পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কি বিলাওয়াল ভুট্টো?

বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি
ছবি: রয়টার্স

বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি (৩৪) লেখাপড়া করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতি। পরিবারের রাজনৈতিক ঐতিহ্য, নেতৃত্বগুণ এসব কিছু মিলে বিলাওয়াল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বিলাওয়াল (এপ্রিল ২০২২—আগস্ট ২০২৩) তাঁর অবস্থানকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। বিলাওয়াল ভুট্টোর নেতৃত্বগুণ এবং তাঁর কর্মকাণ্ড প্রমাণ করেছে যে তিনি জটিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বুঝতে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। তিনি পাকিস্তানের স্বার্থ দেখেছেন এবং বিশ্বমঞ্চে পাকিস্তানকে তুলে ধরেছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বিলাওয়াল দায়িত্ব পালন করেছেন খুব অল্প দিনই। এর মধ্যেই তিনি আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে জোরালো বন্ধনের লক্ষ্যে কাজ করেছেন। পাকিস্তানের উন্নয়ন এবং নিরাপত্তার জন্য বিলাওয়াল সব সময় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

ভারত, আফগানিস্তান ও ইরানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে বিলাওয়াল শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। চীন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টায় পাকিস্তান লাভবান হয়েছে। কারণ, দেশটিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বিলাওয়াল অর্থনীতিনির্ভর কূটনীতির প্রয়োগ করেছেন। কারণ, তিনি বুঝেছিলেন দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী অর্থনীতির প্রয়োজন।

বিলাওয়াল মানবাধিকার রক্ষায় যত্নবান ছিলেন। পাকিস্তানে পিপিপির মানবাধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার রেকর্ড আছে। বিলাওয়াল ভুট্টো মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বালুচ ও পশতুনদের সমর্থন দিয়ে এসেছেন। তিনি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছেন। তিনি বৈশ্বিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের, বিশেষ করে কাশ্মীর ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে জোর গলায় কথা বলেছেন। পাকিস্তানের অবস্থান তিনি পরিষ্কার করেছেন। তিনি জাতিসংঘ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে বোঝাতে চেয়েছেন বৈশ্বিক ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থান কী হবে।  

পাকিস্তানের অর্থনীতিতে দরকার প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা। বিলাওয়াল প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর জন্য আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়া, বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বান এবং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক নীতির বাস্তবায়ন ও পাকিস্তানের ক্রমাবনতিশীল অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বা জোটগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়েই ছিলেন। বিলাওয়াল সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মুসলিম বিশ্ব, চীন এবং অন্যান্য ক্ষমতাধর দেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছেন। তা ছাড়া আঞ্চলিক বিরোধ নিরসনেও তিনি কাজ করেছেন। আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা কিংবা ইরানের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তিনি ভারতের সঙ্গেও উত্তেজনা কমিয়ে এনেছেন।  

পাকিস্তানের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে বিলাওয়ালের পরিষ্কার ধারণা আছে, সেই সঙ্গে তাঁর কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে একজন যোগ্য নেতায় পরিণত করেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও কাজ করতে পারবেন।

তবে বিলাওয়ালের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভারতের সঙ্গে কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিরোধ। দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাশ্মীর নিয়ে বিরোধের সমাপ্তি তাঁকে ঘটাতে হবে। কারণ, কাশ্মীরকে ঘিরে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আরও পড়ুন

আঞ্চলিক যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিকে ভারত ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। পাকিস্তানের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেওয়া প্রয়োজন। আফগান তালেবানের উত্থান ওই অঞ্চলের জঙ্গিদের, বিশেষ করে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান প্রভিন্সকে উৎসাহ দিয়েছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তে তাদের উপস্থিতি এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি।  

জঙ্গিবাদের ঝুঁকি এড়াতে আফগান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বিলাওয়াল ভুট্টোর জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বিলাওয়ালকে এই সম্পর্ক স্থিতিশীল করতে হলে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে।

আরও পড়ুন

ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কে চিড় ধরে। পাকিস্তানের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই ইরানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং স্থিতিশীল সম্পর্ক দরকার। ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন খুব জরুরি, বিশেষত বাণিজ্য ও জ্বালানিবিষয়ক সহযোগিতা দরকার তাঁদের। ইরান তেলসমৃদ্ধ দেশ। পাকিস্তান ইরানের কাছ থেকে সস্তা ডিজেল, গ্যাসোলিন এবং তেল নয়, এমন পণ্য থেকে লাভবান হতে পারে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মোকাবিলাও বিলাওয়ালের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

পাকিস্তানের অর্থনীতিতে দরকার প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা। বিলাওয়াল প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর জন্য আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়া, বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বান এবং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক নীতির বাস্তবায়ন ও পাকিস্তানের ক্রমাবনতিশীল অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিলাওয়াল ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপিপি ভবিষ্যতে সরকার গঠন করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দৃশ্যপট যেকোনো সময় বদলে যেতে পারে আর নির্বাচনের ফলাফল নানা বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। তবে বিলাওয়াল ভুট্টোর নেতৃত্বে পিপিপি পাকিস্তান পরিচালনায় প্রস্তুত, এ কথা বলাই যায়।

রাহিম নাসার ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক