ট্রাম্প–কমলা লড়াইয়ে ইরান কতটা প্রাসঙ্গিক

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস

নির্ঘাত মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর রানিং মেট হিসেবে এমন একজনকে বেছে নিয়েছেন, যিনি আইডিয়া বা তত্ত্বকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেন।

জে ডি ভ্যান্স নামের ওই রানিং মেট তাঁর সংক্ষিপ্ত কর্মজীবনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি যদিও তিনি এখন ট্রাম্পের অনুগত ‘আক্রমণকারী কুকুর’ হিসেবে কাজ করছেন; তবে ইতিপূর্বে তাঁর খোদ ট্রাম্পকেও আক্রমণ করার রেকর্ড রয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকানদের এই অসংগতিগুলোকে নির্বাচনী প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করবেন। 

অন্যদিকে অনেকটা ভবিষ্যদ্বাণীর মতো করেই বলা যায়, রিপাবলিকানরা ‘তোতলা’ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলবেন।

কিন্তু উভয় পক্ষই যখন আমেরিকার সবচেয়ে বড় পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে বাধ্য হবে, তখনই তাদের মূল ‘সত্যের মুহূর্ত’ মোকাবিলা করতে হবে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যখন ২৪ জুলাই (গতকাল বুধবার) কংগ্রেসের একটি যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন, তখন সেই মুহূর্তটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

যদিও ভ্যান্স নানা দিক থেকে ট্রাম্পের থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। কিন্তু তাঁরা দুজনই নেতানিয়াহুর কঠোর অবস্থানের গোঁড়া সমর্থক। বিশেষ করে হামাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে নেতানিয়াহুর নীতির সঙ্গে তাঁরা দুজনই একমত।

নেতানিয়াহুর বক্তৃতার প্রতিক্রিয়া জানাতে বাইডেন ও হ্যারিস দুজনকেই সতর্ক থাকতে হবে। যে ইহুদিরা সাধারণত ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিয়ে থাকেন, তাঁদের একটি অংশকে ট্রাম্প আকৃষ্ট করতে পারেন। 

তবে গ্যালাপের জরিপে দেখা যাচ্ছে, যত সংখ্যক ইহুদি ট্রাম্পকে সমর্থন দিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিম এমনকি অনেক ইহুদিও নেতানিয়াহুর কঠোর অবস্থানের বিরোধিতা করেন।

তবে এই শ্রেণির লোকদের মধ্যে অনেকেই গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করতে বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতায় হতবাক হয়েছেন। এই গ্রুপটি ট্রাম্পকে ভোট দেবে না। তারা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। এটি সুইং স্টেটগুলোতে, অর্থাৎ দোদুল্যমান ভোটার অধ্যুষিত অঙ্গরাজ্যগুলোতে ভোটের ব্যবধান বাড়াতে পারে। 

লক্ষণীয় বিষয় হলো, সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলও মার্কিন নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানও এই বিচ্ছিন্ন ভোটারদের ডেমোক্রেটিক শিবিরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন।

গত মে মাসে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি মারা যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া পেজেশকিয়ান রাইসির মতো কট্টর ধর্মীয় অনুশাসনের অনুসারী নন। তিনি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েননি। পড়েছেন মেডিকেল স্কুলে। তিনি তাব্রিজ শহরে ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। 

২০০১ এবং ২০০৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি পার্লামেন্টের প্রথম ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। একাডেমিক, জনপরিষেবা এবং নির্বাচনী রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর মতো জ্ঞান রাখা বিচক্ষণ রাজনীতিক বর্তমানে বিশ্বে খুব কমই আছেন। ব্যালটে তাঁর নাম ছাপা হওয়ার আগেই তাঁর প্রার্থিতাকে ইরানের শুরা কাউন্সিল অনুমোদন করেছিল।

বিগত ৪০ বছরে শুরা কাউন্সিল তার বিশেষাধিকার নানাভাবে প্রয়োগ করেছে এবং প্রায়ই এই কাউন্সিল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি কাউন্সিলের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ব্যবহার করে কট্টরপন্থী রাইসিকে (অন্য পাঁচজন ধর্মীয় চরমপন্থীসহ) শীর্ষ পদে মনোনীত করেছিলেন। 

২০২০ সালে খামেনির বয়স ছিল ৮১ বছর। সে কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এমন একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চাওয়ার কথা যিনি তাঁর (খামেনির) মৃত্যুর পর কট্টর মৌলবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী একজন সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে পারবেন।

মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় রাইসির মৃত্যুর পর জীবনসায়াহ্নে উপনীত হওয়া খামেনি (বর্তমানে ৮৫ বছর বয়সী) জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানেও তিনি তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে এমন একজন অতি-ধর্মীয় ব্যক্তিকে নির্বাচন করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, যিনি তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন।

এই পটভূমিতে পেজেশকিয়ানের ব্যালটে জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই বলে মনে হচ্ছিল। তবে শুরা কাউন্সিল আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এ ক্ষেত্রে ২০২২ সালে জনসমক্ষে ঠিকমতো হিজাব না পরায় মাসা আমিনি নামের এক তরুণীর আটক হওয়া এবং পুলিশ হেফাজতে তাঁর মৃত্যুর ঘটনা ভূমিকা রেখেছে। মাসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছিল এবং সরকার শত শত বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে সেই বিক্ষোভের জবাব দিয়েছিল। 

রাইসির মৃত্যুর ঘটনায় ফুলেফেঁপে ওটা বিদ্রোহ শুরা কাউন্সিলের সদস্যদের এই হুঁশিয়ারি দিয়েছিল যে কাউন্সিলের ধর্মীয় চরমপন্থী সদস্যরা যদি আগেরবারের মতো আবার ব্যালটে একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং রাইসিকে যেভাবে গত মেয়াদে সাজানো কায়দায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়েছিল, সেই একই কায়দা অবলম্বন করে উদারপন্থী প্রার্থীদের বাদ দেওয়া হয়, তাহলে তা দেশকে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। এই ভয়াবহ সম্ভাবনার মুখোমুখি হয়ে কাউন্সিল সদস্যরা নতি স্বীকার করেছেন এবং পেজেশকিয়ানকে খামেনির পাঁচজন নেতৃস্থানীয় অনুসারীর বিরুদ্ধে লড়াই করার অনুমতি দিয়েছেন। 

উদারপন্থী ইরানিদের সামনে এটি বড় সুযোগ হয়ে এসেছে এবং ৬৯ বছর বয়সী পেজেশকিয়ানকে তারা জয়যুক্ত করেছেন। জয়ী হওয়ার পর পেজেশকিয়ান সতর্কভাবে তাঁর ভবিষ্যৎ কার্যক্রম ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি স্পষ্ট করেছেন, খামেনির মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছামতো একজন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীকে খামেনির জায়গায় বসানোর কোনো ইচ্ছা নেই। পরিবর্তে তিনি বলেছেন, সব ইরানির নিজের জীবনের অর্থ নির্ধারণের অধিকার রয়েছে। এর অর্থ হলো, তিনি যেকোনো সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচনকে সমর্থন করবেন। 

পেজেশকিয়ানের বর্তমান উদ্দেশ্য আরও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তেহরান টাইমস-এ ইংরেজিতে প্রকাশিত ‘নতুন বিশ্বের কাছে বার্তা’ শিরোনামে একটি বার্তা দিয়েছেন। এতে পেজেশকিয়ান ঘোষণা করেছেন, তিনি উত্তেজনা দূর করার আন্তরিক চেষ্টাকে স্বাগত জানাবেন এবং সদিচ্ছার প্রতিদান সদিচ্ছা দিয়েই দেবেন। এটি ইরানের জন্য মার্কিন বাজার পুনরায় খুলে দেওয়ার বিনিময়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের অনুমতি দিতে এবং এর মাধ্যমে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি কমাতে তাঁর সদিচ্ছার ইঙ্গিত দেয়। 

এটি আমেরিকানদের সামনে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনার পথে একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য একটি নতুন পথের ঘোষণা দিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যে অবস্থান নিয়েছেন, সেটিও এতে সংহত হতে পারে। 

ব্রুস অ্যাকারম্যান ইয়েল ইউনিভার্সিটির আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ