রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মনে আশা জাগানো দরকার

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রতিনিধি ইয়োহানেস ভন ডার ক্লাও

বিশ্ব শরণার্থী দিবসের উদ্দেশ্য যুদ্ধ, নিপীড়ন, সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে বাঁচতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া কোটি কোটি মানুষের সাহস ও সংগ্রামকে সম্মান জানানো। নিরাপত্তার খোঁজে ঘরছাড়া সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষ আজ বিশ্বব্যাপী শরণার্থী।

সারা পৃথিবীতেই মানুষ শরণার্থীদের প্রয়োজনে সুরক্ষার হাত বাড়িয়ে দেয়। এর অসাধারণ দৃষ্টান্ত দেখতে খুব বেশি দূরে যেতে হবে না, বাংলাদেশের মানুষ প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে কক্সবাজারে।

দুঃসময়ে এ রকম সাহায্যের হাত দেয় নিরাপত্তা আর দেয় আশ্রয়। এর সঙ্গে জোগায় আশা—একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা আর উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হলে একদিন নিজ দেশে ফেরার আশা। সেই সুদিনের আগপর্যন্ত রোহিঙ্গারা শুধু মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজেদের জন্য কিছু করতে চায়।

আমি যখনই রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ বা তরুণদের সঙ্গে কথা বলি, তারা আমাকে বলে তাদের শিক্ষা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা, নতুন কোনো একটি দক্ষতা শেখার আগ্রহের কথা আর ক্যাম্পের জীবনে অর্থপূর্ণভাবে অবদান রাখার ইচ্ছার কথা। এ আশা নিছক অলস ইচ্ছা নয়, বরং কাজের মাধ্যমে নিজের সত্তাকে ফিরে পাওয়ার ব্যাপার। কীভাবে আমরা শরণার্থীদের মনে আশার আলো দিতে পারি? তাদের দৈনন্দিন জীবনের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে দিয়ে এবং শিক্ষা, দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও জীবিকা উপার্জনের সুযোগগুলোতে সাহায্য করে তাদের বেঁচে থাকার একটা অর্থ প্রদানের মাধ্যমে।

ক্যাম্পের পুরো মানবিক কর্মকাণ্ডের একেবারে কেন্দ্রে আছে রোহিঙ্গারা। আর দিনের পর দিন তারা প্রমাণ করে যাচ্ছে তাদের প্রত্যয়, শৃঙ্খলা, আন্তরিকতা ও সক্ষমতা। আগুন নিয়ন্ত্রণ, বন্যায় ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়া, লার্নিং সেন্টারে শিশুদের পড়ানো, কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান, টিকাদান কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া…তাদের জন্য পরিকল্পিত প্রতিটি মানবিক কার্যক্রমেই তারা অবদান রাখছে। বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবকেরাও এই পুরো প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সুন্দর ধারাটি বজায় রাখতে আরও সহায়তা প্রয়োজন।

মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে রোহিঙ্গা শিবিরের লার্নিং সেন্টারগুলোতে আরও মেয়েদের পড়তে দেখে আপ্লুত হই। যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে তরুণ রোহিঙ্গা পুরুষদের ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে উদ্বেলিত হই। ক্যাম্পের পরিবেশকে কোনো না কোনোভাবে ভালো করার জন্য সব বয়সের রোহিঙ্গাদের চেষ্টা দেখে মুগ্ধ হই। ক্যাম্পের ভেতরের সেন্টারগুলোতে রোহিঙ্গা নারীদের স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কাজ করে নতুন নতুন দক্ষতা গড়তে দেখে আবারও অনুপ্রাণিত হই।

এই বিশ্ব শরণার্থী দিবসে রোহিঙ্গাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য এখনই জরুরি ভিত্তিতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কারণ, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল থাকতে পারে না এবং তারা সেটা চায়ও না। তাদের দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, জীবিকামূলক কার্যক্রমের উদ্যোগ এবং শরণার্থীদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার সুযোগ অব্যাহত রাখার মাধ্যমেই এটি অর্জন করা সম্ভব; যেন তারা তাদের মৌলিক চাহিদা নিজেরাই পূরণ করতে পারে আর নিজেদের জন্য কাজ করতে পারে। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানকারী স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নের প্রচেষ্টাও অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে।

পাশাপাশি প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হলে আমাদের অবশ্যই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও টেকসই প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এটিই চলমান সংকটের সর্বোত্তম সমাধান এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবিচল আকাঙ্ক্ষা।

রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আশ্রয় প্রদানকারী স্থানীয় জনগণের জন্য মানবিক সাহায্যের তহবিল মারাত্মকভাবে কম, যার প্রমাণ হচ্ছে এই বছরের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান এখন পর্যন্ত প্রয়োজনের মাত্র এক–চতুর্থাংশ অর্থায়ন পেয়েছে। এর ভয়াবহ ফলাফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে শরণার্থীদের খাদ্য সহায়তার জন্য তহবিলসংকট। আমি আর আমার সহকর্মীরা যখন ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলি, তখন বুঝি তারা কতটা উদ্বিগ্ন।

এর সঙ্গে আছে ক্যাম্পে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর দৌরাত্ম্য, ভবিষ্যতের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা, যা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজতে মরিয়া হয়ে থাকা এই শরণার্থীরা মানব পাচারকারী ও অন্য অপরাধীদের পাতা ফাঁদে সহজেই পা দিয়ে ফেলে, যার ফল হিসেবে সম্প্রতি আমরা দেখেছি ভয়ংকর সাগরযাত্রার ৩০০% বৃদ্ধি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আমাদের মানবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে এবং তাদের একটি সুন্দর জীবনের আশা বজায় রাখতে আর সর্বোপরি টেকসই সমাধান তৈরিতে আমাদের প্রয়োজন আর্থিক ও নীতিগত সাহায্য।

আমার অন্য একটি আশা আছে। আমি স্বপ্ন দেখি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি গণমাধ্যম ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি সহমর্মী হবে, যেখানে সবাই বুঝতে পারবে তাদের সুরক্ষা এবং সহায়তার চাহিদা। কেউ নিজ ইচ্ছায় শরণার্থী হয় না আর কেউ প্রয়োজনের চেয়ে একটুও বেশি সময় নির্বাসনে থাকতেও চায় না। অন্ধকার সময়ে আশা আমাদের শক্তি দেয় আর সামনে যাওয়ার আলো দেয়।

কিন্তু এই আশাগুলো বজায় রাখতে সবার সমর্থন দরকার—নইলে রোহিঙ্গাদের আশাগুলো ক্যাম্পের আগুনের মতো পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, নয়তো গত মাসে ৩০ হাজার মানুষকে ঘরছাড়া করা মোকার মতো কোনো এক ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে যাবে। মোখার পর শরণার্থীদের আবার নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরি করতে হয়েছিল; আমি আশা করি ক্যাম্পে তাদের ঘর টেকসই উপায়ে বানানো যাবে।

আমি শরণার্থীদের অনেক গঠনমূলক কাজে জড়িত দেখে অনুপ্রেরণা পাই।

মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে রোহিঙ্গা শিবিরের লার্নিং সেন্টারগুলোতে আরও মেয়েদের পড়তে দেখে আপ্লুত হই। যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে তরুণ রোহিঙ্গা পুরুষদের ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে উদ্বেলিত হই। ক্যাম্পের পরিবেশকে কোনো না কোনোভাবে ভালো করার জন্য সব বয়সের রোহিঙ্গাদের চেষ্টা দেখে মুগ্ধ হই। ক্যাম্পের ভেতরের সেন্টারগুলোতে রোহিঙ্গা নারীদের স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কাজ করে নতুন নতুন দক্ষতা গড়তে দেখে আবারও অনুপ্রাণিত হই।

এ রকম আরও অনেক কিছু আছে, যা আমাদের আশা জোগায়। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য তাদের যতটা করা সম্ভব, তার সবই করছে। আর তাই আমাদেরও তাদের আশা দিতে এবং এই সংকটের সমাধান খুঁজে বের করার জন্য যথাসাধ্য কাজ করে যেতে হবে। নিজের মাতৃভূমি থেকে দূরে থাকা প্রতিটি শরণার্থীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আশার আলো।

  • ইয়োহানেস ভন ডার ক্লাও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রতিনিধি