বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এখন চলছে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসন। এ সরকার ইতিমধ্যে জনগণকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বলা বাহুল্য যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী এবং এ জন্য তারা সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে প্রস্তুত। বাংলাদেশের জনগণ বাস্তবতার নিরিখে যৌক্তিক ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
এখন পর্যন্ত উত্থাপিত সংস্কারের দাবিগুলোর যে ফিরিস্তি, সেটা অনেক বড় হলেও কিছু মৌলিক দাবি অবশ্যই অন্য দাবিগুলো থেকে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই মৌলিক দাবিগুলো পূরণ হলে অবশিষ্ট দাবিগুলো সময়ের পরিক্রমায় পূরণ করা সহজতর হবে। রাজনৈতিক সংস্কার এই মৌলিক দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিবাদী মনোভাব আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে কলুষিত করেছে। গণ-আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল ফ্যাসিবাদের পতন। আর গণ-আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপই হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য।
খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে বলা যায়, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে অতি ডানপন্থী একনায়কসুলভ শাসনব্যবস্থা। এ রকম ব্যবস্থায় শাসক তার প্রভাববলয় তৈরিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে এবং একটি সামাজিক অনুক্রম (সোশ্যাল হায়ারার্কি) তৈরি করে যার মাধ্যমে সমাজে শ্রেণি বিভেদ তৈরি হয়।
ফ্যাসিবাদের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে এ রকম শাসনব্যবস্থায় জনগণের ইচ্ছাকে প্রবলভাবে অবহেলা করা হয়। ফ্যাসিবাদের এসব উপাদান বিবেচনায় নিলে হাল আমলের ও নিকট অতীতের প্রায় সব সরকারই অল্পবিস্তর ফ্যাসিবাদী হিসেবে গণ্য হবে।
ব্রিটিশ শাসন আমল এবং এর পরবর্তী পাকিস্তানি নিষ্পেষণ কোনোভাবেই ফ্যাসিবাদ শাসন থেকে আলাদা কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সরকার দেশের মানুষের মনে গভীর আশার সঞ্চার করলেও অল্প বিরতিতে ‘বাকশালি’ ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। পরে আমাদের দেশের জনগণ দুটি সামরিক সরকারের ফ্যাসিজম প্রত্যক্ষ করে।
’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী এক দশক এই রাহুর দশা থেকে মুক্ত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই শতাব্দীর শুরু থেকে বিগত সরকারের শেষ দিন পর্যন্ত যে দুটি রাজনৈতিক দল দেশ শাসন করেছে, তারা ফ্যাসিবাদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। আমরা অত্যন্ত শঙ্কার সঙ্গে লক্ষ করেছি, ফ্যাসিবাদের জাঁতাকল দিন দিন শুধু ভারীই হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে তা বহনের অযোগ্য হয়ে পড়ায় ছাত্র-জনতা ওই ফ্যাসিস্ট সরকারকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।
ফ্যাসিবাদের তীক্ষ্ণ থাবায় ক্ষতবিক্ষত দেশের জনগণের মুক্তির যে আকুলতা, তা অতিশয় যুক্তিসংগত। কিন্তু বর্তমান নীতিনির্ধারণী মহলের মনে রাখা প্রয়োজন যে ফ্যাসিবাদ দমন করার ভুল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন ফ্যাসিবাদের জন্ম হতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ইতালির মুসোলিনি, জার্মানির হিটলার বা হাল আমলে রাশিয়ার পুতিন এবং তাঁর দার্শনিক গুরু আলেকসান্দর দুগিন ফ্যাসিস্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে যে পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেশের জন্য অকার্যকর এবং তাদের প্রদর্শিত পথই একমাত্র মুক্তির পথ।
এ রকম বিশ্বাস যত ঘনীভূত হয়, ততই তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তাদের বিশ্বাসকে জনগণের ওপর সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে চাপিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সুতরাং আমাদের উচিত অন্যদের দমনের ইচ্ছা ত্যাগ করে ফ্যাসিবাদ নিয়ন্ত্রণে বেশি মনোযোগ দেওয়া।
বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি কতটা আমলে নিচ্ছেন সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি সংস্কারের দায়িত্বে থাকা কেউ কেউ সংস্কারের নামে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের প্রস্তাব করেছেন। এই প্রস্তাবের সঙ্গে অতীতের ফ্যাসিস্ট সরকারগুলোর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্তগুলো হবে সুচিন্তিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুল প্রচলিত বর্জনের দর্শনকেই অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
ফ্যাসিবাদের জন্ম হয় ফ্যাসিস্ট নেতা ও তার সহযোগীদের মাধ্যমে। এখানে দলের অবস্থান থাকে গৌণ। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে যেখানে একটি গণতান্ত্রিক দল ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট দলে পরিণত হয়েছে শুধু দলের নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য। সুতরাং কোনো রাজনৈতিক নেতা ও তাঁর সহযোগীদের ফ্যাসিস্ট আচরণের জন্য দল নিষিদ্ধ করা প্রকারান্তরে ফ্যাসিজমের বহিঃপ্রকাশ।
কোনো দল যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তখন সাধারণ জনগণ তাদের ভোট দেয় বিভিন্ন কারণে। এর মধ্যে ওই রাজনৈতিক দলের ঐতিহ্য, ইতিহাস, মাঠপর্যায়ে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, প্রতিষ্ঠাকালীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন ইত্যাদি অন্যতম। সুতরাং কোনো দলের নেতা বা নেতৃত্বের ভুলের কারণে যদি ওই দলকে নিষিদ্ধ করা হয়, তবে তা হবে ওই দলের সমর্থকদের পছন্দকে অবজ্ঞা করা, যা প্রকারান্তরে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা।
একটি রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম পরিচালিত হয় তার নেতৃত্বদের দ্বারা। নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় দলের সাধারণ সদস্যদের মাধ্যমে। ‘এজেন্সি থিওরি’ অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠানের যে বিভিন্ন ‘স্টেকহোল্ডার’ থাকে, তারা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন করে এবং পর্ষদ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার সাফল্য বা ব্যর্থতার দায়ভার বহন করে। পর্ষদের কোনো অনৈতিক কার্যক্রমের জন্য স্টেকহোল্ডাররা দায়ী থাকে না বরং এর জন্য পর্ষদকে বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।
রাজনৈতিক দলগুলোও এক একটি প্রতিষ্ঠান এবং তার সমর্থকেরা হচ্ছে স্টেকহোল্ডার। রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই এজেন্সি সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলে নেতৃত্বের মধ্যে ফ্যাসিবাদী মনোভাবের প্রবণতা ক্রমেই হ্রাস পাবে। এই প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে আধুনিকীকরণ করা প্রয়োজন এবং একটি স্থায়ী কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। এর কাজ হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে আধুনিক ও জনবান্ধব গঠনতন্ত্র প্রণয়নে সাহায্য করা ও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা নিয়মিত নিরীক্ষা ও তদারকি করা।
কমিশন তার সাংবিধানিক শক্তির বলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো অসংগত কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে এবং তাদের আইনের আওতায় আনতে পারবে। সামাজিক বিনিময় তত্ত্বের আলোকে এ কথা নিশ্চিত যে ফ্যাসিস্ট নেতৃত্ব তার ক্ষমতার বলয় প্রতিষ্ঠার জন্য ধনিক শ্রেণির সঙ্গে একধরনের অলিখিত বিনিময় চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, যার মাধ্যমে ধনিক শ্রেণিতে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। সম্পর্কের শুরুতে এরা রাজনৈতিক দলগুলোকে আর্থিক ডোনেশান প্রদান করে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় এবং পরে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে।
এই রাজনৈতিক বিনিময় প্রথাকে সীমিত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়মিত তাদের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী তৈরি করতে হবে এবং তা কমিশনের কাছে জমা দিতে হবে। কমিশন আর্থিক বিবরণীতে কোনো সন্দেহজনক ও প্রভাব বিস্তারে সক্ষম ডোনেশানের অস্তিত্ব পেলে তার সঙ্গে সংযুক্ত পক্ষগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে প্রচেষ্টা চালাবে। রাজনৈতিক দলগুলোয় নিয়মিত বার্ষিক সভা অনুষ্ঠান হচ্ছে কি না এবং সভাগুলোয় পরিবারতন্ত্র ও স্বজনপ্রীতি ছাড়া কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হচ্ছে কি না, তার দেখভাল ও তদারকির দায়িত্বও কমিশনকে নিতে হবে। কোনো প্রকার অসংগতির জন্য বর্তমান নেতৃত্বকে দায়ী করে তাদের আইনের আওতায় আনাও কমিশনের কাজের আওতার মধ্যে থাকবে।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দর্শন অনুযায়ী এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের মধ্যে বিরাজমান সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান কোনো ‘আইডিয়ালিস্টিক’(আদর্শবাদী) চিন্তাধারার মাধ্যমে সমাধান করা দুরূহ; বরং বিরাজমান ভিন্ন চিন্তার পক্ষগুলোর মধ্যে চলমান দর্শনগত দ্বান্দ্বিক বিতর্ক ও তার মাধ্যমে সৃষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতই হচ্ছে উত্তম সমাধান।
‘আইডিয়ালিজম’(আদর্শবাদ) সমস্যা সমাধানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যুক্তিসংগত আচরণকে স্থির হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যুক্তিসংগত আচরণ সদা পরিবর্তনশীল। তাই চিন্তা ও দর্শনে দ্বান্দ্বিকতা অবশ্যম্ভাবী। এটা বিবেচনায় রেখে ফ্যাসিবাদ নিয়ন্ত্রণে সর্বোত্তম প্রক্রিয়া হতে পারে, অংশগ্রহণকারী পক্ষের বহুমুখীকরণ। এমন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে নীতিনির্ধারণী মহলের রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের প্রস্তাব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতির অন্তরায়। এর ফলে নতুনভাবে ফ্যাসিবাদের উত্থানের আশঙ্কা রয়েছে।
মসফিক উদ্দিন অধ্যাপক, লিডস বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য