প্রাথমিকে প্রোগ্রামিং শিক্ষায় যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে

গাজীপুরের আলহাজ ডা. আনোয়ার আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার শিখছে শিক্ষার্থীরা l
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

সরকারি পর্যায় প্রথম যখন ঘোষণা করা হয়েছিল, প্রাথমিকেই কোডিং ও প্রোগ্রামিং শিক্ষা চালু হবে, তখন বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলাম। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব, প্রান্তিক অঞ্চলে কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের অভাব, গাণিতিক দক্ষতা বাড়ানোতে জোর না দিয়ে শুধু কোডিং-জাতীয় কিছু জোর করে সিলেবাসে যুক্ত করে দিলে মুখস্থ করে ফেলার প্রবণতা বা সংস্কৃতি তৈরি হয়ে যায় কি না, এ সবই ছিল আমাদের যত আশঙ্কার কারণ।

প্রাথমিকে কোডিং ও প্রোগ্রামিং শিক্ষা চালু হওয়া উচিত কি উচিত নয়, সে প্রশ্ন এখন অবান্তর। কারণ, নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় ইতিমধ্যে স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে যুক্ত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

স্ক্র্যাচ শিশু-কিশোরদের উপযোগী ব্লকভিত্তিক প্রোগ্রামিং ভাষা। প্রোগ্রামিং লজিক শেখা, কার্টুন, অ্যানিমেশন তৈরি ইত্যাদি কাজের জন্য এটি বেশ উপযোগী। কারিকুলামে স্ক্র্যাচ অন্তর্ভুক্তির পর সেটির প্রভাব কি হতে পারে বা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সেটিকে কীভাবে নেবে, সে ব্যাপারে আগাম ধারণা করা কঠিন ছিল। তবে ইতিমধ্যেই স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং-এ উদ্বুদ্ধ করতে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক ও ইএমকে সেন্টার একটি প্রকল্প পরিচালনা করেছে। এর আওতায় ২২টি স্কুলের শিক্ষকদের নিয়ে করা হয়েছে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প, স্কুলগুলোতে আয়োজন করা হয়েছে স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং ওয়ার্কশপ। এ ছাড়া প্রকাশিত হয়েছে “ছোটদের স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং” নামে বাংলায় স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং বই।

ব্যক্তিগতভাবে এই প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছে। তাঁদের মতামত পর্যালোচনা করলে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। সবচেয়ে আনন্দের সংবাদ হলো, শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও উদ্দীপনা। তবে সঙ্গে সঙ্গে যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন তাঁরা হয়েছেন, সেগুলো নিয়ে কথা বলার জন্যই এই লেখা। মূলত দুটি বড় প্রতিবন্ধকতার সামনে তাঁরা পড়েছেন। প্রথমটি হলো, প্রোগ্রামিং শেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভিন্ন পর্যায়ে অস্পষ্ট ধারণা। আর দ্বিতীয়টি, প্রয়োজনীয় ডিভাইস (কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ইত্যাদি) না থাকা।

অভিভাবক থেকে শুরু করে সহকর্মী—সবার প্রথম কৌতূহল, এই প্রোগ্রামিং শিখে কী হবে? এটি শিখে কি কম্পিউটারবিজ্ঞানী হবে? নাকি সফটওয়্যার প্রকৌশলী হবে? সেটা না হলে প্রোগ্রামিং শিখবে কেন? একেবারেই যৌক্তিক প্রশ্ন। কোনো জিনিস শেখার আগে কেন শিখছি, সেটি জানা খুব জরুরি। প্রচলিত ধারণায়, প্রোগ্রামিং শুধু কম্পিউটারের ভাষা, এটি দিয়ে কম্পিউটারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রকৃত অর্থে সেটি প্রোগ্রামিংয়ের প্রথম ধাপ নয়। প্রোগ্রামিং আসলে সমস্যা সমাধান (প্রবলেম সলভিং) এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ (ডিসিশন মেকিং) করতে শেখায়। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত আমরা সমস্যার সমাধান করে চলেছি। আমরা সেটি সব সময় আসলে খেয়াল করছি না।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। অফিসে যাওয়ার জন্য রিকশা নেব নাকি উবার বা পাঠাও থেকে কার নেব, নাকি পাবলিক বাসে যাব, এটিও একটি সমস্যা। এ সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। উদ্দেশ্য যদি হয় কম খরচে যাওয়া, তাহলে রিকশা নেওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে, খরচের কথা চিন্তা না করে যদি দ্রুত যাওয়াই হয় প্রধান উদ্দেশ্য, তাহলে পাঠাও নেওয়া যায়। আর যদি উদ্দেশ্য হয় কম খরচে তুলনামূলকভাবে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো, তাহলে পাবলিক বাস নেওয়াটা হবে সঠিক সিদ্ধান্ত।

প্রোগ্রামিং মানে শুধু কম্পিউটারের সামনে কি-বোর্ড নিয়ে বসে যাওয়া নয়। আগে সমস্যা সমাধানের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। আর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য, ওপরের উদাহরণের মতোই প্রয়োজন হয় যৌক্তিক ও বিশ্লেষণধর্মী চিন্তার। এই যৌক্তিক চিন্তার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা গেলে, তারপর প্রশ্ন আসবে সেই সমাধান কম্পিউটারে প্রয়োগ করব নাকি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করব। অর্থাৎ, এই সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জনের পর সেটি কাজে লাগানোর জন্য যে ভবিষ্যতে কম্পিউটারবিজ্ঞানী বা সফটওয়্যার প্রকৌশলী হতে হবে—এমন কোনো কথা নেই। জীবন চলার পথে, অসংখ্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে এই সমস্যা সমাধানের দক্ষতা।

তবে এখানটাতে শুধু সরকারি কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে হবে না। আমাদের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর কিছু ল্যাপটপ বা কম্পিউটার পরিবর্তন করতে হয়, পুরোনো বা অব্যবহৃত ডিভাইস একটু সদিচ্ছা থাকলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রদান করা যেতে পারে।

আবার, এই সমস্যা সমাধানের ধাপগুলো কম্পিউটারে প্রয়োগ করে, প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে যাচাই করা সহজতর। বাস্তব জীবনের অনেক সমস্যাকে গাণিতিক রূপে প্রকাশ করা যায় এবং গাণিতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কম্পিউটার নির্ভুল ও দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে পারে। আবার, কম্পিউটারে কোনো কিছু বারবার সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায়। যেমন যদি বলা হয় যে একটি বাড়িতে রং করতে হবে। বাস্তবে একটি বাড়িকে বারবার রং লাগিয়ে কোনো রংটি মানানসই, সেটি নির্ধারণ করা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু কম্পিউটারে একটি ক্লিকেই সেই পরিবর্তন এনে দ্রুত যাচাই করে নেওয়া সম্ভব, কোন রংটি মানানসই। অতএব সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জনের জন্য, কম্পিউটার তথা প্রোগ্রামিংয়ের অনুশীলন বাস্তবসম্মত, কার্যকর একটি মাধ্যম।

এরপর যে চ্যালেঞ্জটি স্বাভাবিকভাবে উঠে এসেছে সেটি হলো, স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং শেখার জন্য কম্পিউটারের অভাব। এটির সম্মুখীন যে হতে হবে, সেটি জানা কথাই। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সরকারিভাবে দেশব্যাপী শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও ল্যাব স্থাপন করা হবে। সেগুলো ব্যবহার করা যায় কি না, সেটি দেখা যেতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে পরবর্তী সময় এই ল্যাব স্থাপনের সময় প্রাথমিক পর্যায়ে যে প্রোগ্রামিং যুক্ত হয়েছে এবং কোন অঞ্চলের স্কুলে ডিভাইস স্বল্পতা আছে, সেটি মাথায় রাখা যেতে পারে।

তবে এখানটাতে শুধু সরকারি কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে হবে না। আমাদের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর কিছু ল্যাপটপ বা কম্পিউটার পরিবর্তন করতে হয়, পুরোনো বা অব্যবহৃত ডিভাইস একটু সদিচ্ছা থাকলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রদান করা যেতে পারে। আবার সামাজিকভাবে কিছু উদ্যোগও নেওয়া যেতে পারে। এত দিন প্রাইমারি স্কুল থেকে কম্পিউটার চাইলে কেউ কেউ হয়তো বলে বসত, কম্পিউটার দিয়ে কী হবে? এটির উদ্দেশ্য গান শোনা আর সিনেমা দেখা হয়ে যাবে না তো? এখন অন্তত একটি মহৎ উদ্দেশ্যের কথা বলা যাবে। বলা যাবে যে প্রোগ্রামিং শেখার জন্য কম্পিউটার লাগবে।

সর্বোপরি, যে সমস্যাগুলোর কথা আমরা জানতে পেরেছি, সেগুলো সমাধানযোগ্য। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, শুরুর দিকের জড়তাটুকু কাটিয়ে দিতে পারলেই, বাকি কাজ আমাদের সম্মানিত শিক্ষকেরাই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। আর প্রাথমিকের শিশুদের যদি যৌক্তিক চিন্তার সৌন্দর্য আর উপকারিতাটুকু আনন্দমুখর একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে ভবিষ্যতে যৌক্তিক এক স্মার্ট প্রজন্ম গড়ে উঠতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। প্রোগ্রামিং হোক সেরকমই এক আনন্দমুখরপ্রক্রিয়া।

ড. বি এম মইনুল হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল [email protected]