২৪৭ স্কুলের নাম পরিবর্তন নিয়ে আমার কিছু কথা ছিল

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার পূর্ব দিকে সবশেষ ইউনিয়ন যোগীপাড়া। যোগীপাড়ার শেষ প্রান্তের গ্রামটির নাম বীরকুৎসা। এ দেশে যখন জমিদারি প্রথা ছিল, তখন এই বীরকুৎসা ছিল একটি পরগনা। এই পরগনার জমিদার ছিলেন বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। পার্শ্ববর্তী আত্রাই উপজেলার আমরুল ডিহির বিশাল জমিদার ছিলেন গোপাল ধাম।

প্রভাতী বালা নামে তাঁর এক অনিন্দ্যসুন্দরী কন্যা ছিল। বীরেশ্বরের সঙ্গে প্রভাতীর বিয়ে হলো। প্রভাতী একদিন স্বামীর কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, বীরকুৎসায় চমৎকার একটা রাজপ্রাসাদ বানাতে হবে। যে প্রাসাদের দুয়ার থাকবে এক হাজার একটি। স্ত্রীর মনের ইচ্ছা পূরণ করলেন জমিদার বীরেশ্বর। নির্মিত হলো হাজারদুয়ারি রাজপ্রাসাদ।

প্রাসাদটি এখনো আছে, স্বাভাবিকভাবেই এখন তার ভগ্নদশা। কারণ, জাতি হিসেবে আমরা মোটেই ইতিহাসের প্রাচীন স্থাপনা সুরক্ষার প্রতি আন্তরিক নই। কিন্তু প্রাসাদটি এখনো একটি পর্যটন আকর্ষণ। আর প্রাসাদটির সঙ্গে অবধারিতভাবে চলে আসে বীরকুৎসা নামটি।

বীরকুৎসা এখন একটি গ্রাম। কিন্তু ইতিহাসের সঙ্গে মিশে থাকা এই নাম আর সামনে থাকবে কি না সন্দেহ। কারণ, এরই মধ্যে বীরকুৎসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে। বীরকুৎসা নামের বদলে করা হয়েছে বীরগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম থেকে বীরকুৎসা নামটি এসেছিল।

এখন বলা হচ্ছে, নামটি নাকি শ্রুতিকটু ও নেতিবাচক। নামটি শুনলে শিশুমনে ও জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। কবে না জানি গ্রামটির নামও বদলে যায়। বীরকুৎসা নামে সেখানে একটি রেলস্টেশন আছে। সেটাও কি বদলে যাবে?

২.

অতি সম্প্রতি (৩ এপ্রিল) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২৪৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এই বিদ্যালয়ের নামগুলো নাকি শ্রুতিকটু ও নেতিবাচক। ভাবছিলাম বীরকুৎসা নামটি কীভাবে শ্রুতিকটু হয়। কতশত হাজার ছেলেমেয়ে এই বিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করেছেন। এই নাম পরিবর্তন তাদের মনে কি হাহাকার তুলবে না? নিশ্চয়ই তুলবে। তারা বেদনাহত হবে।

শুক্রবার বিকেলে মুঠোফোনে আলাপ হচ্ছিল বাগমারার বীরকুৎসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির প্রধান মজনু মোহাম্মদের সঙ্গে। তিনি স্পষ্টভাবে বললেন, নামটি পরিবর্তন হোক, তা তাঁরা চাননি। তাঁরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিত প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়েছেন, যাতে নামটি পরিবর্তন করা না হয়। তারপরও তাঁদের কথা আমলে নেওয়া হয়নি।

কোনো একটি নামের সঙ্গে ওই অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি নিবিড়ভাবে জড়িত। নাম দিয়ে কোনো একটি এলাকা, সেখানকার মানুষ, জনজীবনকে অনেকটাই চেনা যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এখনকার প্রজন্মের অনেকেই পুরোনো ইতিহাসের কদর করতে চান না। তার ফলই হয়তো এই নাম পরিবর্তন। স্থানীয়ভাবে আপত্তি না এলে তো নিশ্চয় মন্ত্রণালয় নাম পরিবর্তন করত না। অভিযোগ আছে, কোথাও কোথাও স্থানীয়ভাবে নাম পরিবর্তন চাওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় মতামত আমলে না নিয়েই একতরফাভাবে নাম বদলে দেওয়া হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নাম পরিবর্তন বিষয়ে একটি নীতিমালা করেছে। এর নাম ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ এবং বিদ্যমান নাম পরিবর্তন নীতিমালা ২০২৩’। নীতিমালা পাঠ করলাম। গত বছরই নীতিমালাটি হয়েছে। তার মানে নীতিমালাটি অনেক বছর ধরে চলা কোনো আন্দোলনের ফল নয়, একেবারেই সাম্প্রতিক ব্যাপার–স্যাপার।

পাশাপাশি যেসব স্কুলের নাম ‘দৃষ্টিকটু’ বলে প্রতীয়মান হয় যেমন ‘নটীপাড়া, নেংটাদহ, ধনকোড়া, চোষডাংগা, চাঁড়ালডাঙা, শিয়ালমারা, চোরমারা, নাপিতেরহাট, মাংগীরপাড়া, বলদখাল, সোনাপুর—এসব নাম পরিবর্তনের আগেও আরও ভাবা, আলোচনা করা দরকার ছিল। আরও দুঃখজনক হলো, এতগুলো নাম পরিবর্তন হলো, দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ থেকে কোনো আপত্তি, বক্তব্য, ভাষ্য দেখতে বা শুনতে পেলাম না।  

নাম পরিবর্তনের যদি একান্তই প্রয়োজন হয়, হতে পারে। এটা নিয়ে অহেতুক আপত্তি নেই। কথায় আছে এক দেশের বুলি, আরেক দেশের গালি। পঞ্চগড়ের একটি উপজেলার নাম ‘বোদা’। সে দিন আমাদের এক সহকর্মী বলছিলেন, এই নামের যে অন্য কোনো অর্থ থাকতে পারে, ঢাকায় পড়তে আসার আগে তিনি তা জানতেন না।

এই হলো কথা। এখন কি এই নামও পরিবর্তন করতে হবে? অথচ বদেশ্বরী নামে একটি মন্দির থেকে বোদা নামটির উৎপত্তি, বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন তাই বলছে।

আবার ধরা যাক ফেনী জেলার বিখ্যাত উপজেলা ছাগলনাইয়ার কথা। অনেক পুরোনো একটি নাম। কিন্তু নামটি নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শেষ নেই। নামটি কীভাবে এল, তা নিয়ে আছে একাধিক মত। জনপ্রিয় মত হলো, মহাত্মা গান্ধীর নোয়াখালী সফরকালে এখান থেকে তাঁর ছাগল চুরি হয়। গান্ধী ছাগদুগ্ধ পছন্দ করতেন এবং যেখানে যেতেন, সঙ্গে ছাগল থাকত। সেই ছাগল চুরি থেকে এই ছাগলনাইয়া। আরেকটি মত হলো, ইংরেজ শাসনামলে দাপ্তরিক নথিতে R–এর স্থলে ভুলবশত L লেখার ফলে এ এলাকার নাম সাগরনাইয়া (সাগর যাকে নাইয়ে বা স্নান করিয়ে দেয়) থেকে ‘ছাগলনাইয়া’ হয়ে যায়।

সারা বাংলাদেশে অসংখ্য উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামের এ রকম নাম রয়েছে। তাই বলে কি আমরা এসব নাম পাল্টে দেব?

আবারও বলছি, একটি নামের সঙ্গে ওই অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতি গভীরভাবে মিশে থাকে। গুটিকয় ব্যক্তির ইচ্ছায় তা বদলে দেওয়া যায় না। স্কুলের পরিচালনা কমিটি, স্থানীয় মানুষজনের মত না নিয়ে, কোনো ধরনের গণশুনানির আয়োজন না করে নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করা যায় কি?

আরও পড়ুন

৩.

এবার যে ২৪৭টি বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে, সেখান থেকে কিছু নাম নিয়ে আলোচনা করা যাক। নাটোরের বড়াইগ্রামের কচুগাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পাল্টে করা হয়েছে মাধবীলতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাধবীলতা নামটি সুন্দর, তাই বলে এত দিন কচুগাড়ী নামটি চলছে, এতে কী সমস্যা, তা বোঝা গেল না।

আমলাদের হাতে পুরোপুরি দায়িত্ব দিলে কী হয়, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। নাটোরের নলডাঙ্গার বামনগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম বদলে করা হলো মাধবীলতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়! এখানেও মাধবীলতা! একই নামে দুই উপজেলায় দুটি স্কুল? আর নাম পাওয়া গেল না?

আবার বড়াইগ্রাম উপজেলার ভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম বদলে করা হয়েছে পাবনাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভবানীপুর নামটি ভালো ছিল নাকি পাবনাপাড়া ভালো হলো? নাটোর থেকে উঠে গেল রানি ভবানীর নাম? আর নাটোর জেলায় পাবনাপাড়ার প্রয়োজনীয়তা কেন এল, বোঝা গেল না।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ভজনপুর দেবনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম বদলে করা হয়েছে হাসনাহেনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভজনপুরে কী আপত্তি, যদি বুঝতাম!

এ রকম আরও উদাহরণ দেওয়া যায়। পাশাপাশি যেসব স্কুলের নাম ‘দৃষ্টিকটু’ বলে প্রতীয়মান হয় যেমন ‘নটীপাড়া, নেংটাদহ, ধনকোড়া, চোষডাংগা, চাঁড়ালডাঙা, শিয়ালমারা, চোরমারা, নাপিতেরহাট, মাংগীরপাড়া, বলদখাল, সোনাপুর—এসব নাম পরিবর্তনের আগেও আরও ভাবা, আলোচনা করা দরকার ছিল। আরও দুঃখজনক হলো, এতগুলো নাম পরিবর্তন হলো, দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ থেকে কোনো আপত্তি, বক্তব্য, ভাষ্য দেখতে বা শুনতে পেলাম না।  

স্কুলের নাম পরিবর্তন মানে ইতিহাসকে পরিবর্তন। যেকোনো নাম পরিবর্তনের আগে দেশের কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিজনদের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া দরকার।

ভবিষ্যতে কোনো আমলার কলমের খোঁচায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা এলাকার নাম ও ইতিহাস পরিবর্তন করা হবে না—এমন প্রত্যাশা রইল।

কাজী আলিম-উজ-জামান, প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
[email protected]