কেমন হবে এবারের বিরোধী দল

যুক্তরাজ্যে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের অধীন সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত। সে সরকারের অন্য একটি পরিচয় ‘ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির সরকার’।

ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতিতে সংসদীয় বিরোধী দলকে রানি এলিজাবেথের আমলে বলা হতো ‘মহামান্য রানির বিরোধী দল’। মহামান্য চার্লস রাজা হওয়ার পর সংসদীয় বিরোধী দল এখন ‘মহামান্য রাজার বিরোধী দল’ হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশ একটি প্রজাতন্ত্র এবং ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার বলে দাবি করে থাকে। তবে বাংলাদেশে বিরোধী দলের সর্বজনস্বীকৃত সম্মানজনক কোনো সুনাম সৃষ্টি হয়নি। জেনারেল এরশাদ ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল সৃষ্টি করেছিলেন। একসময়ের পরাক্রমশালী নেতা আ স ম আবদুর রবের কপালে সে তকমা পড়েছিল।

বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদে স্বীকৃত বিরোধী দল ছিল না। আতাউর রহমান খান, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও জাসদের তিনজন সদস্য ছিলেন। দশম ও একাদশ সংসদ ছাড়া সব সংসদেই মোটামুটি শক্তিশালী সংসদীয় বিরোধী দল ছিল।

এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলই পর্যায়ক্রমে সরকারি ও বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। তাই এ দেশের বিরোধী দলের রাজনীতির নমুনা সম্পর্কে মানুষের অল্পবিস্তর কিছু ধারণা আছে; যদিও তা সম্পূর্ণ ইতিবাচক ছিল না। কিন্তু দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা ও চরিত্র ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করেছিল। এই বিরোধী দলের কার্যক্রম দেখে মানুষ নিন্দামন্দ করতে থাকেন। কিন্তু লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে তারা ১০ বছর ধরে পোষা বিরোধী দলের ভূমিকায় থেকে আনন্দে দিন গুজরান করে। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সে গুড়ে পিঁপড়া ও বালু—দুটিই পড়েছে।

জাতীয় পার্টি ২০১৪ সালের নির্বাচনে সরকারি দলের সহায়তায় নির্বাচিত হয়ে যুগপৎ সরকারে ও বিরোধী দলে অবস্থান গ্রহণ করে। জাতীয় পার্টির প্রধান এরশাদ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় সরকারের উপদেষ্টা এবং তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেত্রী হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও একই কায়দায় তাঁরা নির্বাচিত হন, কিন্তু সেবার মন্ত্রিত্ববঞ্চিত থাকেন। পোষা একটি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে এখন মেয়াদ শেষ করতে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নু মহোদয়রা কিছুটা লম্ফঝম্ফ করেন। তাতে মানুষ কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও পরে তাঁরা সুড়সুড় করে ২০১৪ ও ২০১৮–এর মতো একই গর্তে ঢুকে পড়েন। তবে মাথা গর্তে ঢুকলেও লেজে কামড় দিয়ে বসেছে ইগল!

এ অবস্থায় আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সংসদীয় বিরোধী দল কারা কীভাবে হচ্ছে, সেটি জাতি ঔৎসুক্যের সঙ্গে দেখার অপেক্ষা করছে। গত কয়েক বছর যাঁরা আপসের পুরস্কার পেয়েছেন, এবার তাঁদের ত্রাহি ত্রাহি রব ইতিমধ্যে শোনা যাচ্ছে। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জেপির ছয়জন নৌকায় চড়েও ডুবু ডুবু। আর জাতীয় পার্টির ২৬ জন নৌকামুক্ত হয়েও অথই পাথারে। সবার পথের কাঁটা ‘স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ’।

জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরীকত ফেডারেশন—এরা সবাই কলঙ্কিত চাঁদ। আসল চাঁদ নয়, চাঁদের মতো গোল কাঁসার বাটি। বাজে বড় বেশি, কিন্তু নিজেদের তেমন আলো নেই। আওয়ামী লীগের আলোয় তারা আলোকিত হতো। মনে হচ্ছে এবার সে আলো তারা হারিয়ে ঘোরতর অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছে।

আরও পড়ুন

তাহলে এবার বিরোধী দলের কী হবে? আওয়ামী লীগ জবর খেল দেখাল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন ‘খেলা হবে’। খেলা বিএনপির সঙ্গে হয়েছে একভাবে। সে খেলা বড় বেদনাদায়ক ও অভাবিতপূর্ব। আর জোটবন্ধুদের পিঠে বসেছে মিছরির ছুরি। তবু তারা বড় বেশি উহ্–আহ্ করে না।

আর সর্বংসহা জনগণ? অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। তাঁদের কত শতাংশ ভোটকেন্দ্রে যাবেন, না গেলে কি পুলিশ আর হেলমেট বাহিনী দিয়ে নেওয়া হবে (ইতিমধ্যে পত্রিকায় খবর এসেছে পুলিশ কেন্দ্রে ভোটার টানতে কাউন্সিলরদের সহায়তা চেয়েছে)?

শেষ কথা, জাতীয় সংসদের কী হবে? মূল চালকের আসনে যদি থাকে নৌকা মার্কা আওয়ামী লীগ, বিরোধী দলের আসনে অভিনয় করতে পারে ‘স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ’। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে কিছুদিনের জন্য দ্বিদলীয় বা বহুদলীয় ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। কোনো সাংবিধানিক সংস্কার বা আইন করে নয়, একটি রাজনৈতিক কৌশলে বহুদলীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটবে কি না, সেটা দেখার জন্য ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

● ড. তোফায়েল আহমেদ অধ্যাপক ও স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ