ও ’৯৬ ও জাতীয় নির্বাচনে, সেসব ভোটারের মনের কথা কতটা পড়ার চেষ্টা করছেন রাজনীতিকেরা?
রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে—বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সাধারণ জনগণ কি এটা বিশ্বাস করবে? ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা পরিবর্তন বা ক্ষমতার পালাবদলে বিশাল জন-আকাঙ্ক্ষার আলোকে তৈরি হওয়া আমাদের স্বপ্নগুলো কি ক্রমেই ফিকে হতে থাকবে?
এসবের অপমৃত্যু হবে শিগগির?
ছাত্রনেতা ও সমন্বয়কদের গাড়ির বহর নিয়ে দেশের নানা প্রান্তে ছুটে যাওয়া, যুক্তির নিরিখে দুর্বল, আবেগাশ্রয়ী কথাবার্তাগুলোও কি চলতে থাকবে? কারও টার্গেট ক্ষমতা আর কারও সংস্কার, মাঝখানে বারোটা বাজছে জনগণের। ধানের ভরা মৌসুমেও চালের দাম ক্রমেই বাড়ছে। কারসাজিতে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সিন্ডিকেট রয়েছে বহাল তবিয়তে। জনগণের অধিকার সুরক্ষার দিকে নজর দেবে কে?
ছাত্র–শ্রমিক–জনতার এত প্রাণহানি, আত্মত্যাগের পরও দেশটা আগের মতোই চলতে থাকবে? প্রত্যাশার বেলুন কি চুপসে যেতে বসেছে?
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইঞ্জিনচালিত রিকশার রাজপথ দাপিয়ে বেড়ানো নিয়ন্ত্রণে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে এক মাসের মধ্যে করণীয় নির্ধারণে সরকারের কোনো উদ্যোগ দুই মাসেও দেখা গেল না কেন?
একটা দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি এমনি এমনি আসে না। অনেকগুলো ভালো কাজের সামগ্রিক ফলাফল হলো উন্নতি, তা প্রতিভাত হতে থাকে ব্যক্তির মানসে, মননে, প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনায়, রূপরেখায়, গৃহীত নীতি ও পদ্ধতিতে। পাশাপাশি জনমনে তা ধারণ করার মাধ্যমে।
বাংলাদেশের গন্তব্য কোন দিকে?
মুহাম্মদ লুৎফুল হায়দার ব্যাংকার