আগুন উসকানোর খেলা কি খেলেই যাবেন পুতিন ও বাইডেন

২০২১ সালের জুন মাসে সুইজারল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়া সম্মেলনে বাইডেন ও পুতিন
ছবি : রয়টার্স

গত ২ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভ্লাদিমির পুতিনের ভাষণ শুনলে যে কেউই মর্মাহত হবেন। কেননা, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের ভাষণ ছিল অসংগতি ও হুমকিতে ভরা। অন্যদিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিদ্যমান পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করবে। তিনি তাঁর বক্তব্যে সব দায় পুতিনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। পুতিন ও বাইডেনের বক্তব্যে নানামুখী প্রভাব পড়বে। আরও বড় পরিসরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাইডেন ও পুতিন দুজনই ভাবতে পারেন, তাঁরা এ ধরনের আগুন উসকানোর খেলা খেলে যাবেন। কিন্তু এতে তাঁরা দুজনই শুধু হারবেন না, সারা বিশ্বকে মারাত্মক বিপদের মধ্যে ফেলে দেবেন।

বাইডেন ও পুতিনের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা দেখে মনে হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জয় কিংবা পরাজয় ছাড়া অন্য কোনো ফলাফল তাঁরা মেনে নেবেন না। রাশিয়া যদি হেরে যায়, তাহলে মস্কো গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারে। কিংবা চরম নৈরাজ্যকর একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার বর্তমান শাসকদের পতন হতে পারে। এ দুটির একটাও আমাদের স্বার্থ হতে পারে না।

আমরা এখন ১৯৬০-এর দশকে কিউবাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের চেয়ে ভয়াবহ একটি সময় পার করছি। সে সময় উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে শীতল যুদ্ধের দুই পক্ষ একটা পূর্ণমাত্রার পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিপদ উপলব্ধি করতে পারছেন না কিংবা নিজের দায়দায়িত্বটা বুঝতে পারছেন না। বাইডেনের বেপরোয়া বাখোয়াজি শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। ইউরোপের সরকারপ্রধানদের কাছ থেকে কিংবা ন্যাটো থেকে যেসব বক্তব্য আসছে, তাতেও শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো আলামত নেই। পুতিনের বিবৃতি তো যেকোনো সময়ের চেয়ে জঘন্য।

খোলাখুলিভাবে বলি, যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই নতুন চুক্তিটি সমর্থন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এর আগে মিনস্ক চুক্তি মানেনি। কিন্তু এবার তারা সেটা করতে পারে না। এই চরম সংকটে বাইডেন প্রশাসনকে অবশ্যই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। এখন পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক ও নাজুক। সব কটি কাজ শেষ করতে দু-তিন মাস সময় লেগে যাবে। বড় কোনো বিপর্যয়ের আগে কিছু প্রক্রিয়া এখনই শুরু করা প্রয়োজন।

এসব উসকানিমূলক বাখোয়াজি বাদ দিয়ে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান সংকটের বাস্তবসম্মত ও কেজো সমাধান খোঁজা প্রয়োজন। এই যুদ্ধের নায়ক যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ন্যাটোর কেউই রাশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারছে না। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে চুক্তি করা প্রয়োজন। সব দেশই (শুধু রাশিয়া বাদে) স্বীকার করে নিয়েছে, ইউক্রেন একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনও সেটা বলে আসছে।

সবারই এখন উপলব্ধিতে আসা প্রয়োজন যে ইউক্রেনের দিক থেকে করা প্রত্যাশার সীমাবদ্ধতা আছে। পারমাণবিক বোমার ব্যবহার হতে পারে কিংবা পুরো ইউরোপে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে, সম্ভাব্য এমন কোনো পদক্ষেপ থেকে ইউক্রেনকে অবশ্যই নিবৃত্ত করতে হবে। এ যুদ্ধে কে জিতবে, সেটা সত্যিকারের প্রশ্ন নয়, প্রশ্নটি হলো যুদ্ধ শেষের ফলাফল কী হবে। প্রশ্ন হলো সেই জয়-পরাজয় নির্ধারণে কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ হবে আর কত মানুষের অযথা মৃত্যু হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমাধানের একটা রূপরেখা এখানে দেওয়া হলো:
১. সমাধানের ভিত্তি হতে পারে, ইউক্রেনের রুশভাষী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা ও দুই পক্ষের জন্যই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এর অর্থ হলো, ইউক্রেনে ন্যাটোর উপস্থিতি থাকবে না এবং ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়ার কোনো সেনা থাকবে না।
২. ২০১৫ সালে মিনস্ক-২ চুক্তির একটি শর্ত ছিল, লুহানস্ক ও দোনেস্ক ইউক্রেনের স্বশাসিত এলাকা হবে। কিন্তু সেই চুক্তি কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। সেটাকে অন্ধকার থেকে আলোতে আনা জরুরি।
৩. মূল বিষয়টি হচ্ছে স্বায়ত্তশাসন ও ইউক্রেনের রুশভাষী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তা। ফলে রাশিয়া ও অন্যান্য বৈধ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ওই এলাকায় বাস করা অ-রুশভাষী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

৪. চুক্তির আওতাধীন এলাকা ক্রিমিয়া পর্যন্ত হতে হবে। ব্যতিক্রম থাকবে শুধু সেভাস্তোপল। ইউক্রেনের উচিত সেভাস্তোপলকে রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দেওয়া।
৫. ইউক্রেনকে আর অস্ত্র সরবরাহ করবে না কিংবা ইউক্রেনকে ন্যাটোর কার্যত সদস্য হিসেবে বিবেচনা করবে না, এমন পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে অবশ্যই নিতে হবে।
৬. ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে অবশ্যই ইউক্রেনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে হবে। ইউক্রেনের সীমানা চিহ্নিত করতে হবে।
৭. রাশিয়ার জনগণের সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম ও শিক্ষার প্রতি অবশ্যই ইউক্রেনকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে।
৮. বাইডেন প্রশাসন ও ন্যাটোর নেতাদের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বসতে হবে। কিন্তু সেই সভায় যাওয়ার আগে কিছু বিষয়ে তাঁদের ধারণা পাকাপোক্ত করে যেতে হবে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বলতে তাঁরা কী বোঝেন, কী কী বিষয়ে আইন ও বিধি সংশোধন তাঁরা করতে চান এবং সেখানে কীভাবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের (ইউরোপীয় নয়) মোতায়েন করা যাবে, মোটাদাগে এই তিন বিষয়ে অবস্থান নিয়ে যেতে হবে।

৯. যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠবে, তাদের আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে যেতে হবে।
১০. সব বন্দীর বিনিময় করতে হবে। কাউকে বিচার কিংবা নির্যাতন করা যাবে না।
১১. প্রস্তাবিত চুক্তির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাশিয়ার সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
১২. বাইডেনের সীমাবদ্ধতা ও ন্যাটোর চরম অবস্থানের কারণে এসব কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া জাতিসংঘ মহাসচিবের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হতে হবে।

খোলাখুলিভাবে বলি, যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই নতুন চুক্তিটি সমর্থন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এর আগে মিনস্ক চুক্তি মানেনি। কিন্তু এবার তারা সেটা করতে পারে না। এই চরম সংকটে বাইডেন প্রশাসনকে অবশ্যই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। এখন পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক ও নাজুক। সব কটি কাজ শেষ করতে দু-তিন মাস সময় লেগে যাবে। বড় কোনো বিপর্যয়ের আগে কিছু প্রক্রিয়া এখনই শুরু করা প্রয়োজন।

  • স্টেফেন ব্রায়েন আমেরিকান সেন্টার ফর ডেমোক্রেসির সিনিয়র ফেলো
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে