প্রধান উপদেষ্টা নানান আলাপে ও সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ বছর ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তারা ডিসেম্বর সামনে রেখেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে কোনো পক্ষ থেকেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। আমরা ধরে নিতে পারি, ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তবে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। কয়েকটি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দাবি করেছে। বিএনপি নেতারা পালা করে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ভাষণ বা বিবৃতিতে এই দাবির পুনরাবৃত্তি করছেন। বোঝা যায়, তাঁরা শিগগিরই নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন।
বিএনপি স্পষ্ট করেই বলেছে, তারা সবার আগে চায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সংসদ নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন তারা মেনে নেবে না। অন্য কোনো নির্বাচন বলতে তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা বুঝিয়েছে। এক বিএনপি নেতা বলেছেন, স্থানীয় সরকারের মতো সামান্য বিষয় যেন অগ্রাধিকার না পায়।
স্থানীয় সরকার কি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার বিষয়? এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে স্থানীয় সরকার যতটা প্রাসঙ্গিক, জাতীয় সরকার ততটা নয় বলেই মনে হয়। সরকারের কাছে মানুষ চান সেবা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেবাগুলো পাওয়া যায় স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে। জাতীয় সংসদে পাঁচ দশক ধরে যেসব কথাবার্তা হয়েছে, তা রিবাউন্ড করে শোনানো গেলে অনেকেই কানে হাত দেবেন। সংসদ সদস্যরা জাতীয় সংসদকে গালাগাল, বিষোদ্গার, ব্যক্তি আক্রমণ, হাসি-তামাশা আর ব্যক্তিগত লাভালাভের ফোরাম বানিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা শিগগির সরে আসবেন, সেটা ভাবতে ভালো লাগলেও তার সম্ভাবনা কম। আরেকটা সংসদ আমাদের কী দেবে, এটা একটা প্রশ্ন বটে। পুরোনো মুখগুলোই তো ঘুরেফিরে আসছে।
এর মধ্যে আরেকটা ঝামেলা তৈরি হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা নতুন একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করেছেন। নাম দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি। আমরা এটাকে সংক্ষেপে ‘জানাপ’ বলতে পারি। তাঁরা ক্রমেই রাষ্ট্রক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির চর্চায় পা পা করে এগোচ্ছেন। এটি অনেকের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানাপের পক্ষ থেকে দুটি প্রস্তাব বা বক্তব্য খোলাখুলিভাবেই উঠে এসেছে। তারা সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলছে এবং একটি নতুন সংবিধান চাইছে। এ জন্য তারা নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। একই সঙ্গে তারা বলেছে, গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই সময়ে হতে পারে। বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি। তারা কি দুটি আলাদা ফোরামের কথা বলছে? একটি গণপরিষদ এবং অন্যটি জাতীয় সংসদ? আমার মনে হয় তারা বোঝাতে চাইছে, একটি সাধারণ নির্বাচন হলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রথমে একটি গণপরিষদ গঠন করবেন। গণপরিষদে নতুন একটি সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতীয় সংসদে রূপান্তরিত হবে।
এখানেই ঝামেলা বেধেছে। বিএনপি ১৬টি সংশোধনীসংবলিত ক্ষতবিক্ষত বাহাত্তরের সংবিধান পুনরুজ্জীবনের পক্ষে। জানাপ চায় বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান বানাতে। ক্ষমতার রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী এখন মোটামুটি সাবালক। তারা এখন বিএনপির পক্ষপুট থেকে সরে এসে নিজ শক্তিতে উড়তে চায়। তারাও চায় নতুন সংবিধান।
অন্য ছোট দলগুলো পুরোনো হলেও নির্বাচনের পিচ্ছিল মাঠে এখনো হামাগুড়ি দেওয়ার স্তর টপকাতে পারেনি। তাদের সামনে এখন তিনটি বিকল্প—এক. বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া; দুই. জানাপের সঙ্গে জোটে যাওয়া; তিন. নিজেদের মধ্যে একটা জোট গড়ে নিজেদের শক্তিতে এগিয়ে যাওয়া। দল হিসেবে তারা সংখ্যায় অনেক। নেতারা অনেক বছর অপেক্ষা করেছেন। এখন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর ১০ তলা দালানে ঢুকতে চান। নির্বাচনে তাঁদের কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার শর্তে তাঁরা বিএনপি কিংবা জানাপের ছাতার তলায় যাবেন। আলাদা জোটে থেকে নির্বাচন করলেও অন্য দুটি দলের কোনো একটির সঙ্গে আড়ালে-আবডালে একটি সমঝোতা করতে হতে পারে, যেমনটি জামায়াত করেছিল বিএনপির সঙ্গে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময়। নির্বাচন নিয়ে ভবিষ্যতে আমরা নানা কিসিমের সমীকরণ দেখব। সমঝোতা কিংবা আপসের রাজনীতিকে ন্যায্যতা দিতে রাজনীতিবিদেরা প্রায়ই একটা মন্ত্র জপ করেন—রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। ‘ডিগবাজির রাজনীতি’ কথাটা আমাদের মধ্যে চালু আছে।
এ তো গেল জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়েও দাবি আছে। এটা নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হবে, তা বেশ বোঝা যায়। বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরুদ্ধে নয়। তারা আগে চায় জাতীয় নির্বাচন। প্রশ্ন হলো, কেন? বিএনপির কাছে জাতীয় সংসদই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলে ফোকাসটা ‘মূল নির্বাচন’ থেকে সরে আসার আশঙ্কা তাদের। তারা এ-ও বলছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি করে বর্তমান ‘অনির্বাচিত সরকার’ দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চায়।
সমালোচকদের কেউ কেউ বলেন, বিএনপি কয়েকটি কারণে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। প্রথমত, এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের ‘পুনরুজ্জীবন’ ঘটবে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় পরিষদের নির্বাচিত নেতারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের প্রভাবিত করবেন। তৃতীয়ত, আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে সংসদ সদস্যরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে মনোনয়ন–বাণিজ্য করতে পারবেন এবং আগে স্থানীয় নির্বাচন হয়ে গেলে এই বাণিজ্য সম্ভব নয়।
গণপরিষদ বনাম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি কি আসলেই সাংঘর্ষিক? ধরা যাক, একটি গণপরিষদ বসল এবং সংবিধানের ব্যাপারে একটা ফয়সালা হয়ে যাওয়ার পর এটি জাতীয় সংসদ হিসেবে কাজ শুরু করল। এতে সমস্যা কী? কোনো দল যদি চায় আগের সংবিধান বহাল থাকুক, গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তারা বাহাত্তরের সংবিধান পুনর্বহালের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেবে। যাঁরা নতুন সংবিধান চান, তাঁরা প্রস্তাবিত সংবিধানের ওপর ম্যান্ডেট চেয়ে নির্বাচন করুন এবং নির্বাচিত হয়ে নতুন সংবিধান তৈরি করুন। এটি নিয়ে ঝগড়াঝাঁটির কোনো মানে হয় না। যাঁর যাঁর প্রস্তাব বা ইশতেহার নিয়ে মাঠে নামুন। জনগণকে একটা ‘চয়েস’ দিন। দেখুন, তাঁরা কাদের পক্ষে থাকেন।
ভবিষ্যতে নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির পক্ষগুলোর মধ্যে যে সমীকরণ তৈরি হবে, সেখানে তুরুপের তাস হবে কারা—এটি একটি কোটি টাকার প্রশ্ন। জানাপ, জামায়াত, নাকি অন্য কেউ। জাতীয় পার্টিকেও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। এটি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। যদিও তাদের কপালে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ টিকা লেগেছে। আর আওয়ামী লীগ? তারা কি প্রকাশ্য হবে, নাকি অন্য কোনো দলের সঙ্গে নেপথ্যে জুটে যাবে—এটিও ভেবে দেখার বিষয়।
এর মধ্যে জানাপের এক নেতা একটি বোমা ফাটিয়েছেন। তিনি বলেছেন, একটি ভোট দেওয়ার জন্য এত বড় অভ্যুত্থান হয়নি। তিনি আরও বলেছেন, শেখ হাসিনার বিচার হওয়ার আগে নির্বাচনের কথা ভুলে যান। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর উক্তির মধ্যে একটা আশঙ্কা আছে, নির্বাচিত সরকার এলে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া ঝুলে যেতে পারে।
গণপরিষদ প্রসঙ্গে আসি। সিদ্ধান্ত কি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাকি ন্যূনতম দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে হবে? মনে আছে, যে ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’-এর ভিত্তিতে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে গণপরিষদের নির্বাচন হয়েছিল, সেখানে তিনটি প্রধান শর্ত ছিল: ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান লিখতে হবে, সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এটি গৃহীত হবে, প্রেসিডেন্ট এটি অনুমোদন না করলে গণপরিষদ ভেঙে যাবে। এখানেই পাকিস্তান ভাঙার বীজ লুকিয়ে ছিল।
যেভাবেই হোক, রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া নতুন সংবিধান গ্রহণ কিংবা পুরোনো সংবিধান বহাল রাখা—কোনোটিই সম্ভব নয়। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে অনৈক্য, পরস্পরের বিরুদ্ধে যে বিষোদ্গার, যে পাল্টাপাল্টি কথা–চালাচালি হচ্ছে, সেখানে সংবিধান প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্যে আসা কঠিন হবে।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক