জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ভোট দেওয়ার ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করার দাবি জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভোটের বয়স ১৭ করার দাবি এসেছে। ভোটের বয়স ১৭ করার কথা বলেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও। কিন্তু ভোটের বয়স কমানোর পক্ষে আসলে যুক্তি কী? সেই যুক্তি কি বাংলাদেশের জন্য খাটে? অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা কী বলে?
আর্জেন্টিনা, অস্ট্রিয়া, ব্রাজিল, কিউবা, ইকুয়েডর, মাল্টা, নিকারাগুয়া—এই ৭ দেশের সব নির্বাচনে ১৬ বছর বয়সীরা ভোট দিতে পারেন। গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া, পূর্ব তিমুর ও সুদানে সব নির্বাচনে ভোট দেওয়ার বয়স ১৭। চাকরিতে যুক্ত থাকলে সার্বিয়া ও বসনিয়ায় ১৬ বছরে ভোট দেওয়া যায়।
তা ছাড়া জার্মানি, বেলজিয়াম, এস্তোনিয়া, ইসরায়েল, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, পুয়ের্তো রিকো—এসব দেশ ও অঞ্চলে স্থানীয় সংসদ, স্থানীয় সরকার বা ইউরোপীয় সংসদের নির্বাচনে ১৬ বছর বয়সীরা ভোট দিতে পারেন।
অর্থাৎ সারা বিশ্বে প্রায় ২০টির মতো দেশ ও অঞ্চলে ১৮-এর নিচেই কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে ভোট দেওয়া যায়। উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়া, পূর্ব তিমুর, কিউবা ও স্কটল্যান্ড বাদে বাকি দেশগুলোতে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বয়স কিন্তু ১৮। তাই অনেকে প্রাপ্তবয়স্ক বা আন্তর্জাতিক শিশু সনদ ইত্যাদির কথা বলে যে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তা এই যুক্তি আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
প্রশ্ন হলো, ১৬ থেকে ১৭ বছরের কিশোর-কিশোরীদের কি ভোট দেওয়ার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতা হয়েছে? আশির দশক থেকেই নিকারাগুয়া ও ব্রাজিলে ১৬ বছরে ভোট দেওয়ার সুযোগ আছে। বর্তমানে আরও অনেক দেশে ভোটের বয়স কমানোর আলোচনা চলছে। ফলে ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের নিয়ে ভোটের বিষয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে।
তার কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। অস্ট্রিয়া, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাতে ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ভোট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এতে তথাকথিত প্রাপ্তবয়স্কদের ভোট দেওয়ার ধরনের সঙ্গে তেমন পার্থক্য নেই, বরং তরুণ বয়স থেকেই রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে যুক্ত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিষয়ে আগ্রহ, শিক্ষা ও আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের যেই ১৬ থেকে ১৭ বছরের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমে স্বৈরাচার পতন করতে জীবন দিতে রাজি ছিল, সেই জেনারেশনকে আপনি রাজনৈতিকভাবে অজ্ঞ ও অসচেতন বলতে পারবেন না। একজন গড় ভোটারের থেকে এই কিশোর-কিশোরীরা বেশি শিক্ষিত, বেশি প্রযুক্তি সচেতন, বেশি দেশপ্রেমী এবং বেশি রাজনীতি সচেতন। তাই তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে অংশ নিতে দিলে তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পথে নতুন যাত্রাকে আরও বেগবান করবে।
ব্রাজিলের ভোটারদের ওপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের রাজনৈতিক জ্ঞান প্রাপ্তবয়স্কদের সমপর্যায়ের। অস্ট্রিয়ায় ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের সঙ্গে ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সীদের রাজনৈতিক সচেতনতার কোনো পার্থক্য পাওয়া যায়নি।
বেলজিয়াম ও জার্মানিতে কেবল স্থানীয় ও ইউরোপীয় নির্বাচনে ১৬ বছর বয়সীরা ভোট দিতে পারেন, সেখানকার গবেষণাও একই ফল দেখায়। আমাদের সামান্য দূরের প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৭১ সাল থেকে ১৭ বছর বয়সীরা ভোট দিচ্ছে। সেখানকার গবেষণায়ও কেবল ১৭ বছর বয়সীদের ভোট বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কোনো আলাদা অপরিপক্বতা দেখা যায়নি। এমনকি জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনিসেফও ভোট দেওয়ার বয়স কমানোকে ইতিবাচক হিসেবে দেখে।
এটা তো গেল সারা বিশ্বের কথা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কি অন্য দেশের যুক্তি চলবে? এর উত্তর দেওয়ার জন্য আমাদের বুঝতে হবে আসলে আমরা নির্বাচনে একজন আদর্শ ভোটারের থেকে কী আশা করি? একজন আদর্শ ভোটার দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত থাকবেন।
একদম মৌলিক জ্ঞান হলো সরকারের তিনটি অংশ আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ কীভাবে কাজ করে এবং তাঁর ভোট কীভাবে এই বিভাগগুলোকে প্রভাবিত করে। তিনি নির্বাচনের সময় ছাড়াও সারা বছরের রাজনৈতিক খবরাখবর, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এবং তাঁর আসনের সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের কাজের খবর রাখবেন।
নির্বাচনকালে সব দল ও প্রার্থীদের ইতিহাস ও ইশতেহার বিবেচনা করে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেবেন। আমার মতে, বাংলাদেশের মতো দেশে ভোটের বয়স আরও আগেই কমানো উচিত ছিল। কেননা, প্রথমত আমাদের জনসংখ্যার অধিকাংশ তরুণ, তাই সরকারের সব পলিসিতে তরুণদের কথা বিশেষভাবে মাথায় রাখতে হবে।
১৬ থেকে ১৭ বছরের যে ছেলে বা মেয়েটি এই নির্বাচনের পর আসা সরকারের শাসনামলেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে, তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই তার মত ব্যালটে দেওয়ার সুযোগ থাকা উচিত।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৮০ শতাংশের সামান্য নিচে। কিন্তু এই সংখ্যাকে মোটের ওপর নয়, বরং বয়সভিত্তিকভাবে বিবেচনা করা উচিত। বাংলাদেশে ৬৫ বছর বা তার ঊর্ধ্বে মানুষ আছেন প্রায় ১ কোটি। তাঁদের সাক্ষরতার হার মাত্র ৫৫ শতাংশ।
১৯৭০ সালে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির হার ছিল ১৩ শতাংশ—তাঁদের বয়স এখন সত্তরের আশপাশে। অন্যদিকে বর্তমানে ১৬ ও ১৭ বছরের প্রায় ৩০ লাখ করে মোট ৬০ লাখ কিশোর-কিশোরী আছে। পিএসসি পরীক্ষার পরিসংখ্যান মতে, তাদের প্রায় সবাই অন্তত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। এসএসসি পরীক্ষার তথ্যানুসারে, ৬০ লাখের মধ্যে অন্তত ৪০ লাখ দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে।
আমরা প্রাথমিকের গণ্ডি পার না হওয়া ৭০ থেকে ৮০ লাখ বৃদ্ধকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য যোগ্য মনে করছি, কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামোর বিষয়ে অন্তত ন্যূনতম শিক্ষিত ৬০ লাখ কিশোর-কিশোরীকে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, সেই সরকারের বিষয়ে মতামত দিতে যোগ্য মনে করছি না। একদিকে প্রায় ৪০ লাখ নিরক্ষর বয়োজ্যেষ্ঠ, অন্যদিকে প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষিত কিশোর, কে বেশি সচেতন ভোটার হবে?
অনেকে বলবেন, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এক বিষয় নয়। হয়তো ১৬ থেকে ১৭ বছরের কিশোর-কিশোরী স্কুলে পড়েছে রাষ্ট্রের অঙ্গ কী কী, আইনসভার কাজ কী, জনপ্রতিনিধি নির্বাচন কীভাবে হয়। সে হয়তো প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনীতির খবর রাখতে জানে। কিন্তু তার সেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই, যা সে আর মাত্র দুই বছর পরই অর্জন করবে, কিংবা একজন অশিক্ষিত বৃদ্ধ ৪০ থেকে ৫০ বছরের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের মাধ্যমে অর্জন করেছে।
এই দাবিকে ভুল প্রমাণ করেছে জুলাই বিপ্লব। জুলাই বিপ্লবে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তাদের নাগরিক অধিকার আদায়ে রাস্তায় নেমে ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারের পতনে অংশ নিয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, জুলাই আন্দোলনে নিহত হয়েছে ১৩২ শিশু-কিশোর।
তাদের অধিকাংশই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছে। তাদের মধ্যে ছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে কারখানার শিশুশ্রমিক পর্যন্ত। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা পালানোর পর পুলিশবিহীন বাংলাদেশে তারাই আবার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তার কাজে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অংশ নিয়েছে। কেবল ২৪-এর জুলাই নয়, ২০১৮-এর নিরাপদ সড়ক আন্দোলন পুরোটাই স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দ্বারা সংগঠিত ছিল।
বাংলাদেশের যেই ১৬ থেকে ১৭ বছরের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমে স্বৈরাচার পতন করতে জীবন দিতে রাজি ছিল, সেই জেনারেশনকে আপনি রাজনৈতিকভাবে অজ্ঞ ও অসচেতন বলতে পারবেন না। একজন গড় ভোটারের থেকে এই কিশোর-কিশোরীরা বেশি শিক্ষিত, বেশি প্রযুক্তি সচেতন, বেশি দেশপ্রেমী এবং বেশি রাজনীতি সচেতন। তাই তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে অংশ নিতে দিলে তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পথে নতুন যাত্রাকে আরও বেগবান করবে।
ইশতিয়াক আকিব পিএইচডি গবেষক