‘বিগ ফিশদের’ হাত থেকে বাঁচাবে কে

নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যখন সরকারের সামনে তিনটি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছিলেন, তখনো নিশ্চয়ই তিনি ভাবেননি সরকারকে এত দ্রুত তাদের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। 

গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনটি করে ফেলায় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জটিতে মোটামুটি আওয়ামী লীগ উতরে গেছে বলা যায়। আন্তর্জাতিক মহলে নির্বাচনটি কতটা গ্রহণযোগ্যতা পায়, যুক্তরাষ্ট্র কতটা কঠোর পদক্ষেপ নেয়, এসব মাথায় রেখেই কাদের সাহেব হয়তো কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন। এই পরীক্ষায়ও সরকার পাস করেছে বলতে হবে।  

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যেসব দেশ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে সমালোচনা করেছিল, সেসব দেশের সরকারপ্রধানেরা বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন।

সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থনের পাশাপাশি একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্ন পূরণে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় ঢাকার সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

অন্যদিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশীয় ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সেপ্টেম্বরে ভিসা নীতি চালুর পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ বিষয়ে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। নির্বাচনের আগে দিল্লি ওয়াশিংটনকে এই বার্তা দিয়েছিল যে নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে ঢাকার ওপর বেশি চাপ সৃষ্টি করলে বাংলাদেশ পুরোপুরি চীনের বলয়ে যেতে পারে, যা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে। নির্বাচনের আগে ওয়াশিংটন দিল্লির যুক্তি না মানলেও পরে মেনে নিয়েছে।

কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কখন, কোথা থেকে কী ধরনের চাপ আসে, সেটা আগেভাগে অনুমান করা কঠিন। মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির যে যুদ্ধ চলছে, সেটি এত দিন সীমান্তের ওপারেই ছিল। সাম্প্রতিক কালে তার অভিঘাত এসে পড়েছে বাংলাদেশের ওপরও। উদ্বেগজনক হলো বিদ্রোহী সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী ও সেনাদের অনেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। 

অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে যেমন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একমত হতে পারে না, পররাষ্ট্রনীতির বেলায়ও তারা সেই নীতি গ্রহণ করেছে। বিএনপির নেতারা বলেছেন, সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে মিয়ানমার সীমান্ত অশান্ত ও নিরাপত্তাহীন। অন্যদিকে বিএনপি কী বলছে, সেসব আওয়ামী লীগ নেতারা আমলেই নিতে চান না। তাঁরা ভুলে যান যে সীমান্তে অস্থিরতা দেখা দিলে তার অভিঘাত এসে পুরো দেশেই পড়তে পারে। 

মিয়ানমারে এখন যে যুদ্ধাবস্থা চলছে, তা কবে শেষ হবে জানি না। তবে শিগগির সেখানে সামরিক জান্তার পতন ঘটবে, মনে করেন না নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। যে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটি মিয়ানমারে সেনা নেতৃত্ব টিকিয়ে রেখেছে, তারা সেটা হতে দেবে না। বাংলাদেশের উদ্বেগের কারণ হলো, নেতারা যত আশার বাণীই শোনান না কেন,  সাড়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা যে বাংলাদেশে আছে, তাদের ফেরত পাঠানো আরও অনিশ্চিত ও কঠিন হলো।  

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন। এর মধ্যে আছে ব্যাংকিং খাতের সর্বনাশ। বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার এবং নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে আনতে না পারা। নির্বাচনের কয়েক দিন পরই চালের দাম কেন কেজিতে ৬ থেকে ১০ টাকা বেড়ে গেল, কেন পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না—এসব প্রশ্নের জবাব নেই। 

কোনো পণ্যের দাম বাড়লেই মন্ত্রী–সচিবেরা বৈঠক করেন, শীর্ষ মহল থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়, কিন্তু সেই নির্দেশনাগুলো কার্যকর হলো কি না, সেটা তদারক করা হয় না। অতীতে সরকারের অনেক মন্ত্রীও দাম বাড়ার পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি, সিন্ডিকেট ইত্যাদির কথা বলেছেন। নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম ওরফে টিটু অবশ্য সিন্ডিকেট শব্দটি ব্যবহার করতে চান না।

তিনি বলেছেন, বিগ ফিশ। পুকুরে বিগ ফিশ থাকলে যেমন ছোট মাছগুলো খেয়ে ফেলে, ব্যবসা–বাণিজ্যের নামে কতিপয় ব্যক্তি জনসাধারণের পকেট কাটছেন। প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, কথিত বিগ ফিশেরা জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে সবকিছু হজম করে ফেলছেন। তাঁরা যদি বুঝতে পারেন সরকার কোনো পণ্যের শুল্ক কমাবে, আগেই দাম বাড়িয়ে দেবেন। অনেকটা শপিং মলের মূল্য হ্রাসের মতো। 

৭ ফেব্রুয়ারি বণিক বার্তা খবর দিয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম এখন তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ ব্যবসায়ীরা গত মাসেও সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করেই বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে চার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন।  

বিস্ময়কর হলো, যেদিন সরকার চাল, তেল, চিনি ও খেজুরের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিল, সেদিনই রাজধানীর পাইকারি বাজারে পাম তেল ও সয়াবিন তেলের দাম প্রতি মণে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। এরপর হয়তো আরও বাড়বে। এরপর মন্ত্রী–সচিবেরা দৌড়ঝাঁপ করতে থাকলে তাঁরা ফের দাম কিছুটা কমিয়ে দেবেন। কিন্তু বাজার আগের জায়গায় ফিরে আসবে না। যেমনটি হয়েছিল চালের ক্ষেত্রে। এক–দুই দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজ ও আলুর ক্ষেত্রে। 

এনবিআরের প্রজ্ঞাপনে ভোজ্যতেল ও খেজুর আমদানিতে ভ্যাট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। চাল আমদানিতে শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে রেগুলেটরি ডিউটি ফিও। আর পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্কও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ভ্যাট ও শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারেই, যাতে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা।

কিন্তু সরকার যখন সিদ্ধান্তই নিল যে চারটি পণ্যের আমদানি শুল্ক কমাবে, তখন সেটা কার্যকর করতে এত বিলম্ব হলো কেন? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ, মন্ত্রী-সচিবদের বৈঠক ইত্যাদি করতে যে সময়ক্ষেপণ হলো, তাতে বিগ ফিশেরা ফাউ কামিয়ে নিতে পারল। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। ওই সময় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ডিসেম্বরের পর থেকে চালসহ বেশ কটি খাদ্যপণ্যের দাম আরও বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি আবার ১০ শতাংশের বেশি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। যাঁরা গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষ, তঁারা মূল্যস্ফীতির জটিল অঙ্ক বোঝেন না, তঁারা একটা বিষয়ই বুঝতে চান সরকার যে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর কথা বলছে, সত্যি সত্যি সেটি কমছে কি না। না সরকারের আরও অনেক কথার মতো এটাও একটি কথার কথা।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]