অ্যালেক্সি নাভালনি খালি খালি মরেননি

অ্যালেক্সি নাভালনির প্রতিকৃতিতে মোমবাতি প্রজ্বালন করছেন একজন অনুসারীছবি: রয়টার্স

রাশিয়ায় দেশটির বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির দেহে নোভিচক নার্ভ এজেন্ট (রুশ বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন করা একধরনের রাসায়নিক বিষ, যা ধীরে ধীরে মানুষের মৃত্যু ঘটায়) প্রয়োগ করার পর জার্মানিতে তাঁর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। চিকিৎসা শেষে ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি যখন নাভালনি বিমানে করে বার্লিন থেকে মস্কোর উদ্দেশে রওনা হন, তখন তিনি বলেছিলেন, দেশে ফিরছেন বলে তাঁর ভালো লাগছে। তবে তিনি ভালো করেই জানতেন, দেশে ফেরায় তাঁর ভয়ানক ঝুঁকি আছে। 

নাভালনি জানতেন, দেশে ফেরার পর তাঁকে দীর্ঘ কারাবরণ করতে হতে পারে, তাঁর ওপর নারকীয় নির্যাতন নেমে আসতে পারে; এমনকি তাঁকে মৃত্যুর মুখেও পড়তে হতে পারে। সেই নাভালনি গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আর্কটিক অঞ্চলের একটি কঠোর নজরদারিসম্পন্ন কারাগারে মারা গেছেন। 

মৃত্যুর আগে তিনি এমন একটি উভয়সংকটের মুখে পড়েছিলেন, সব রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীকে নিশ্চিতভাবে যার কবলে পড়তে হয়। সেই উভয়সংকটটি হলো, ‘হয় তুমি নির্বাসনে যাও এবং দৃশ্যপটের আড়ালে হারিয়ে যাও অথবা উৎপীড়ক শাসককে মোকাবিলা করো ও শহীদের পরিণতি বরণ করে নাও।’ 

আপনি এই দুটোর যেটাই করুন, তাতে উৎপীড়ক সরকার উৎখাতের সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। 

উৎপীড়ক সরকারকে সমর্থন করেন না, আবার সরকারবিরোধিতায় খুব সরবও নন (বিশেষ করে এমন লোকদের মধ্যে, যাঁদের বিদেশে পাড়ি জমানোর সুযোগ আছে)—এই ধরনের ভিন্নমতাবলম্বীরাও প্রায় একই ধরনের সংকটে পড়েন। তঁাদের সংকটটি হলো: হয় বিদেশে গিয়ে (যেখানে উষ্ণভাবে তাঁদের গ্রহণ না–ও করা হতে পারে) নতুন করে জীবন গড়ো, নয়তো স্বৈরশাসকের দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন মেনে নিয়ে নিজ দেশে থেকে যাও। 

দুর্নীতির মাধ্যমে স্বৈরশাসনকে প্রায়ই আরামদায়ক করে তোলা হয়। একদিকে আনুগত্য মেনে নেওয়া লোকদের দুর্নীতি করতে দিয়ে পুরস্কৃত করা হয় এবং অন্যদিকে আনুগত্য মানতে না পারা লোকদের পিষে ফেলা হয়। এই ধরনের সংকট বিশেষভাবে তিক্ত। কারণ, এর ফলে ভিন্নমতাবলম্বীদের যাঁরা দেশে অবস্থান করেন এবং যাঁরা নির্বাসনে যান, তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় এবং উৎপীড়ক শাসক তার সুযোগ নিয়ে থাকে। 

যখনই কোনো রাজনৈতিক নেতা শহীদ হন, তখনই সে দৃষ্টান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বৈরাচার দ্বারা বিপর্যস্ত সমাজ তখন আরও ভালো কিছু নির্মাণের জন্য একটি নৈতিক ভিত্তি খুঁজে বের করতে চায়। 

উৎপীড়ক সরকারকে পছন্দ না করা নাগরিকদের দেশে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে সব ধরনের কারণ থাকতে পারে। কিন্তু নির্বাসিত ভিন্নমতাবলম্বীরা চট করেই অভিযোগ করেন, যাঁরা দেশে থেকে গেছেন, তাঁরা মূলত স্বৈরশাসকের নীতিবিবর্জিত তল্পিবাহক। অন্যদিকে, যাঁরা নির্বাসিত অবস্থায় আছেন, তাঁদের সম্পর্কে দেশে নীরব অবস্থায় থাকা ভিন্নমতাবলম্বীদের অভিযোগ, নির্বাসিতরা দেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিদেশে বসে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন। 

১৯৩০ সালে নাৎসি জার্মানিতে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। ওই সময় জার্মানির লেখক টমাস মান যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে থেকে নাৎসি সরকারের সমালোচনা করার জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নাৎসি জার্মানিতে অবস্থানরত লেখকদের নিন্দা করে বলেছিলেন, ওই লেখকেরা নাৎসি শাসনের বশ্যতা মেনে নিজেদের এতটাই কলঙ্কিত করেছেন যে তাঁদের সব সৃষ্টিই মূল্যহীন আবর্জনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 

নাৎসি শাসকবিরোধী এসব লেখকের অনেকে তখন টমাস মানের বিরুদ্ধে নিজের দেশে বসে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে আরাম–আয়েশের জীবন বেছে নেওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন। আধুনিক চীনেও ঠিক একই ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। দেশে বসে কমিউনিস্ট স্বৈরশাসনের মোকাবিলা করা লোকেরা নির্বাসিত ভিন্নমতাবলম্বীদের সম্পর্কে এই ধরনের মনোভাব পোষণ করে থাকেন। 

আর এখন এটি সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে রাশিয়ার ক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ, অসমসাহসী সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ (বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার হওয়ার জন্য ২০২১ সালে তাঁকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে) ইউক্রেনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখার পরও রাশিয়ায় থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কিছু নির্বাসিত রুশ ভিন্নমতাবলম্বীর সমালোচনার মুখে পড়েছেন। 

ভিন্নমতাবলম্বীদের এই দ্বিধাদ্বন্দ্বজনিত সংকটের সঠিক কোনো সমাধান নেই। দেশে থেকে যাওয়া এবং নির্বাসনে যাওয়া—উভয়ের পেছনেই সমান মাত্রার যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে এবং সেগুলো প্রায়ই ব্যক্তিগত পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে থাকে। 

 তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কী এমন কারণ ছিল, যার জন্য মৃত্যুর জোরালো ঝুঁকি সত্ত্বেও নাভালনি দেশে ফিরেছিলেন। অন্তত স্বল্প মেয়াদে হলেও কেন তিনি এই পরিণতির বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেননি? তাঁর সম্ভাব্য হত্যাকাণ্ড কিংবা পশ্চিম ইউরোপে তাঁর থেকে যাওয়া—কোনোটাই তো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের শাসনের অবসান ঘটাতে পারত না। 

কিন্তু এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে। প্রকাশ্য প্রতিবাদ স্বৈরশাসকের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকে সংশয়সংকুল করে তোলে। এ কারণে স্বৈরশাসন শুধু সামরিক শক্তি বা গোপন পুলিশের ওপর নির্ভর করে বসে থাকে না। স্বৈরশাসক মনে করে, জনগণের মনে অবশ্যই এই বুঝ ঢুকিয়ে দিতে হবে যে অত্যাচারীর বশ্যতা মেনে নেওয়াই স্বাভাবিক এবং বিরোধিতা করা অস্বাভাবিক, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তা পাগলামিও। এ কারণেই সোভিয়েত ভিন্নমতাবলম্বীদের অনেককে কারাগারে বন্দী না রেখে অনেক সময় পাগলা গারদে রেখে ‘মানসিক চিকিৎসা’ দেওয়া হতো। 

রাশিয়ায় নাভালনির প্রত্যাবর্তনকে আপাতদৃষ্টে অর্থহীন মনে হতে পারে। কিন্তু তাঁর এই ফিরে আসা চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানোর প্রতিনিধিত্ব করে। নাভালনির এই সাহসী অবাধ্যতা অন্য ভিন্নমতাবলম্বীদের কাছে এই ইঙ্গিত দিয়েছে যে তাঁরা একা নন। 

এর বাইরে আরেকটি বিষয় আছে। সেটি হলো: বশ্যতা মেনে নেওয়া লোকদের পুরস্কৃত করার মাধ্যমে, লোকেদের বারবার মিথ্যা বলা ও অপপ্রচারের মাধ্যমে, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের একে অপরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বাধ্য করার মাধ্যমে স্বৈরশাসন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। তারা ভয়, অবিশ্বাস এবং বিশ্বাসঘাতকতার সংস্কৃতি তৈরি করে। এ ব্যাপারে রাশিয়ান, জার্মান বা চীনা বলতে কিছু নেই। 

বিভিন্ন কালে অনেক জাতি অত্যাচারী শাসকদের দ্বারা নিষ্পেষিত হয়েছে; কিন্তু চিরকাল সে অবস্থা থাকেনি। শাসকগোষ্ঠী একসময় পরাজিত হয়েছে। অত্যাচারীর মৃত্যু ঘটেছে। 

যখনই কোনো রাজনৈতিক নেতা শহীদ হন, তখনই সে দৃষ্টান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বৈরাচার দ্বারা বিপর্যস্ত সমাজ তখন আরও ভালো কিছু নির্মাণের জন্য একটি নৈতিক ভিত্তি খুঁজে বের করতে চায়। 

এই দৃষ্টান্ত তখন বার্তা দেয়, দাসত্ব ও নিপীড়নে অভ্যস্ত জনগণের মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে। এই দৃষ্টান্ত আরও বার্তা দেয়, এমনকি যখন সব চেষ্টা নিষ্ফল বলে মনে হচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তেও কিছু সাহসী লোক স্বাধীনতার জন্য দাঁড়িয়েছিল। 

ইয়ান বুরুমা ডাচ বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ও গবেষক


স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ