নেতানিয়াহুর সঙ্গে বাইডেনের বিরোধ কেন বাড়ছে

গত ২৬ মার্চ বাল্টিমোরের ‘ফ্রান্সিস স্কট কি’ নামের সেতুটির ভেঙে পড়া নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক ঘটনা ছিল। স্থানীয় লোকেরা জন্ম থেকেই এই সেতু দেখে এসেছে। সে কারণে তাদের সেই পরিচিত ল্যান্ডমার্কের আকস্মিক ভেঙে পড়া তাদের হতাশ করেছে। 

১৯৪৫ সাল-পরবর্তী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার দশা অনেকটা এই সেতুর মতো। এই বিশ্বব্যবস্থার কর্তৃত্ব, নিয়ম এবং স্থিতিস্থাপকতার ওপর মানুষের আস্থা ছিল। এটি সবার ভরসার জায়গা ছিল। ফলে এই ব্যবস্থার কর্তৃত্ব ও নিয়মকানুন সবাই মেনে নিয়েছিল। 

কিন্তু এখন উদ্বেগজনকভাবে এসবের ওপর থেকে সাধারণ মানুষের সমর্থন সরে গেছে। ফলে বিশ্বব্যবস্থা একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মতো ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে। 

সবকিছু ভেঙে পড়ছে—এমন একটা অনুভূতি ক্রমে সবার মধ্যে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব সবখানে দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনের মূল ভিত্তি যে জাতিসংঘ সনদ, সেই সনদ নিয়মিতভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। 

আরও পড়ুন

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ শেষ পর্যন্ত গত সপ্তাহে গাজা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। গাজা পরিস্থিতিকে নিন্দাজনকভাবে উপেক্ষা করার জন্য আজ সেখানে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। 

আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইউক্রেন, মিয়ানমার এবং সুদানে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার কোনো বিচার হয়নি। অন্য অনেক দেশের মতো এখন রাশিয়া, ইরান এবং ভারতও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বিদেশে ঘাতক পাঠাচ্ছে। অঘোষিত সাইবার যুদ্ধের এখন কোনো সীমা নেই। 

ইসরায়েলে ৭ অক্টোবরের হামলা এবং তার জের ধরে চলমান ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে মানুষের মধ্যে আইনকানুনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ভাব বিশেষভাবে জোরালো হয়েছে। সেখানে নৃশংসতার মাত্রা এখন উদ্বেগজনক। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দায়মুক্তি। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে জাতিসংঘের বিচার আদালতের আদেশ এখন নিছক মুখের বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, সেই সম্পর্কও এখন ভাঙনের মুখে পড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধ। দুজনের কথা হয় কদাচিৎ। 

ইসরায়েলের ওপর মার্কিন চাপ বাড়ছে, তার কারণ চলমান নির্বাচনী বছরটিতে বাইডেনের জনসমর্থনে রক্তক্ষরণ চলছে এবং নেতানিয়াহুর আচরণে তিনি অপমানিত বোধ করছেন। ইসরায়েলি ভাষ্যকারেরা মনে করছেন, তাঁদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে যে ফাটল দেখা দিয়েছে, তা সারাইয়ের অযোগ্য প্রমাণিত হতে পারে। 

বাইডেন চান গাজায় আরও ত্রাণ পাঠানো হোক; তিনি চান প্রায় ১৪ লাখ ফিলিস্তিনি ভয় ও ক্ষুধা কাঁপছে যে রাফা এলাকায়, সেখানে ইসরায়েলের হামলার হুমকি বন্ধ করা হোক এবং যুদ্ধ শেষে দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানের বিষয়ে আলোচনা হোক। এর পরিপ্রেক্ষিতে নেতানিয়াহু বাইডেনকে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ বলে বাইডেনের প্রতিটি পদক্ষেপের সামনে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তুলছেন। 

নেতানিয়াহু, তাঁর গণতন্ত্রবিরোধী চরমপন্থী মিত্ররা এবং বসতি স্থাপন সমর্থক চরম-ডানপন্থী দলগুলো যুদ্ধোন্মত্ত হয়ে ওঠায় ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য অস্তিত্ব–সংকটে পড়ে গেছে। সমালোচকদের পর্যবেক্ষণ যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে বলা যায়, নেতানিয়াহু ক্ষমতায় থাকার জন্য এই যুদ্ধকে প্রলম্বিত করছেন। গাজার পর তিনি এবার যুদ্ধকে পশ্চিম তীর এবং লেবাননে নিয়ে যাবেন। 

জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র নিজের অবস্থান থেকে একেবারে উল্টো অবস্থানে সরে গিয়ে গাজা যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি হয়েছে, এক দিক থেকে এটি উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা। যদিও না যুক্তরাষ্ট্র, না যুক্তরাজ্য এখন পর্যন্ত প্রস্তাবটির বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে। আর নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেয়ে নিজেদের দাপট প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বেশি আগ্রহী। অন্যদিকে আরব রাষ্ট্রগুলো তো ‘পুরুষত্বহীনতার’ গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

আরও পড়ুন

গাজায় হাজার হাজার নারী, শিশুসহ ৩২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হওয়া এবং সেখানে খাবার সংকটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে—এই ব্যাপারগুলো যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করে দেখেছে বলে দেশটি তার অবস্থান বদলেছে, বিষয়টি মোটেও তেমন না। 

ইসরায়েলের ওপর মার্কিন চাপ বাড়ছে, তার কারণ চলমান নির্বাচনী বছরটিতে বাইডেনের জনসমর্থনে রক্তক্ষরণ চলছে এবং নেতানিয়াহুর আচরণে তিনি অপমানিত বোধ করছেন। ইসরায়েলি ভাষ্যকারেরা মনে করছেন, তাঁদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে যে ফাটল দেখা দিয়েছে, তা সারাইয়ের অযোগ্য প্রমাণিত হতে পারে। 

ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আমোস হারেল সম্প্রতি দৈনিক হারেৎজ পত্রিকায় লিখেছেন, ‘ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা বুঝতে পারছেন না নেতানিয়াহু কী চান। কিন্তু এটি স্পষ্ট। আদতে রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষাই নেতানিয়াহুর অগ্রাধিকারের শীর্ষে থাকা ইস্যু। ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে—এই অভিযোগ পাহাড়সমান বোঝা হয়ে নেতানিয়াহুর মাথায় চাপলেও যদি তিনি বোঝেন, এই যুদ্ধ তাঁর গদি টিকিয়ে রাখবে, তাহলে তিনি হামলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছেন।’

বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি (তা সে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি হোক বা মধ্যপ্রাচ্যে চীনা প্রভাব বিস্তার হোক বা আইএসের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের পুনরুজ্জীবন ইস্যু হোক কিংবা সৌদি আরবের সঙ্গে বড় দর-কষাকষি হোক বা ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ ইস্যু হোক) এখন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তাঁর মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পররাষ্ট্রনীতির বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে গেছে। সেই একই কথা ইসরায়েলের আরেক কট্টর মিত্র যুক্তরাজ্যের বেলায়ও খাটে। 

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন গাজা যুদ্ধ ইস্যুতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি গাজায় ত্রাণ সরবরাহ ইস্যুতে নেতানিয়াহুর সঙ্গে কোন্দলে জড়িয়েছেন এবং ভবিষ্যতের শান্তিপ্রক্রিয়া বাস্তবায়নে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গত সপ্তাহে জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতিকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে গেছে যুক্তরাজ্য। 

এই সবই ক্যামেরনের পররাষ্ট্র দপ্তরের পূর্বসূরি বরিস জনসন, লিজ ট্রাস ও ডমিনিক র‍্যাবের সঙ্গে বৈপরীত্য দেখায়। তবে এরপরও যুক্তরাজ্য এখনো ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে গাজায় কর্মরত ত্রাণ সংস্থাকে শাস্তি দিয়েছে; এবং অবিশ্বাস্যভাবে এখনো যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা দেয়নি যে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড মানবিক আইন লঙ্ঘন করছে।

ফিলিস্তিনের ধ্বংসাবশেষ থেকে শেষ পর্যন্ত কী পাওয়া যেতে পারে, যা এই মহাবিশৃঙ্খল বৈশ্বিক প্রবণতাগুলোকে উল্টে দিতে সহায়তা করতে পারবে? 

আসলে নেতানিয়াহুর অভাবনীয় আগ্রাসন হামাসকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করতে পারছে না, বরং তা হামাসকে আরও উদ্দীপ্ত করছে। নেতানিয়াহু সন্ত্রাসীদের নৃশংসতাকে প্রকৃত বিদ্রোহে রূপান্তরিত করেছেন এবং একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতাকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। 

কিন্তু বিশ্বমানবতার একটি জয় খুবই প্রয়োজন। বাল্টিমোরের ভেঙে যাওয়া সেতুটি পুনর্নির্মাণ করা যেতে পারে। কিন্তু বিশ্বব্যবস্থায় আস্থার যে ধস নেমেছে, তা ঠিক করবে কে? 

সিমোন টিসডাল অবজারভার-এর বিদেশবিষয়ক ধারাভাষ্যকার

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ