অমানবীয় ‘রোবট-কুকুর’ দিয়ে সীমান্ত পাহারা কতটা মানবিক

যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত একটি বৈরী এলাকা। অগুনতি অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ঠেকাতে এখানে দুর্লঙ্ঘেয় দেয়াল তোলা হয়েছে।
ছবি: রয়টার্স

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে ‘রোবট ডগ’ মোতায়েন হবে—এমন একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এ নিয়ে তাদের ওয়েবসাইটে সে সময় একটি উৎসাহব্যঞ্জক প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছিল।
প্রতিবেদনটিতে তারা জানায়, রোবট ডগ মোতায়েনের উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের (সিবিপি) শক্তি বৃদ্ধি ও কর্মীদের ‘প্রাণঘাতী ঝুঁকি’র আশঙ্কা কমিয়ে আনা।

রোবট ডগ নিয়োগে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে যাতে কোনো ধরনের সন্দেহের উদ্রেক না হয়, সে জন্য প্রতিবেদনে একটি ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হলো রুক্ষ অঞ্চল, তাপমাত্রাও চরমভাবাপন্ন, এর বাইরেও পরিবেশবান্ধব নয় এমন অনেক ঝুঁকি রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা সীমান্তরক্ষীদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক বাধা তৈরি করতে পারে।’

আরও পড়ুন

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত একটি বৈরী এলাকা। শুধু অগুনতি অভিবাসনপ্রত্যাশীর কথা ভাবুন। তাদের অনেকেই সীমান্তে পৌঁছানোর আগেই মারা গেছে। এসব মৃত্যুর কারণ আশ্রয়প্রার্থীদের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক কঠোর অবস্থান। তারা আশ্রয় প্রার্থনাকেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করছে।

এ অঞ্চল এখন আরও বেশি বৈরী হয়ে উঠেছে। কারণ, গোটা দুনিয়ার মতো সীমান্তের নিরাপত্তা কার্যক্রমও এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) চলার চেষ্টা করছে। এআই-নির্ভর নজরদারির সরঞ্জাম এখন অবৈধ অভিবাসীদের আরও বিপজ্জনক জায়গায় ঠেলে দিচ্ছে। যেখানে পরিবেশগত নয়—এমন সব ঝুঁকির মধ্যে যুক্ত হয়েছে কুকুরের মতো রোবট।

২০২০ সালের দিকে ইসরায়েলভিত্তিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি কোম্পানি এলবিট সিস্টেমস-এর সম্পূরক অংশীজন হিসেবে আমেরিকা এই প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে। ইসরায়েল একটি প্রাণঘাতী সীমান্ত ব্যবস্থা চালু রেখে আনন্দিত। আর তারাই কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশনস বা সিবিপির জন্য এআইনির্ভর নতুন একটি প্রযুক্তির কথা প্রচার করছে বুক ফুলিয়ে। তারা বলছে, এই প্রযুক্তি ‘সীমান্তদেয়ালের কাছে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো জিনিস, যেমন মানুষ বা কোনো যানবাহন পৌঁছালে’ শনাক্ত করতে পারে।

আরও পড়ুন

নিশ্চিতভাবেই মানুষকে ‘স্বার্থসংশ্লিষ্ট’ জিনিস হিসেবে গণ্য করার মতো অমানবিক বিষয় আছে খুব কমই। এই মানুষগুলো সীমান্তদেয়ালের কাছে পৌঁছাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়।

সিবিপি ২০২২ সালে এআই সেন্টার অব ইনোভেশন প্রতিষ্ঠা করে। সরকারি সংস্থাগুলো চলতি বছরের মে মাসে ঘোষণা দেয় যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণে এআইকে তারা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেছে। এআই তাদের কাজে সহায়তা করবে।

মনে রাখা দরকার, ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন ৪৮টির মতো দেশে কাজ করে থাকে। এখন জো বাইডেন প্রশাসন ভার্চ্যুয়াল দেয়ালের ধারণায় রীতিমতো আসক্ত। এই প্রশাসন মনে করে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সীমান্তে দানবীয় কিছু ঘটনা ঘটাতে চাইছিলেন। সে তুলনায় ভার্চ্যুয়াল দেয়ালের ধারণা অনেক সভ্য।

এই ধরনের কুকুর সদৃশ রোবট যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর সীমান্ত পাহারায় বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
ছবি: যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি

অবৈধ অভিবাসী নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত উপায়গুলোর মধ্যে ছিল সীমান্তের কাছে জলাশয়ে কুমির ছাড়া কিংবা সীমান্তদেয়ালের ওপর পেরেক পোঁতা। কেউ দেয়াল টপকাতে গেলে মাংসে পেরেক গেঁথে যাবে—এটাই ছিল উদ্দেশ্য। মানলাম, সে তুলনায় কোনো মরুভূমিতে অবৈধ অভিবাসীদের নীরব মৃত্যু অতটা চাঞ্চল্যকর হবে না।

কিন্তু যুদ্ধ তো যুদ্ধই, সেটি স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে হলেও। আর আমরা অতীতে আমেরিকার বিভিন্ন সামরিক উদ্যোগ দেখেছি। মানুষ মারার ব্যবসার আবেদন আছে দুদলের কাছেই। কাকতালীয়ভাবে সীমান্তে এআইকেন্দ্রিক খেলায় অন্যতম খেলোয়াড় আন্দুরিল ইন্ডাস্ট্রিজ। এটি একটি সমরাস্ত্র তৈরির প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের মালিক পিটার থিয়েল শতকোটিপতি দক্ষিণপন্থী এক রক্ষণশীল। ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী উদ্ভট চিন্তাকে তিনি সমর্থন দিয়েছেন।

অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক এই প্রচারণা তাঁর জন্য লাভজনক সম্ভাবনা তৈরি করে। আন্দুরিল এরই মধ্যে সিবিপির সঙ্গে মোটা অঙ্কের চুক্তি করেছে। এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নজরদারির জন্য ১৮৯টি স্বয়ংক্রিয় টাওয়ার বসেছে।

এআই নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তাদের জন্য এই এলাকা এখন তীর্থভূমি। আর এ বছর টেক্সাসের এল পাসোতে অনুষ্ঠিত বর্ডার সিকিউরিটি এক্সপোতে রোবট ডগ ও অন্যান্য প্রযুক্তির মতো আন্দুরিলের নজরদারির প্রযুক্তি সবার নজর কাড়ে। আমরা কি তাহলে ‘স্বার্থসংশ্লিষ্ট জিনিস’কে এখন স্বচ্ছন্দে ‘ভয়ংকর’ শ্রেণিভুক্ত করতে পারি?

দ্য বর্ডার ক্রনিকলের সহপ্রতিষ্ঠাতা পড মিলার। সীমান্তকেন্দ্রিক হাজার কোটি ডলারের ব্যবসাকে কাছ থেকে দেখছেন তিনি। গত মে মাসে অনুষ্ঠিত বর্ডার সিকিউরিটি এক্সপোতে তিনিও হাজির ছিলেন। এরপর এক ই-মেইলে তিনি আমাকে বলেন, সীমান্ত সুরক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আলোর চেয়েও দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। মিলার দুঃখ করে বলছিলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এগোচ্ছে তীব্র গতিতে। কোথাও ঠেকছে না সে। এটি এখন ‘সর্বঘটে কাঁঠালি কলা’ হয়ে গেছে, সবকিছুতেই এর ব্যবহার হচ্ছে।

নজরদারির জন্য টাওয়ার, মুখমণ্ডল শনাক্তকরণ সফটওয়্যার এবং অন্যান্য এআইনির্ভর প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ার আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত যথেষ্ট বর্বর।

গত এপ্রিলে সিউডাডওয়ারেজ সীমান্ত দিয়ে আমার এই তরুণ বন্ধুটি এল পাসোতে এসে পৌঁছান। টেক্সাসে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কর্মকর্তারা তাঁকে ছয় দিন আটকে রাখেন। আমার বন্ধু পরে আমাকে বলেন, তাঁরা (অভিবাসন কর্মকর্তারা) তাঁর সঙ্গে কুকুরের মতো আচরণ করেছেন। ডিটেনশন সেন্টারে (অবৈধ অভিবাসীদের প্রথমেই যেখানে রাখা হয়) সাত দিন আটকে রাখলেও আমার ওই বন্ধুকে গোসল করতে দেওয়া হয়েছিল মাত্র একবার।

ভেনেজুয়েলায় আমার এক বন্ধু আছেন জোহান নামে। গত এপ্রিলে সিউডাডওয়ারেজ সীমান্ত দিয়ে আমার এই তরুণ বন্ধুটি এল পাসোতে এসে পৌঁছান। টেক্সাসে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কর্মকর্তারা তাঁকে ছয় দিন আটকে রাখেন। আমার বন্ধু পরে আমাকে বলেন, তাঁরা (অভিবাসন কর্মকর্তারা) তাঁর সঙ্গে কুকুরের মতো আচরণ করেছেন।

ডিটেনশন সেন্টারে (অবৈধ অভিবাসীদের প্রথমেই যেখানে রাখা হয়) সাত দিন আটকে রাখলেও আমার ওই বন্ধুকে গোসল করতে দেওয়া হয়েছিল মাত্র একবার। তারপর হাতকড়া পরিয়ে তাঁকে মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে আরিজোনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জীবন ও ভালো থাকার চেষ্টাকে ঝুঁকিতে ফেলতে আমেরিকা এখন এ কাজই করছে। একে বলা হয় অভিবাসী ঠেকাও নীতি।

এ ঘটনাগুলো যারা ঘটাচ্ছে, তারা রক্তমাংসের মানুষ। আপাতদৃষ্টে অফুরান সহানুভূতির আধার তারা। যদি অভিবাসনের ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি যন্ত্রের হাতে চলে যায়, তাহলে কী হবে? উদ্বেগের কারণ ওখানেই।

এদিকে, এআইয়ের রমরমা ব্যবসা ও সাধারণভাবে সীমান্তের সামরিকীকরণের বলি শুধু অভিবাসনপ্রত্যাশীরা নন। মিনিয়াপোলিসে ৪৬ বছর বয়সী নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। সে সময় সিবিপি প্রিডেটর ড্রোন মোতায়েন করে।

মাঝেমধ্যে মনে হয় সীমান্ত সে জায়গাই, আমেরিকা যাকে সীমান্ত বলছে। প্রযুক্তির কোনো বস্তুগত বা নৈতিক সীমারেখা নেই। সে স্রোতেই আমরা গা ভাসাচ্ছি। এ পরিস্থিতি বিপজ্জনক তো বটেই।

আল জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: শেখ সাবিহা আলম

  • বেলেন ফার্নান্দেজ মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক।