ইরানের মিসাইল কি পাকিস্তানের ভোট ভেস্তে দেবে?

ইরান কেন জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-আল-আদলকে লক্ষ্য করে হামলা চালাল, তা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি লেখা প্রয়োজন। আপাতত এটুকুই বলা যায়, জইশ-আল-আদল ইরানের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত বলে কথিত আছে।ছবি : রয়টার্স

ইরান ও পাকিস্তান একে অন্যের দিকে মিসাইল ছুড়েছে। খুব সম্ভবত দুই দেশই ড্রোন ব্যবহার করেছে। আর এই হামলার নিশানা ছিল সীমান্তের দুই প্রান্তের বালুচ শিবির। এই বিরোধ খুব বেশি এগোয়নি। দ্রুতই দুই দেশের মধ্যে চলা উত্তেজনার প্রশমন হয়। তারা আবার ‘ভ্রাতৃত্বের’ সম্পর্কে ফিরে যায়।

ইরানের এই হামলা চালানোর ঘটনাটি একই সঙ্গে উদ্ভট ও অযৌক্তিক। অবশ্য যে গতিতে দেশ দুটি বিরোধ মিটিয়ে নিল, তা–ও ব্যাখ্যাতীত। মাঝখান থেকে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড করপস (আইআরজিসি) ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অল্প সময়ের জন্য সবার নজরে এসেছিল। কিন্তু দুই দেশের কূটনীতিকেরা সাত তাড়াতাড়ি তাঁদের মঞ্চ থেকে হটিয়ে দিয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু করেন। ফলে দুই সেনাবাহিনীও অলক্ষ্যে চলে যায়।    

ইরান কেন জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-আল-আদলকে লক্ষ্য করে হামলা চালাল, তা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি লেখা প্রয়োজন। আপাতত এটুকুই বলা যায়, জইশ-আল-আদল ইরানের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত বলে কথিত আছে। এদিকে আইআরজিসি যে ইরানের শীর্ষ সামরিক প্রতিষ্ঠান, তা প্রমাণে তাদের অনেক কিছু করতে হয়। আবার আইআরজিসি হামলা চালানোর পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও কখনো বসে থাকে না। তারাও জবাব দেয়।  

পাল্টা হামলা চালানোর পক্ষে অনেক যুক্তি দেখানো হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক বক্তব্য ছিল, দেশের ভৌগোলিক সীমারেখার অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব ভয়ংকরভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। সে কারণে এই হামলার জবাব দিয়ে বোঝানো হয়েছে, পাকিস্তানে হামলার ফলাফল কী হতে পারে।  

দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো এই হামলা নিয়ে যা বলছে না, তার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। পাকিস্তানের নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ রাজনীতির ঘুঁটি চালানোর জন্য সমালোচিত হয়ে আসছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তারা দেখাল, বহিঃশক্তি হামলার মুখে তাদের সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা কতটুকু।

আরও পড়ুন

পুরো ঘটনায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। বিশেষ করে একটি রাজনৈতিক দলের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে ক্রমাগত টিপ্পনী কেটে যাচ্ছিল তারা। ফলে পাল্টা হামলা চালিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিছু কৃতিত্বের দাবি করতেই পারে।    

পাকিস্তানের এ অবস্থানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কিছু টিভি ব্যক্তিত্ব। কারণ, তাঁদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর ব্যাপক দহরম–মহরম আছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যদি পাল্টা মিসাইল না ছোড়ার সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে তাদের কথার সুরও পাল্টে যেত। সে যাক, মোটের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিছু কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছে। এমনকি তাদের কঠোর সমালোচকেরাও এই দফায় তাদের প্রশংসা করেছে। সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তার সূচকে এভাবে তারা কিছু নম্বর যোগ করতে পেরেছে।  

আমার মতো সাংবাদিকদের জন্য পাকিস্তান একটি জটিল ‘কেস’। কেন জটিল, তার কিছু প্রমাণ পাবেন কিছু মিডিয়া ব্যক্তিত্বের কথায়। মিসাইল হামলার দরুন নির্বাচন পথভ্রষ্ট হবে, এমন ভাবনা থেকে তাঁদের কাউকে কাউকে উল্লাস করতে দেখা গেছে। তাঁদের যুক্তি ছিল, জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সমাধান আগে করতে হবে। এর আগে পর্যন্ত অন্য যেকোনো জাতীয় অগ্রাধিকারকে সরিয়ে রাখা উচিত। তারা আসলে কাদের পক্ষে কথা বলছে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে?

এই মাসের গোড়ার দিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১০ দফা কর্মসূচি দিয়েছে। এ কর্মসূচির সবটাই কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু কীভাবে তারা সবার বেতন দ্বিগুণ করবে, কীভাবে ৩০ লাখ আবাসন তৈরি হবে, ৩০০ ইউনিট বিদ্যুৎ বিনা পয়সায় দরিদ্ররা কীভাবে পাবে, তার কোনো রূপরেখা নেই। মনে করিয়ে দিই, ২০১৮ সালে পিটিআই ৫০ লাখ আবাসন তৈরির কথা বলেছিল।

কিন্তু অস্বাভাবিক দ্রুততায় উত্তেজনার প্রশমন হওয়ায় নির্বাচন স্থগিতের পক্ষের শিবির বড় ধাক্কা খেয়েছে। প্রথমে তেহরানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি সমঝোতামূলক বিবৃতি প্রকাশ করে। পরে দুই দেশের কূটনীতিকদের মধ্যে সাক্ষাৎ ও বার্তা বিনিময়। ব্যস। উত্তেজনা শেষ।

নির্বাচন কমিশন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে তাদের প্রতীক থেকে বঞ্চিত করার পর সুপ্রিম কোর্টও তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। যদিও পেশোয়ার হাইকোর্ট পিটিআই এর পক্ষে ছিলেন। কর্তৃপক্ষ-নিয়ন্ত্রিত সেই ২০১৬ মার্কা নির্বাচন আয়োজনের যে শেষ বাধা আদালতের এই সিদ্ধান্তে তা–ও অপসৃত হয়েছে। এ অবস্থায় এসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না, এমন আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা ভারি অদ্ভুত।

আদালতের এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশেষ করে পিএমএল-এনকে সন্তুষ্ট করেছে। কারণ, তারা এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে তিন সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং জিততে হলে তাদের জনসংযোগ বাড়াতে হবে। অন্যদিকে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত-পা বেঁধে ফেলার কাজও সারা।  

গাজা গণহত্যায় পশ্চিমা বিশ্বের যে প্রতিক্রিয়া, তাতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে আরও অনেকের মতো আমার মনেও সংশয় দেখা দিয়েছে। তারপরও বহু বছর ধরে আমি বিশ্বাস করে এসেছি যে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার তুলনায় এমনকি দুর্বল গণতন্ত্রও ভালো। কারণ, দুর্বল গণতন্ত্রেও অন্তত কিছু স্বাধীনতা থাকে, অন্তত মৌলিক মানবাধিকারের ছিটেফোঁটা থাকে। আমাকে আপনি অতি সরল ভাবতে পারেন।

পাকিস্তানে সব রাজনৈতিক দল যৌক্তিকভাবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নাক গলানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে আসছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই আবার কর্তৃপক্ষের দিকে হেলে পড়েছে। তাদের উচিত আত্মানুসন্ধান করা।

নির্বাচন যখন দোরগোড়ায়, তখন কোন দলের ইশতেহার আপনাকে উদ্বুদ্ধ করছে? উদ্বুদ্ধ করত যদি আপনারা ইশতেহারটা দেখতেন। আমি দেখিনি। ইসলামাবাদ ও লাহোরের সিংহাসনে যারা আরোহণ করতে চায়, তারা বলছে, ২৭ জানুয়ারি তাদের ইশতেহার পাওয়া যাবে। ঠিক ধরেছেন। পিএমএল-এন তাদের ইশতেহার জনগণের কাছে হাজির করবে নির্বাচনের মাত্র ১৩ দিন আগে।

এই মাসের গোড়ার দিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১০ দফা কর্মসূচি দিয়েছে। এ কর্মসূচির সবটাই কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু কীভাবে তারা সবার বেতন দ্বিগুণ করবে, কীভাবে ৩০ লাখ আবাসন তৈরি হবে, ৩০০ ইউনিট বিদ্যুৎ বিনা পয়সায় দরিদ্ররা কীভাবে পাবে, তার কোনো রূপরেখা নেই। মনে করিয়ে দিই, ২০১৮ সালে পিটিআই ৫০ লাখ আবাসন তৈরির কথা বলেছিল।

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে কর্তৃপক্ষ গণতন্ত্রকে বারবার স্থগিত করেছে, সেই সঙ্গে অস্পষ্ট কিছু পরিকল্পনা হাজির করেছে। কখনো কখনো তাদের কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। নিশ্চিতভাবে রাজনৈতিক দলগুলোও বিভিন্ন সময়ে আত্মসমর্পণ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এখন পর্যন্ত কোনো দলই বালুচের মানবাধিকার ইস্যু বা টিটিপি এবং বালুচের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাকিস্তানি সেনাসদস্য ও সাধারণ মানুষের হামলার ব্যাপারে মুখ খোলেনি।  

অপ্রিয় দলটি ছাড়া এখন পর্যন্ত সব রাজনৈতিক দলই যারা ২০১৬ মার্কা নির্বাচন সম্পন্ন করবে, তাদের শুভদৃষ্টি কামনা করছে। ইরানের সঙ্গে মিসাইল বিনিময় নিয়ে তারা চিন্তিত নয়। তাদের চিন্তা যাদের তেল দিলে ফায়দা হবে, তাদের পক্ষে আরও জোরালোভাবে কী করে থাকা যায়।

জনগণ, এই লাখ লাখ মানুষ—গণতন্ত্রের কেন্দ্রে যাদের থাকার কথা, তারাই পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একেবারে প্রান্তিক হয়ে আছে। ততক্ষণ পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকঠাক, যতক্ষণ মানুষ জলসায় হাজিরা দিচ্ছে, আর হ্যাঁ, ৮ ফেব্রুয়ারির ভোটে তাদের ভোট দিচ্ছে যাঁরা বক্তৃতায় লম্বা লম্বা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, কিন্তু বাস্তবায়ন কী করে করবেন, তার কোনো উল্লেখ করছেন না।

  • আব্বাস নাসির, ডনের সাবেক সম্পাদক
    ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত