একই জগতে ফিলিস্তিনি–ইসরায়েলিদের বাস সম্ভব?

পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলি সমর্থকফাইল ছবি: এএফপি

বিজ্ঞান লেখক এড ইয়োং তাঁর পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী অ্যান ইমেন্স ওয়ার্ল্ড: হাউ অ্যানিম্যাল সেন্সেস রিভিল দ্য হিডেন রিয়ালম অ্যারাউন্ড আস বইয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে স্তন্যপায়ী প্রাণী, মাছ, কীটপতঙ্গ—সবাই ‘নিজেদের বানানো সংবেদনশীল বলয়ের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ করে এবং সুবিশাল জগতের মধ্যে নিজের রচিত ছোট্ট জগতে আটকা পড়ে থাকে। সেই সংবেদনশীল বুদ্‌বুদটি হলো প্রাণীর নিজস্ব পরিবেশ। এই পরিবেশ-প্রতিবেশ হলো সেই পারিপার্শ্বিকতার অংশ, যা একটি প্রাণী নিজের মতো করে টের পায় বা অনুভব করতে পারে। তার এই জগৎ হলো উপলব্ধিমূলক জগৎ।’

লেখক আমাদের জানাচ্ছেন, দুই জাতের প্রাণী একই ভৌত স্থানে অবস্থান করেও সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে থাকে। এই তত্ত্বকে ধ্রুব বলে মেনে নিলে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওঠে: তাহলে কি সব মানুষ একই উপলব্ধিমূলক জগতে থাকে? নাকি আমরা অন্য জীবের মতো অভিন্ন উপলব্ধিমূলক জগতে থাকতে অক্ষম?

আরও পড়ুন

একটি প্রাণীর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ তার ইন্দ্রিয়ের বৈশিষ্ট্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, হাঙর সমুদ্রের মাইল মাইল দূরে থাকা শিকারকে শনাক্ত করতে ঘ্রাণশক্তিকে ব্যবহার করে। শিকারটি যখন তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে এসে যায়, তখন শিকারটির গতি শনাক্ত করতে হাঙরটি একটি সংবেদনশীল অঙ্গ ব্যবহার করে। একেবারে শেষ মুহূর্তে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে সে একধরনের বৈদ্যুতিক স্পন্দন ব্যবহার করে।

পাখির ক্ষেত্রে দেখা যায়, পাখিরা একে অন্যের পালকের ওপর আলাদা আলাদা ধরনের আলট্রাভায়োলেট চিহ্ন দেখতে পায়। এর ফলে আমাদের কাছে এক জাতের সব পাখির চেহারা একই রকমের মনে হলেও পাখিরা সহজেই নিজেদের আলাদা করতে পারে। বাদুড় ইকোলোকেশনের মাধ্যমে বিশ্বকে ‘দেখে’। অন্যদিকে কিছু মাছ চলাচলের জন্য দৃষ্টিশক্তির বদলে ‘ইলেকট্রোলোকেশন’ ব্যবহার করে।

একই বস্তুকে ভিন্নভাবে দেখা এবং উপলব্ধি করার বিষয়টি মানুষের ক্ষেত্রেও হয়। যে বস্তুকে একজনের কাছে ধূসরমতো সবুজ মনে হয়, আরেকজনের কাছে সেটিকে সবুজাভ ধূসর রঙের মনে হতে পারে।

আরও পড়ুন

এমনও হতে পারে, আমাদের একজনের ভৌগোলিক, সংস্কৃতি, জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা, সংবাদ আদান–প্রদানের পরিবেশ এবং পারিবারিক ইতিহাস আরেকজনের তুলনায় এতটাই ভিন্ন হতে পারে যে আমাদের সংবেদনশীল বুদ্‌বুদের মতো বলয়ে থাকা মানুষের এসব অভিজ্ঞতা অন্য বলয়ে থাকা গোষ্ঠীর পক্ষে উপলব্ধি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

কিন্তু এটি কি সম্ভব যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিংবা একটি বড় সংকটের ফলে একই বিশ্বের ভিন্ন উপলব্ধিগুলো অভিন্ন উপলব্ধির জগতে প্রবেশ করতে পারবে? যদি সেটি কোনো দিন সম্ভব হয়, তাহলে তা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাত অবসান ঘটাতে পারবে। একই বিষয়কে ভিন্ন চোখে দেখার প্রবণতা ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের মধ্যে এতটাই প্রকট যে স্পষ্টতই তারা দুটি ভিন্ন উপলব্ধির বুদ্‌বুদ বা বলয়ের মধ্যে বাস করে আসছে।

অনেক ইহুদি আছেন, যাঁদের উপলব্ধিতে শুধু হুমকিই আছে। শতাব্দীপ্রাচীন বঞ্চনার বেদনা, নিপীড়ন ও গণহত্যার ইতিহাস তাদের উপলব্ধির জগৎকে সেভাবে তৈরি করেছে।

ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা উভয়েই তাদের পরিবারকে, তাদের সম্প্রদায়কে ও তাদের সংস্কৃতিকে ভালোবাসে। তাদের একটি বড় অংশই হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চায় না। তাদের একটি বড় অংশ শান্তি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে থাকতে চায়।

একইভাবে অনেক ফিলিস্তিনির উপলব্ধির জগৎ নির্যাতন, দখলদারি ও উচ্ছেদ আতঙ্কে পূর্ণ হয়ে আছে। যেহেতু তারা উভয়ই একই ইন্দ্রিয়ের অধিকারী এবং একই ধরনের ট্রমা ও বঞ্চনাবোধ বহন করছে, সেহেতু জোর চেষ্টা করলে তাদের মধ্যে অভিন্ন একটি ঐক্যের অনুভূতি জাগিয়ে তোলা সম্ভব বলে আশা করা যেতে পারে।

ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা উভয়েই তাদের পরিবারকে, তাদের সম্প্রদায়কে ও তাদের সংস্কৃতিকে ভালোবাসে। তাদের একটি বড় অংশই হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চায় না। তাদের একটি বড় অংশ শান্তি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে থাকতে চায়। অর্থাৎ যার যার দিক থেকে উভয়ের ইচ্ছা এক। সুতরাং তাদের একই উপলব্ধির জগতে আনা অসম্ভব নয়। এর জন্য উভয় শিবিরকে বলতে হবে, ‘আমরা তোমাদের কথা মেনে নেব, তোমরাও আমার কথা মেনে নাও’।

● অ্যান মারি স্লটার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতি পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক পরিচালক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনূদিত