ভিআইপি কালচার, সরকারি চাকরি এবং আমাদের সহজাত অনিয়ম

মেট্রোরেলের র‍্যাপিড পাস করতে গিয়ে সম্প্রতি যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি, তার আলোকে মনে হচ্ছে, সমাজে নিয়মের কথা বলতে যাওয়াই এখন সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন কিছু নয়, তবু পুরোনো বিষয় অনেক সময় নতুন করে ভাবায়, এটি সে রকম একটি বিষয়।

একটি বেসরকারি ব্যাংকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর যখন আমার সিরিয়াল এল, তখন হঠাৎ করেই দুজন বিশেষ মানুষের আবির্ভাব। কাউন্টারের কর্মকর্তা শশব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘ও আপনারা ম্যানেজার স্যারের লোক, দাঁড়ান, এক্ষুণি করে দিচ্ছি।’ হতভম্ব হয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওনারা কি আমার আগের সিরিয়ালের?’ উত্তরে খুব স্বাভাবিকভাবে সেই কর্মকর্তা বললেন, ‘ভিআইপি তো দু-একজন থাকবেই, এটা মানতে হবে।’ ভাবখানা এমন যে আমি কেন এসব কথা বলব! এটা তো স্বাভাবিক বিষয়! এখানে তো কোনো ব্যত্যয় হয়নি, বরং আমি কথা বলে ব্যত্যয় ঘটিয়েছি।

আরও পড়ুন

সরকারি কার্যালয়ে এসব মামুলি বিষয়, বেসরকারি ব্যাংক বলে কিছুটা হতাশ হলাম। অর্থাৎ বাস্তবতা হলো, নিয়ম ভাঙা এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে; বরং যাঁরা এসব করেন না, তাঁরাই এখন সমাজের চোখে অপাঙ্‌ক্তেয়। সমাজে ও পরিবারে দিনরাত্রির ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে মেলালে আমার এ কথার সত্যতা মিলবে বলেই আশা করি।

এটি ছোট একটি ঘটনা। সমাজে এমন আরও অনেক ঘটনার মুখোমুখি আমাদের হতে হয়, যেখানে সংবেদনশীল মানুষমাত্রেরই মনে হবে, বড় পদে চাকরি করলে বা ক্ষমতা লাভ করলে অন্য মানুষের প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়, তিনি অন্যায় করে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁদের জন্য কিছু করবেন। সম্প্রতি এক সৎ সরকারি কর্মকর্তার ভাষ্যে এমন অনেক ঘটনার বিবরণ শুনে পুরোনো সেই কথার ওপর নতুন করে প্রত্যয় সৃষ্টি হলো। সেটা হলো, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন, অর্থাৎ গল্পের চেয়ে সত্য বিস্ময়কর।

সেই ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল করে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই তিনি নিজেও আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপড়শিদের নতুন এক রূপ দেখতে শুরু করেন। নিয়োগ পাওয়ার পর বাড়িতে গেলেই আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপড়শিরা নানা ধরনের ন্যায় ও অন্যায় আবদার করতে শুরু করেন।

সবার কণ্ঠেই এক সুর, ‘তুমি পুলিশ হইছ, এইবার গ্রামের জন্য কিছু করো, আমাদের জন্য কিছু করো।’ অর্থাৎ অমুকের ছেলের চাকরি, তমুকের মেয়েজামাইয়ের চাকরির তদবির করার অনুরোধ আসতে শুরু করে তাঁর কাছে। আবার আরেক দল ক্ষমতাধর মানুষ উল্টো শত্রুতা করতে শুরু করেন। এই নানাবিধ চাপে পড়ে সেই ব্যক্তি শেষমেশ পুলিশের চাকরি ছেড়ে রেলওয়েতে যেতে বাধ্য হন।

বাস্তবে দেখা যায়, গ্রামের যে বাড়িতে সরকারি কর্মকর্তা আছেন, সেই বাড়ির কদর বেড়ে যায়। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পাড়াপড়শি সবাই সেই বাড়িতে ভিড় করতে শুরু করেন এটা–ওটা পাওয়ার আশায়। কৃষি সমাজের অবশেষ এখনো ভালোভাবে বিদ্যমান, যদিও জিডিপিতে কৃষি খাতের হিস্যা কমছে। এ ছাড়া একসময় মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় এবং নানাবিধ সামাজিক ও পারিবারিক কারণে যখন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রসঙ্গ আসত, তখন পরিবারের একজন সন্তানকেই গ্রামের বাইরে পাঠানো হতো।

বাংলাদেশের সমাজে পৃষ্ঠপোষক বীরদের অস্তিত্ব চিরকালই দেখা গেছে। এরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। বাস্তবতা হলো যে এই চক্র ভাঙতে গণতন্ত্রায়ণ দরকার; সর্বব্যাপী সুশাসন দরকার। সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করা গেলে এবং মানুষের মৌলিক অধিকারের ন্যূনতম সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে এই প্রবণতার রাশ অনেকটাই টেনে ধরা সম্ভব বলে ধারণা করা যায়।

স্বাভাবিকভাবেই সেই সন্তানের কাছে মা–বাবা থেকে শুরু করে সবার প্রত্যাশা বেশি থাকত। তাঁকে বিশেষ দায়িত্ব নিতে হতো। এর মধ্যে একধরনের ন্যায্যতার বিষয় থাকলেও বিষয়টি সব সময় সেই গণ্ডিতে থাকত না। সেই ব্যক্তির ওপর অতি নির্ভরশীলতা অনেক ক্ষেত্রে তাঁর বিপথগামিতার কারণ হতো। সর্বোপরি, এই নির্ভরশীলতা একসময় মানুষের মনস্তত্ত্বের মধ্যে ঢুকে যায়, ফলে যে সন্তান পরিবারে বেশি রোজগার করেন বা যিনি বেশি দায়িত্ব পালন করেন, তাঁর সাতখুন মাফ করে দেওয়ার মানসিকতা এমনকি শিক্ষিত মা–বাবার মধ্যেও দেখা যায়।

এমন এক উচ্চশিক্ষিত পরিবারের কথাও জানা যায়। যে পরিবারের বড় ও উচ্চ আয়ের সন্তানটির নানা ধরনের নৈতিক স্খলনের প্রমাণ ভূরি ভূরি পাওয়া গেলেও তাঁর ‘ঋষিসম’ পিতা সে বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত করতেন না। কারণ কী? জানতে চাইলে দেশের উত্তরাঞ্চলের সেই বিখ্যাত ব্যক্তির এক আত্মীয়, যিনি আবার লেখকের বন্ধু, বলেন, ভরণপোষণ তো সেই পদস্খলিত ব্যক্তিই দেন। এমন নয় যে সেই ব্যক্তি সন্তানের ভরণপোষণ ছাড়া খেয়ে–পরে বেঁচে থাকতে পারতেন না, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বিষয়টি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

আরও পড়ুন

এ ঘটনা উল্লেখ করার কারণ এটা বোঝানো যে আমাদের সমাজের এসব বৈশিষ্ট্য প্রকারান্তরে দুর্নীতিকে উসকে দেয়। দুর্নীতি ও অনিয়ম যে এখন স্বাভাবিক ঘটনা ও নিয়মে পরিণত হয়েছে, তার পেছনে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কারণ আছে অস্বীকার করছি না; বরং বলা যায়, রাষ্ট্র ও রাজনীতি এই সামাজিক কারণের প্রতিকার না খুঁজে তাকে আরও হাওয়া দিয়েছে। সে কারণে এখন দুর্নীতি এমন সর্বব্যাপী; যাঁরা অনিয়ম করেন না, তাঁরা মানুষের হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছেন। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, তবে ব্যতিক্রম উদাহরণ নয়।

বিশ্লেষকেরা বলেন, আমাদের সমাজ হলো একধরনের পৃষ্ঠপোষক-সুবিধাভোগী সমাজ। ফলে সমাজে স্বাভাবিকভাবেই একধরনের আধিপত্যবাদী কাঠামো তৈরি হয়। অসম অর্থনীতিতে আধিপত্যমূলক কাঠামো আরও জোরদার হয়। এখানে যেটা ঘটে তা হলো, খুবই অল্প কিছুসংখ্যক পৃষ্ঠপোষকের হাতে সম্পদের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বলে অন্যরা সুবিধাভোগীতে পরিণত হন। ঐতিহ্যবাহী পৃষ্ঠপোষক-সুবিধাভোগী সংস্কৃতি গড়ে ওঠে ভূমিকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও কৃষি সমাজ থেকে, যেখানে ক্ষমতার কাঠামো এককেন্দ্রিক।

অন্যদিকে প্রথাগত পৃষ্ঠপোষক-সুবিধাভোগী কাঠামো আবার বিভিন্ন শর্ত দ্বারা প্রভাবিত হয়। এর মধ্যে আছে বহুমুখী উত্তরাধিকার ব্যবস্থা, যেখানে পারিবারিক সম্পত্তির অনেক উত্তরাধিকার দেখা যায়। আরও আছে ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ও জীবিকার অন্যান্য উৎস, রাজনৈতিক ও শারীরিক সুরক্ষা আর গ্রামীণ অঞ্চলে সম্পদপ্রাপ্তিতে সরকারি হস্তক্ষেপ, কর্মসংস্থান ও সম্পদের অভাব ইত্যাদি।

বাংলাদেশের সমাজে পৃষ্ঠপোষক বীরদের অস্তিত্ব চিরকালই দেখা গেছে। এরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন।

বাস্তবতা হলো যে এই চক্র ভাঙতে গণতন্ত্রায়ণ দরকার; সর্বব্যাপী সুশাসন দরকার। সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করা গেলে এবং মানুষের মৌলিক অধিকারের ন্যূনতম সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে এই প্রবণতার রাশ অনেকটাই টেনে ধরা সম্ভব বলে ধারণা করা যায়। বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা বড় প্রয়োজন। এরপরের সংগ্রাম হবে মনের বাঘ মারার সংগ্রাম, কারণ, বনের বাঘের চেয়ে মনের বাঘ অনেক বেশি শক্তিশালী।

  • প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক