ইরানে বোমা মেরে সরকার ফেলে দেওয়ার যুগ আর নেই

ইরানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদে তেহরানে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভছবি : রয়টার্স

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যে বিমান হামলা চালিয়েছে, তাতে আসলে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত জুনে ন্যাটো সম্মেলনে দাঁড়িয়ে গর্ব করে বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস, এটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।’

তবে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান হয়তো কয়েক মাসের মধ্যেই আবার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কাজ শুরু করতে পারবে। একই ধরনের মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসি।

একটি বিষয় মোটামুটি নিশ্চিত; তা হলো, এই বিশাল মার্কিন-ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ ইরানের জনগণকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উসকে দিতে পারেনি। কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেই ফলাফলটিই আশা করেছিলেন। এমনকি ট্রাম্প নিজেও বলেছিলেন, ‘এই সরকার যদি ইরানকে আবার মহান করতে না পারে, তাহলে সরকার পরিবর্তনই সঠিক সমাধান’। তবে তিনি বলেননি, সেই পরিবর্তনটা দেশীয়ভাবে হবে, নাকি বাইরের থেকে চাপ দিয়ে ঘটানো হবে।

সাধারণ জনগণের ওপর বোমা ফেললে তারা ভয় পেয়ে সরকারবিরোধী হয়ে উঠবে এবং নিজেরা বাঁচতে তারা সরকারকে টেনে নামাবে—এটি বহু পুরোনো একটি চিন্তা। সময়ের পরীক্ষায় এই ধারণা বারবার ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

১৯৩৭ সালে স্পেনে গৃহযুদ্ধের সময় জার্মানি ও ইতালির বাহিনী যখন গোয়ের্নিকা শহর বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, তখনো জনগণের মনোবল ভাঙেনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ব্রিটেনে যে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন, কিংবা মিত্রশক্তি নাৎসি জার্মানির শহর ধ্বংস করে দিয়েছিল—তাতেও সাধারণ মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি।

একইভাবে, ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে উত্তর ভিয়েতনামে ‘অপারেশন রোলিং থান্ডার’ নামের ব্যাপক বোমাবর্ষণ চালানো হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও এই তত্ত্ব ব্যর্থ হয়েছিল। এখন গাজায় ইসরায়েল যে বিমান হামলা চালাচ্ছে, তাতেও একই ফলাফল দেখা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন
‘কেউ যদি ইরানের বাইরে বসে আমাদের বলে ওঠো, বিদ্রোহ করো—তা আমি মানব না। ইরান আমার দেশ। কী করব বা কী করব না, সে সিদ্ধান্ত আমি নেব। তুমি আমাকে শেখাবে না, আমার দেশে আমি কী করব।’

এই ধরনের যুদ্ধনীতিকে বলা হয় স্ট্র্যাটেজিক বোম্বিং বা স্যাচুরেশন বোম্বিং বা টেরর বোম্বিং। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ইতালির জেনারেল জুলিও দৌহে এই কৌশলটি প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই নির্মম বোমা হামলাগুলোর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে পড়েন দুইজন। একজন হলেন, ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের বোম্বার কমান্ড প্রধান আর্থার ‘বম্বার’ হ্যারিস এবং অন্যজন হলেন, মার্কিন বিমানবাহিনীর জেনারেল কার্টিস এমারসন লে’মে।

জেনারেল লে’মে ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে জাপানের বহু শহর একেবারে ধ্বংস করে দেন এবং লক্ষাধিক বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেন। পরে তিনি নিজেই বলেন, ‘যদি আমেরিকা এই যুদ্ধে হারত, তাহলে আমাকেই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হতো।’

এই ইতিহাসগুলো দেখায়, সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করে তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার এবং তাদের সরকারবিরোধী বানানোর পরিকল্পনা যতবারই নেওয়া হয়েছে, ততবারই তা ব্যর্থই হয়েছে। বরং এই ধরনের কৌশল বর্বরতা ও যুদ্ধাপরাধের নামেই বেশি পরিচিতি পেয়েছে।

কৌশলগত বোমাবর্ষণ বা পরিকল্পিতভাবে শহরের ওপর ব্যাপক বিমান হামলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু শহরকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। ব্রিটিশ কমান্ডার আর্থার হ্যারিস অনেক ‘বোচ’ (জার্মানদের জন্য অবজ্ঞাসূচক একটি শব্দ) হত্যা করতে চেয়েছিলেন এবং তা তিনি অনেকাংশে করতে পেরেওছিলেন। কিন্তু এই কৌশল যতই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হোক না কেন, তা কোনো সময়েই জনতার বিদ্রোহ ঘটাতে পারেনি। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলার পর জাপানে আমরা কোনো সরকারবিরোধী গণ-আন্দোলন দেখিনি।

আরও পড়ুন

অনেক সময় এই ধরনের বোমাবর্ষণ উল্টো ফল দেয়। এতে মানুষ আরও রেগে যায় এবং এমনকি খুবই অজনপ্রিয় সরকারের পক্ষেও জনসমর্থন জোগাতে শুরু করে। ১৯৪১ সালে জার্মান বাহিনী লন্ডনের ওপর যখন বিমান হামলা চালায়, তখন লন্ডনবাসী আরও জেদি হয়ে উঠেছিল। তারা আরও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, তাদের শহর এই আক্রমণ সহ্য করে টিকে থাকবে। উইনস্টন চার্চিল তখন জনপ্রিয় ছিলেন; কিন্তু এই প্রতিক্রিয়া শুধু তাঁর জনপ্রিয়তার কারণে হয়নি। একই ধরনের দৃঢ়তা দেখা গিয়েছিল বার্লিনেও। জার্মানিতে হামলার পর মিত্রবাহিনীর ওপর এমন জার্মান লোকও খেপে গিয়েছিলেন যিনি হিটলারকে ঘৃণা করতেন।

আসলে বেশির ভাগ মানুষই চায় না, বিদেশি শক্তি এসে তাদের দেশকে বোমা মেরে ধ্বংস করুক। এমনকি যদি তারা নিজেদের সরকারকে অপছন্দও করে, তা হলেও তারা তা চায় না।

এটি বিশেষভাবে ইরানের মতো একটি গর্বিত দেশের ক্ষেত্রে খাটে। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহায়তায় ইরানে একটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল। সেই অভ্যুত্থান একটি নবীন গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এরপর থেকে ইরানিদের মনে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি সন্দেহ থেকেই গেছে।

এই পরিস্থিতিতে কল্পনা করা খুব কঠিন যে, ইরানিরা হঠাৎ করে ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ বা ‘মাগা’র অনুকরণে ‘মেক ইরান গ্রেট অ্যাগেইন’ বা ‘মিগা’ স্লোগানকে গ্রহণ করবে। আর নেতানিয়াহুকে রাজনৈতিক ত্রাণকর্তা বা উদ্ধারকর্তা হিসেবে দেখা? সেটা তো আরও অবাস্তব চিন্তা।

নিশ্চিতভাবেই, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা দুর্বল করা একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। লেবানন ও সিরিয়ায় ইরানের মিত্র গোষ্ঠীগুলোর ওপর ইসরায়েল যে হামলা চালিয়েছে, সেটিও হয়তো ভালো একটি পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সামরিক হস্তক্ষেপের পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, বোমাবর্ষণের মাধ্যমে কখনোই গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনা যায় না।

অনেকে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও জাপান হেরে যাওয়ার পর তারা যেভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছিল, সেটি একটা ব্যতিক্রমী উদাহরণ। তবে সেই রূপান্তরের পেছনে শুধু বোমাবর্ষণ কাজ করেছিল—এমনটা নয়। আসলে যুদ্ধের পর এই দেশগুলোর ভেতরের প্রভাবশালী মানুষেরা মিত্রবাহিনীর ছায়ায় গণতন্ত্র গড়েছিলেন।

আজ কেউই বলছেন না, ইরানকে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল দখল করে রাখুক। আর যদি দখল করেও, তাতে জার্মানি বা জাপানের মতো ফল হবে—এটা ভাবাও অবাস্তব।

ইরানে এখন যে কড়াকড়িভাবে ধর্মভিত্তিক সরকার চলছে, সেটি অনেকেরই পছন্দ নয়। ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ গণতান্ত্রিক সরকার চায়। তাই যদি ইরানের সরকার কখনো বদলায়, সেটা শুধু ইরানিদের হাতেই বদলাবে। বাইরের চাপিয়ে দেওয়া শক্তি দিয়ে সেটি হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের কিছু সামরিক দুর্বলতা ধরা পড়লেও এই হামলা ইরানের সাধারণ মানুষের আন্দোলনকে দুর্বল করে দিতে পারে। কারণ, বাইরের হামলা অনেক সময় দেশের ভেতরে সরকারবিরোধী শক্তিগুলোর প্রতি সন্দেহ তৈরি করে, আর সরকার তখন সেই সুযোগে আরও দমন-পীড়ন চালায়।

ইরানের বিখ্যাত অভিনেতা রেজা কিয়ানিয়ানের প্রতিক্রিয়া থেকে বিষয়টি ভালোভাবে বোঝা যায়। তিনি ২০২২ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলনের একজন দৃঢ় সমর্থক ছিলেন এবং সরকারের কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত। তাই ধরে নেওয়া যায়, তিনি অবশ্যই একটি গণতান্ত্রিক ইরান দেখতে চান। কিন্তু যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ইরানে বোমা ফেলা শুরু করল, তখন তাঁর কাছে দেশপ্রেম বড় হয়ে উঠল। তিনি ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বললেন, ‘কেউ যদি ইরানের বাইরে বসে আমাদের বলে ওঠো, বিদ্রোহ করো—তা আমি মানব না। ইরান আমার দেশ। কী করব বা কী করব না, সে সিদ্ধান্ত আমি নেব। তুমি আমাকে শেখাবে না, আমার দেশে আমি কী করব।’

আরও পড়ুন

তাঁর এই কথার মধ্যে বিদেশি হস্তক্ষেপ নিয়ে একটি ন্যায্য ক্ষোভ আছে। কিন্তু যদি ইরানের জনগণ আরও শক্তভাবে ঠিক করে নেয় যে, তারা ভেতর থেকে পরিবর্তন চায় তাহলে এই মনোভাব হয়তো খুব তাড়াতাড়িই বদলে যেতে পারে। কোনো শাসক চাপের মুখে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা আগে থেকে বলা যায় না। তবে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, ইরানের সরকার বরং আরও বেশি কঠোর হয়েছে। তারা ‘দেশদ্রোহী’ বা বিরোধীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন বাড়িয়েছে।

এদিকে, ইরানের সামরিক দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়ার ফলে সরকারের ভেতর থেকে আরও জোর দিয়ে পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা বাড়তে পারে। এটা নিঃসন্দেহে এমন কিছু নয়, যা নেতানিয়াহু বা ট্রাম্প চেয়েছিলেন। এমনকি ইরানের সাধারণ মানুষও এটা চায় না। কিন্তু বাইরের চাপ আর ভেতরের নিরাপত্তাহীনতা মিলিয়ে সরকার হয়তো এখন আরও বেশি আগ্রাসী পথে এগোবে।

প্রজেক্ট সিন্ডিকেট: ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

ইয়ান বুরুমা ডাচ-ব্রিটিশ লেখক।