বাংলা ভাষার প্রসার: উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন হবে

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উন্নয়নের সমার্থক মনে করা হয়েছে বহু দশক ধরে। অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ‘উন্নয়ন অর্থ হচ্ছে স্বাধীনতা, যার মাধ্যমে প্রত্যেকে যা হতে চায় বা করতে চায়, তা সম্ভব হবে।’ এই স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন শ্রেণিভেদে সবার সর্বাঙ্গীণ আত্মবিকাশ, যার ভিত্তি হবে নিজস্ব ভাষায় আত্মপ্রকাশের দক্ষতা। সেই সঙ্গে প্রয়োজন বৈষম্যহীনভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার, মানসম্মত কর্ম নিয়োজন ও উপার্জন কাজে নিয়োজনের অধিকার। বর্তমান যুগে এসব বিষয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত প্রযুক্তির অগ্রগতি।

সুশিক্ষিত ও বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে বহুকাল থেকেই লালিত হয়েছে। এই স্বপ্ন থেকেই জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। দেশ হিসেবে ও মানুষ হিসেবে উন্নয়নের জন্য জীবনের মৌলিক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার অর্জনের প্রয়োজন এ দেশে স্বীকৃত। সেই স্বীকৃতির ভিত্তি রচিত হয়েছিল ভাষার জন্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

এখন প্রয়োজন বাংলা ভাষার প্রসার ঘটিয়ে ভাষাকে আরও গতিশীল করা এবং এই ভাষাকে জীবনের সব প্রয়োজন মেটানোর জন্য ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন। একটি ভাষা গতিশীল ও উন্নততর পর্যায়ে যেতে পারে, যখন তা প্রতিদিনের জীবনযাপনের, উপার্জন কাজের এবং বিনোদনের বাহক ও ধারক হয়।

লেখাটিতে শুধু একটি বিষয় পর্যালোচনা করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভাবের সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রসার ও এই ভাষায় দক্ষতা উন্নয়নের কোনো বিরোধ রয়েছে? উপার্জন কাজের জন্য বাংলা দক্ষতা কতটা জরুরি বা সহায়ক? সেখানে কোনো সমস্যা থাকলে সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়? নাকি ধীরে ধীরে আমাদের প্রাণের ভাষা পেছনে পড়ে থাকবে অচল হয়ে, শুধু কিছু সাহিত্যের ছাত্র-শিক্ষক-লেখকদের মধ্যে সীমিত হয়ে?

প্রথমেই বলা দরকার, প্রসঙ্গটি কেন উঠছে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্ন দেশের পরস্পর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। বাড়ছে আন্তর্জাতিক লেনদেন। শুধু দ্রব্যসামগ্রী নয়, মানুষকে যেতে হয় দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশে। প্রযুক্তির বিনিময় ঘটছে।

বাংলাদেশের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে নতুন দিগন্ত, সেখানে “উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি”(emerging economy) হিসেবে এ দেশের নাম উঠে আসছে। বৃহৎ অর্থনীতি হওয়ার জন্য কি বাংলা ভাষাকে অবহেলা করে সবাই আরও একটি-দুটি বিদেশি ভাষা শিখব? সে রকম আত্মঘাতী পথে যাওয়ার আগেই ভাবতে হবে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বাংলা ভাষার প্রসার একে অপরকে কীভাবে আরও শক্তিশালী করতে পারে।

বাংলা ভাষার প্রসারের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অনেক অর্থনৈতিক কাজের সুযোগ তৈরি হতে পারে, যদি সে উদ্দেশ্যে সক্রিয় প্রয়াস নেওয়া হয়। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক।

১. শিক্ষা ক্ষেত্রে, বিশেষত উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যম প্রসারের জন্য বহুসংখ্যক পাঠ্যবই ও আকরগ্রন্থ অনুবাদের প্রয়োজন হবে।

২. বিভিন্ন খাতে বাংলাতে কম্পিউটারপ্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য নতুন সফটওয়্যার তৈরির কাজ থাকবে। বাংলা ভাষায় কম্পিউটারপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রতিষ্ঠান দরকার হবে।

৩. বৃহৎ অর্থনীতি হওয়ার পথে অগ্রগতি হতে থাকলে দেশের পণ্যের জন্য দেশের ভেতরে চাহিদা বাড়বে। সেগুলোর উৎপাদন, বিপণনের জন্য তো বিদেশি ভাষার মাধ্যম প্রয়োজন নেই।

৪. বাংলা ভাষার দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম, যেমন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, প্রচার, প্রকাশনা ইত্যাদি চলতে থাকলে সেখানেও বাংলায় দক্ষ ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।

৫. অর্থনীতির আকার বাড়লে, রপ্তানি বাণিজ্য বাড়লে, বিদেশিদের আনাগোনা ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে। বিদেশিদের মধ্যে বাংলা শেখার আগ্রহ বাড়বে। সেসব শিক্ষণের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হবে।

উদাহরণ আর না বাড়িয়ে বলা যায় যে দীর্ঘ মেয়াদে যথাযথ নীতি কৌশল গ্রহণ করলে বাংলা ভাষার প্রসার ও অর্থনীতির উন্নয়ন সমানতালে চলতে পারে। কিন্তু স্বল্প মেয়াদে বা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে তার বিপরীত কেন মনে হচ্ছে?

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব বিরাজ করছে, তার নানা রকম কারণ থাকলেও চাকরিপ্রার্থীদের ধারণা হয় যে নিয়োগকারীরা প্রার্থীর ইংরেজি জ্ঞানকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটছে, তা হলো, সাধারণ স্নাতক শিক্ষিতদের অনেকের অন্যান্য দক্ষতাও যথেষ্ট নয়। তবে এটাও ঠিক, অনেক চাকরির পরীক্ষাতে বাংলা ও ইংরেজি দুটোর দক্ষতাকে সমান ওজন দেওয়া হয়। বরং বাংলা দক্ষতার ওজন বেশি থাকা উচিত। বাংলায় খুব পারদর্শী হলে তাঁকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি থাকা উচিত। সরকারি চাকরিতে সে রকম উদাহরণ তৈরি করা হলে বেসরকারি নিয়োগকারীরাও উৎসাহিত হবে। তার ফলে সবার মধ্যে তখন বাংলা দক্ষতা অর্জনের প্রচেষ্টা থাকবে। বিভিন্ন উদ্যোক্তারা দেশের ভেতরে যোগাযোগের জন্য শুধু বাংলা ভাষা ব্যবহার করলে ভালো বাংলা দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগের সম্ভাবনা বাড়বে। এ বিষয়ে সব উদ্যোক্তার আন্তরিকতা ও সমঝোতা দরকার হবে।

সেই সঙ্গে আজকাল বিদেশে উচ্চশিক্ষার্থে বা চাকরির জন্য যাওয়ার আগ্রহ ক্রমবর্ধমান। কাজেই শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সবাই। দেশের ভেতরে আকর্ষণীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ না বাড়লে এই প্রবণতা রোধ করা কঠিন হবে।

স্মার্ট হওয়ার সঙ্গে ইংরেজি জানাকে সমার্থক মনে করে থাকেন অনেকে। কাজেই এই বিষয়ে একটি ধারণা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার সরকারি পর্যায় থেকে। স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির জন্য প্রথম প্রয়োজন বাংলা ভাষার দক্ষতা। শুদ্ধভাবে বাংলা লেখা ও বলার ওপর জোর দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর থেকে।

তবে শুধু বাস্তব কারণ দিয়ে বাংলা ভাষা ব্যবহারে পিছিয়ে পড়ার কারণ পুরো ব্যাখ্যা করা যাবে না। শিক্ষিতদের এবং প্রভাবশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ইংরেজি জ্ঞানের প্রতি পক্ষপাত বেশ দৃশ্যমান। নির্ভেজাল বাংলায় আলোচনার তুলনায় কিছু ইংরেজি শব্দ ঠেসে দিলে বক্তাকে বেশি যোগ্য মনে করা হয়। লিখিত যোগাযোগ পরিশীলিত বাংলার পরিবর্তে সুন্দর ইংরেজিতে করা হলে বক্তব্যের গুরুত্ব বাড়ে।

স্মার্ট হওয়ার সঙ্গে ইংরেজি জানাকে সমার্থক মনে করে থাকেন অনেকে। কাজেই এই বিষয়ে একটি ধারণা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার সরকারি পর্যায় থেকে। স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির জন্য প্রথম প্রয়োজন বাংলা ভাষার দক্ষতা। শুদ্ধভাবে বাংলা লেখা ও বলার ওপর জোর দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর থেকে।

এসব বিষয়ে গণমাধ্যমের কিছু ভূমিকা রয়েছে। টিভিতে আলোচনা অনুষ্ঠানে দুই ভাষার মিশ্রণ অহরহ ঘটে। টিভি কর্তৃপক্ষ বক্তাদের আগেভাগে বলে রাখতে পারেন যে নির্ভেজাল বাংলায় বলাটা সমীচীন। কিন্তু তাতে প্রভাবশালী বক্তা অখুশি হবেন নিশ্চিত। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ বা মতামতে এমন ইংরেজি শব্দ কেন ব্যবহার করা হবে, যেগুলোর সহজ বা প্রচলিত বাংলা শব্দ রয়েছে? ভাষা সম্পাদনা করার একটি দায়িত্ব পত্রিকাগুলোর রয়েছে।

সমস্যাগুলো দুশ্চিন্তা করার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বলেই মনে হয়। তাই সমস্যাগুলোর স্বরূপ চিহ্নিত করার জন্য কিছু পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও গবেষণা করা যেতে পারে। সরকারের বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, বাংলা একাডেমি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগগুলো এসব গবেষণা হাতে নিতে পারে।

পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও গবেষণার উপযোগী বিষয় হিসেবে দু-একটি উদাহরণ: সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে পরীক্ষায় কত ছাত্রছাত্রী বাংলায় উত্তরপত্র লিখছে, বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা পাঠ্যবই বা আকরগ্রন্থ কতগুলো রচিত হয় বা অনূদিত হয়, স্কুলশিক্ষকদের ও ছাত্রদের মধ্যে প্রমিত বাংলায় কথোপকথন হয় কি না, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সভা-সেমিনার-আলোচনা অনুষ্ঠানের কত অংশ নির্ভেজাল বাংলায় হয় ইত্যাদি বিষয়ে কয়েক বছরের তথ্য নিলে বাংলা প্রসারের অগ্রগতি বা পিছিয়ে পড়া অনুধাবন করা সম্ভব হবে। অভিভাবকদের এবং চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে বাংলা জ্ঞানের প্রয়োজন বিষয়ে মনোভাব, অভিজ্ঞতা ও তার প্রভাবকগুলো বিশ্লেষণ করা দরকার। দেখা দরকার ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার আগ্রহ বাড়ছে কি না। নিয়োগকারীদের মনোভাব জানাও প্রয়োজন।

সবশেষে বলতে হয় যে শুধু আবেগপ্রবণ শব্দচয়ন করে বাংলাভাষার জন্য ভালোবাসার প্রকাশ এখন আর যথেষ্ট নয়। বাংলা প্রসারের জন্য, তাকে গতিশীল, আধুনিক এবং আরও আকর্ষণীয় ভাষা হিসেবে জীবনের সব কাজে লাগানোর জন্য, বিশ্বব্যাপী এই ভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়।

উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ার কৌশল হিসেবে যদি বাংলা ভাষা প্রসারের বিষয় ভুলে গিয়ে সহজতর পথ হয় বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া, তবু সেই পথ নেওয়া যাবে না। বরং কিছুটা বেশি প্রয়াস নিয়ে ও সম্পদ ব্যয় করে বাংলা ভাষার প্রসার এবং অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন একযোগে করতে হবে। উপার্জন কাজের মাধ্যম হিসেবে বাংলার জ্ঞানকে কাজে লাগানোর জন্য সব পক্ষকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। এসব প্রচেষ্টার মাধ্যমেই হবে এই ভাষাকে যে আমরা ভালোবাসি তার প্রমাণ এবং যারা আমাদের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।

  • রুশিদান ইসলাম রহমান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য