শিখন-ঘাটতি: বিপন্ন প্রজন্মকে বাঁচাতে যা করতে হবে

করোনা অতিমারির কারণে শিক্ষার্থীরা শিখনঘাটতিতে পড়েছেন
ফাইল ছবি

এডুকেশন ওয়াচ এবং অন্যান্য পর্যালোচনা থেকে করোনা অতিমারির কারণে দুই শিক্ষাবর্ষ ধরে বিপর্যস্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও শিখনঘাটতি নিয়ে বিপৎসংকেত ও আশু নিরাময়মূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ সেসব পরামর্শে বিশেষ কান দেয়নি। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল শিগগিরই বিদ্যালয়ের নিয়মিত কাজকর্মে ফিরে যাওয়া। সম্প্রতি সরকার অনুমোদিত দুটি গবেষণার ফল এডুকেশন ওয়াচ গবেষণা ২০২০, ২০২১ ও ২০২২-এর মাধ্যমে যে বিপদের আশঙ্কা ও নিরাময়ের বার্তা দেওয়া হয়েছে, তা ভালোভাবেই সমর্থন করছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের আয়োজনে ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় প্রাথমিক শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ চালানো হয়। ৩ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২০ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে এই জরিপ প্রতিবেদন ২০২২ সালের অক্টোবরে তৈরি হয়। তবে প্রাপ্ত ফলাফল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।

তবে মার্চের ২৩ তারিখ দৈনিক জনকণ্ঠ ‘শিক্ষায় ক্ষতি, শিশুরা বিপাকে’ শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান খবর হিসেবে উল্লিখিত গবেষণার বিবরণ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা বর্ণমালা চিনতে পারছে না। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সাধারণ যোগ ও বিয়োগ করতে পারে না। বিশেষ সুযোগবঞ্চিত শিশু, যেমন পাহাড়ি আদিবাসী শিশুরা আরও পিছিয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের উদ্যোগে ‘জাতীয় শিশু শিক্ষা জরিপ ২০২১’ শিরোনামে আরেকটি গবেষণা করা হয়। ২১ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে ১০ জানুয়ারি ২০২২ তারিখের মধ্যে ৯ হাজার  পরিবার বা খানার ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিশুদের নিয়ে এই জরিপ চালানো হয়। ইউনিসেফ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর শিশু জরিপের ধারা অনুযায়ী শিশুশিক্ষা-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

দেখা যায়, জরিপভুক্ত শিশুদের মধ্যে মাত্র অর্ধেক সহজ বাংলা ভাষা পড়ে সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাদের বাংলা পড়া ও বোঝার দক্ষতা দেখাতে পারে। গণিতের ক্ষেত্রে এক-চতুর্থাংশ শিশু সংখ্যা পড়তে পারে, বড় ও ছোট সংখ্যার তফাৎ বোঝে এবং সাধারণ যোগ অঙ্ক সম্পন্ন করতে পারে। এই জরিপে ২০২১ সালের শেষে যখন বিদ্যালয় আবার চালু হয়, সেই সময়ের চিত্র পাওয়া যায়। শিখনঘাটতির তুলনামূলক হিসাব এ থেকে দেখা যায় না।

বিপন্ন শিক্ষার্থী এবং বিপন্ন শিক্ষক ও অভিভাবকদের সংকট কর্তৃপক্ষ বুঝতে নারাজ বলে মনে হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। সে জন্য সহায়ক পরিবেশ, উপকরণ, দক্ষতা, সক্ষমতা, মনোভাব ও সবার সহযোগিতা অর্জনের যে প্রস্তুতি দরকার, সেদিকে যথেষ্ট দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে না। বর্তমানের যে শিখনঘাটতির চিত্র দেখা যাচ্ছে, সে সম্বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দ্রুত চালুর চেষ্টা কতটা সংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন কি নাকচ করে দেওয়া যায়?

এই জরিপে আরও দেখা যায়, বিদ্যালয় বন্ধ থাকার সময় প্রতি পাঁচজনের একজন (১৯ শতাংশ) দূরশিক্ষণে অংশ নিয়েছে। প্রাথমিক স্তরে এই অনুপাত ছিল ১৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ছিল যথাক্রমে ২০ ও ২৪ শতাংশ। এই অংশগ্রহণ থেকে শিশুরা কী শিখতে পেরেছে তা বলা যায় না।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের গবেষণায় করোনা-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী শিখনফল তুলনা করার চেষ্টা করা হয়। ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীদের পাঠক্রম অনুযায়ী শ্রেণিভিত্তিক কিছু বিষয়বস্তুতে প্রত্যাশিত অর্জনের তথ্যের সঙ্গে ২০২২ সালে শিক্ষার্থীদের অর্জনের তথ্য তুলনা করা হয়। যেমন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের তৃতীয় শ্রেণির পাঠক্রমের ভিত্তিতে বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের দক্ষতা ২০১৯ ও ২০২২ সালে পরিমাপ করা হয়।

দেখা যায়, ২০১৯ সালে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীর ৪০ শতাংশ বাংলায়, ৩৭ শতাংশ ইংরেজিতে ও ৪৪ শতাংশ গণিতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করেনি। ২০২২ সালে দেখা যায় ‘অতিমাত্রায়’ পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীর অনুপাত ছিল ৪৪ শতাংশ বাংলায়, ৪৯ শতাংশ ইংরেজিতে ও ৩৯ শতাংশ গণিতে। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে কোভিডের আগেই গড়ে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিখনফল গ্রহণযোগ্য ছিল না এবং কোভিডের পরে তাতে আরও অবনতি হয়েছে। শুধু গণিতের ক্ষেত্রে চতুর্থ শ্রেণিতে কিছু উন্নতি দেখা গেছে, কিন্তু অন্য শ্রেণিগুলোতে তা দেখা যায়নি।

তৃতীয় একটি গবেষণা এডুকেশন ওয়াচ ২০২২ ‘অতিমারি-উত্তর শিক্ষা—বিদ্যালয় শিক্ষার পুনরুদ্ধার ও নবায়ন’ সম্প্রতি সমাপ্ত হয়েছে এবং শিগগিরই প্রকাশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় করা এই পর্যালোচনা ২০২২ শিক্ষাবর্ষের শেষ তিন মাসের অর্থাৎ এক শিক্ষাবর্ষের অধিকাংশ সময় বিদ্যালয় চালু থাকার পরের অবস্থা তুলে ধরা হয়।

অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের শিখনফল যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়। অষ্টম শ্রেণির পাঠক্রম অনুযায়ী দেশের ৮টি জেলার ১৬টি উপজেলা শহর, সিটি করপোরেশন, গ্রাম ও শহর পার্শ্ববর্তী এলাকার ১২৮টি বিদ্যালয়ের প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

এই জরিপের ফলে দেখা যায়, স্কুল খোলার পর শিক্ষার্থীদের দুই শ্রেণি এগিয়ে দিয়ে শ্রেণিকক্ষে যে পাঠ দেওয়া হচ্ছিল, তা শিক্ষার্থীদের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ সামাল দিতে পারছে না। তা ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটর ও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। শিক্ষাবর্ষের শেষ প্রান্তে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এক-তৃতীয়াংশ বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে অকৃতকার্য (এফ) অথবা তার কাছাকাছি (ডি) সমতুল্য নম্বর পায়। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও এক শিক্ষাবর্ষ এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও প্রায় একই রকম ফল দেখাতে পারে। অর্থাৎ শিখনের ঘাটতি সময়ের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান হতে চলেছে।

মাধ্যমিক অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিখনফল আগে উল্লিখিত প্রাথমিকের শিখনফলের সমতুল্য বলা যায়। এ পরিস্থিতিতে কী করণীয়?

এডুকেশন ওয়াচ ২০২১ প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে এবং ২০২২ প্রতিবেদনেও বলা হচ্ছে, শিখন নিরাময়ে অন্তত বছরব্যাপী জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে:
- শ্রেণি ও বিদ্যালয়ভিত্তিক দ্রুত শিখন যাচাইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরি ভিত্তিমূলক দক্ষতায় দৃষ্টি দিতে হবে। অর্থাৎ প্রাথমিকে বাংলা ও গণিত এবং মাধ্যমিকে বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানে।
- দ্রুত যাচাইয়ের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর দক্ষতা অনুযায়ী তাদের দলে ভাগ করে এক বছরের মধ্যে গ্রহণযোগ্য দক্ষতায় পৌঁছানোয় সহায়তা দিতে হবে।
- এই উদ্যোগে বিষয় ও শ্রেণিভিত্তিক দ্রুত ও সহজ দক্ষতা যাচাইপত্র তৈরি করতে হবে, যা প্রতি বিদ্যালয়ে ব্যবহৃত হবে। শ্রেণি ও বিষয়ভিত্তিক নিরাময়মূলক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
- প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সম্মুখ-প্রশিক্ষণ ও অনলাইন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে তৈরি করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

আরও পড়ুন

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অপ্রকাশিত খসড়া প্রতিবেদনেও এ রকম নিরাময়মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এসব পরামর্শ কর্তৃপক্ষকে এখনো প্রভাবিত করতে পারছে বলে মনে হয় না। তারা ইতিমধ্যে বিদ্যমান শিখনঘাটতির সঙ্গে করোনাজনিত অতিরিক্ত ঘাটতিকে আমলে না নিয়ে শিখন-মূল্যায়ন ছাড়া বা সহজ মূল্যায়নে ‘অটো প্রমোশন’ দিয়ে বিদ্যালয়ের প্রচলিত রুটিনে ফিরে যেতে তৎপর। তার সঙ্গে উচ্চাভিলাষী নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক চালুতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

বিপন্ন শিক্ষার্থী এবং বিপন্ন শিক্ষক ও অভিভাবকদের সংকট কর্তৃপক্ষ বুঝতে নারাজ বলে মনে হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। সে জন্য সহায়ক পরিবেশ, উপকরণ, দক্ষতা, সক্ষমতা, মনোভাব ও সবার সহযোগিতা অর্জনের যে প্রস্তুতি দরকার, সেদিকে যথেষ্ট দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে না।
বর্তমানের যে শিখনঘাটতির চিত্র দেখা যাচ্ছে, সে সম্বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দ্রুত চালুর চেষ্টা কতটা সংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন কি নাকচ করে দেওয়া যায়?

একই সঙ্গে দশম শ্রেণি পর্যন্ত একই ধারার অবিভাজিত পাঠক্রম প্রবর্তনের যে ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা কি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে? এই উদ্যোগ আগে একবার নিয়ে প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছিল। প্রস্তুতি ও ক্ষেত্র তৈরি ছাড়া বড় সংস্কার সৃজনশীল মূল্যায়নের মতোই নতুন বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি করছে কি না, তা-ই এখন অনেকের প্রশ্ন।

  • ড. মনজুর আহমদ এডুকেশন ওয়াচ-২০২২-এর প্রধান গবেষক।

  • ড. মোস্তাফিজুর রহমান এডুকেশন ওয়াচ-২০২২-এর সহযোগী গবেষক ও সমন্বয়কারী।

(নিবন্ধে ব্যক্ত মতামত তাঁদের নিজস্ব।)