ঘরের গল্প কেন বাইরে শোনা যাবে

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ ব্রিফিং

‘আজ আমার মেজাজ খারাপ’ অথবা ‘আমার চাচাতো চাচির মামাতো ভাইয়ের শাশুড়ির শ্বশুর মারা গেছেন গতকাল’—এসব খবর ভার্চ্যুয়াল বন্ধুদের না জানালে চলে? সরকারি দপ্তরে ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না, ‘এটা দেখার কি কেউ নেই?’-মার্কা ‘নাকে কান্না’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার না করলে কি জাতি উদ্ধার পাবে? দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা রাজনৈতিক সংকটের কথা আপাতত বাদ থাক; ক্রিকেট নিয়ে ফেসবুকে ঝড় না তুললে দেশপ্রেম প্রমাণ করবেন আর কীভাবে?

যোগাযোগ নেটওয়ার্কে থাকা ব্যক্তিরা কত গল্পই-না বলতে চান, সঙ্গে কিছু অর্ধসত্য, এমনকি মিথ্যাও! তবু কত অভাব তথ্যের, বিশ্বাসযোগ্য গল্প বলার (স্টোরিটেলিং)! বাগাড়ম্বর, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, কুৎসা, বিকল্প ফ্যাক্ট (আসলে অসত্য) ইত্যাদি শুনে হয়তো পুলকিত হন অনেকেই; বিশ্বব্যাপী এগুলোকে নানা কায়দায় বেচাবিক্রি করেন ক্ষমতাধর ও বিত্তবানদের আধুনিক ক্রীতদাসেরা। ঐতিহাসিক বাস্তবতায় যাকে বলে জনশ্রুতি, তা-ই হাল আমলের রাজনৈতিক মূলধন ‘গুজব’, তাকে সত্য-মিথ্যা যে আকারেই ধরে নিই না কেন।

এগুলোকে অপতথ্য আখ্যা দিয়ে পণ্ডিতেরা পর্যন্ত বিপর্যস্ত (!) হয়ে যাচ্ছেন, শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে; যেন এই মিথ্যা বলার প্রবণতা পৃথিবীতে কোনোকালেই ছিল না। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট একশ্রেণির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ ফন্দি আঁটছেন কীভাবে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে, এবং সম্ভব হলে বাইরেরও, মানুষের মতামত ও মনোজগৎ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একবার বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারলেই মিথ্যাকে বিশ্বাস করানো যায় বলে তাঁরা মনে করেন, যেহেতু তাঁদের মতে, এটা হচ্ছে সত্যপরবর্তী যুগ।

বাংলাদেশেও অনেক ঘটনা ঘটে বা তথ্য সৃষ্টি হয়, কিন্তু তার অনেক কিছুই প্রচারিত হয় দেশের বাইরে থেকে। এগুলো রপ্তানিই-বা করেন কারা! ‘দেয়ালেরও কান আছে’—কথাটা দূর অতীতের যখন অন্যদের, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর, গোপন আলোচনা জেনে যেত প্রতিবেশীরা এবং রীতিমতো কানাঘুষা করত। এখন তো অতি আত্মবিশ্বাসী মানুষ নিজেই প্রকাশ করে দেয় ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, যেমন তিনি কোন শক্তিধরের কত কাছের পাত্র বা পাত্রী। তারপরও বিদেশ থেকে বা বিদেশিদের মুখে দেশের কথা শুনতে হয় কেন; দেশের নীতি-মতাদর্শ নিয়ে এত চুলচেরা বিশ্লেষণের দরকার কী বহির্বিশ্বের?

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ নিয়ে বক্তব্য একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইস্যুটি সবারই জানা—ঘরে-বাইরে অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি। কোন যুক্তিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে এত উচ্চবাচ্য করছে যুক্তরাষ্ট্র? এর একটি উত্তর হতে পারে, দেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে একটি রাজনৈতিক সংকট তো আছে এবং এখন পর্যন্ত তা অভ্যন্তরীণভাবে সমাধান করা সম্ভব হয়নি সংশ্লিষ্ট দলগুলোর পক্ষে। বাংলাদেশে নির্বাচন বিষয়ে কথা বলা একমাত্র দেশ নয় যুক্তরাষ্ট্র; এ চর্চাও নতুন নয়।

প্রচারের ক্ষেত্রে, যেসব দেশে সত্য প্রকাশ বা মতামত প্রদান সম্ভব হয় না, আগ্রহী মানুষ তা জানে অন্য সূত্র বা মাধ্যম এবং ভিন্ন দেশ থেকে। আজকাল মুঠোফোনেরও কান থাকায় সে-ই তা জানিয়ে দিচ্ছে যাঁরা জানতে চান তাঁদের। মুক্ত গণমাধ্যম থাকা সমাজেও মানুষ সত্য-মিথ্যা পরীক্ষা করে ভিন্ন সংস্কৃতির, পক্ষপাতহীন কারও সঙ্গে ধারণা মিলিয়ে। সে জন্যই হয়তো গণতন্ত্র সূচকে দেশের বৈশ্বিক অবস্থান বা দুর্নীতির ধারণা নিয়ে রিপোর্ট পড়তে পাঠক আগ্রহী থাকেন। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সমীক্ষা করে নিশ্চিত হতে চায়, কোন দেশের মানুষ কম গোসল করে অথবা কী তাদের পছন্দ-অপছন্দ।

তথ্য নিয়ন্ত্রিত সমাজে অবশ্য মুক্ত প্রশ্ন করার জো নেই। সেখানে একটি গোষ্ঠীর শাসন চিরস্থায়ী করতে উপযুক্ত বয়ান তৈরি ও প্রচার করা হয়। তাদের অনুমান, অর্ধসত্য ও মিথ্যা তথ্যের সাম্রাজ্যে জনগণ রিপ ভ্যান উইঙ্কেলের মতো ঘুমিয়ে থাকবে বহুকাল। কিন্তু এ ধরনের প্রকল্পের সাময়িক ফলাফল সত্যের অপমৃত্যু। মরণশীল জীব মানুষ যেখানে নিজের মৃত্যুকেই মিথ্যা বানাতে চায়, জীবনের সত্য অজানা ও চাপা থাকা তার এবং সভ্যতার কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনামলে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা রেডিও বাংলাদেশের সর্বত্র খুবই জনপ্রিয় ছিল। রাষ্ট্রীয় বেতার ও টিভি তো দূরের কথা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হতো নিয়মিতই। বর্তমানকালে রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে ফেসবুক, ইউটিউব ও এক্সের মতো যোগাযোগমাধ্যম। এখন যাঁরা বোধ করেন, দেশের ভেতর থেকে কিছু কথা বললে বিপদগ্রস্ত হতে পারেন, তাঁরা ‘বিপদভঞ্জন’ হিসেবে আবির্ভূত হন অন্যত্র।

আরও পড়ুন

দ্য গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস, আল-জাজিরাসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেগুলো বাংলাদেশিদেরও ব্যাপক দৃষ্টি কেড়েছে। এ ব্যাপারে দেশের সংবাদমাধ্যম পেশাজীবীরা অভিযোগ করতে পারেন স্বাধীন মতপ্রকাশে সীমাবদ্ধতা নিয়ে, আর নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বলতে পারে, সবই তো প্রকাশ পাচ্ছে।

বিতর্ক যা-ই থাকুক, বাস্তবতা হচ্ছে, তথাকথিত মূলধারার সংবাদমাধ্যম পাঠক-দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্টের পুরো জোগান দিতে পারছে না। যোগাযোগমাধ্যমে সংযুক্ত মানুষেরাও নিজেদের বৈশ্বিক পর্যায়ে ভাবতে পছন্দ করছেন। তাই তাঁরা স্থানীয় মিডিয়ার সীমাবদ্ধতার যুক্তিতে চুপচাপ বসে থাকবেন কেন, বিশেষ করে যখন সুযোগ আছে?

এ অঞ্চলে একসময়ের দেয়াললিখন এখন স্থান পেয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দেয়ালে (ওয়াল)। ব্যক্তিমানুষ ঝাঁপিয়েও পড়েছেন এখানে নিজেদের মতামত দিতে, প্রকাশ করতে। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক বাণিজ্যও থেমে থাকেনি—তাঁরা পাল্লা দিয়ে এ মাধ্যম ব্যবহার করে ফায়দা লুটতে চাইছেন।

সুতরাং কোনো জাতীয় সংকটের মুখেও যখন শত শত বা হাজার হাজার মানুষ একটি ‘ফালতু’ বিষয়ে ‘ট্রল’ করতে থাকেন, এ কাজ করানোর পেছনে সাধারণত একটি উদ্দেশ্য থাকে—গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে আড়াল করা। অবশ্য যাঁরা বিতর্কে যোগ দেন, তাঁরা না-ও জানতে পারেন মাস্টারমাইন্ডদের ‘খেলা’টা কোথায়। যদিও এই প্রক্রিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যান ‘বনসাই’ জনগোষ্ঠী, আর সেটাই সুবিধাভোগীদের চাওয়া।

কৌতূহলী পাঠকেরা যোগাযোগমাধ্যমে বিকল্প তথ্য আর বিনোদন খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন; আবার ফিরে আসছেন পেশাদার সংবাদপত্রের অনলাইনে। অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে যথাযথ তথ্যের আকালই হয়তো ঐতিহ্যবাহী সংবাদমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখতে পারে।

আসলে সত্যই সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যবসার নাম। খাদ্যে ভেজাল, কাজে ফাঁকি, ভুয়া চিকিৎসা, কুশিক্ষা, ঘুষ, অবিচার, খেলায় প্রতারণা, নির্বাচনে কারচুপি—এসবই ঘটে সত্যের বরখেলাপের কারণে। মিথ্যার ভিত্তিতে কেউই সত্যের জায়গা পায়নি ইতিহাসে। বিশ্বায়নের যুগে দেশের সংবাদমাধ্যম এবং একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষের গল্প না বললে চিন্তাশীল মানুষ অন্যত্র ভিন্ন মাধ্যম খুঁজতেই পারেন, নিজেদের কথা বলার জন্য, শোনার জন্য।

নব্বইয়ের দশকে এক টিভি বিজ্ঞাপনে এক হাবাগোবা স্বামীকে বাইরের মানুষ মনে করিয়ে দিচ্ছিল, ‘আপনার বউয়ের জন্য...শাড়িটি কিনে নিতে ভুলবেন না।’ স্বামী অবাক হয়ে বলেন, ‘ঘরের কথা পরে জানল কেমনে?’ তিনি খেয়ালই করেননি যে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই তাঁর কোটের পেছনে ওই লেখাসংবলিত কাগজ সাঁটিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর পরিবার (স্ত্রী)।

একটি সত্যিকারের প্রজাতন্ত্রে কোটি পরিবারের মুখ-কান বন্ধ রাখে, সাধ্য কার?

  • খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক