‘ইন্ডিয়াত জাহাজ যায়, হামরা চিলমারী-রৌমারী ফেরিত যামো কুন দিন?’

ভারতের ‘গঙ্গাবিলাস’ প্রমোদতরি বন্দরে এলে যাতে পন্টুনে বাঁধা যায়, তার জন্য পন্টুন মূল নদীতে সরানোর জন্য চর কাটা হচ্ছে
ছবি : লেখক

চিলমারী বন্দর। সামনে ড্রেজিং চলছে। চিলমারীর বিআইডব্লিউটিএর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মচারীরা জানাচ্ছেন, গত ১০ জানুয়ারি ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসি থেকে ‘গঙ্গাবিলাস’ নামের রিভারক্রুজ চিলমারী হয়ে আসামের ডিব্রুগড় যাবে। এই প্রমোদতরির দৈর্ঘ্য ৬২ দশমিক ৫ মিটার, প্রস্থ ১২ দশমিক ৮ মিটার। চিলমারীতে এসে দাঁড়াবে ১৪ বা ১৫ ফেব্রুয়ারি। ১০ জানুয়ারি প্রমোদতরিটির যাত্রা শুরু হয়েছে, শেষ হবে আগামী ১ মার্চ।

পুরো ভ্রমণে সময় লাগবে প্রায় ৫০ দিন। এটি হবে পৃথিবীর দীর্ঘতম আন্তরাষ্ট্রীয় নদীযাত্রা। অতিক্রম করবে চার হাজার কিলোমিটার নৌপথ। এটি ২৭টি নদী-প্রণালির ভেতর দিয়ে যাবে। দাঁড়াবে চিলমারী মতো বন্দর ও সুন্দরবন, গঙ্গা আরতি, আসামের কালো জাদু ও কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানের মতো ৫০টি স্টপেজে। এই যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন করতে এই ড্রেজিং। ভারতের কেন্দ্রীয় জাহাজ ও নৌপরিবহনমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়াল বলেছেন, ‘এটি হবে গোটা বিশ্বে একটি জাহাজেই বৃহত্তম একক নদীযাত্রা এবং এটি ভারত ও বাংলাদেশ উভয়কেই বিশ্বের রিভারক্রুজ মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করবে।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো এতে বাংলাদেশের নগদ লাভ কতটুকু?

২.

‘ফেরি যাবে অন্য রুটে’ শিরোনামে গত ২৪ জুন প্রথম আলোয় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। তাতে জানানো হয়, পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক রুটে ১৯টি জেলার মানুষ চলাচল করে। নৌপথে দুই রুটে চলে ২৯টি ফেরি। সেতু চালুর পর মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ও শরীয়তপুরের কাঁঠালবাড়ির মধ্যে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। ফেরির সংখ্যা কমানো হবে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটেও। তখন এই দুই রুট থেকে ফেরি অন্যান্য রুটে সরিয়ে নেওয়া হবে।

প্রতিবছর এই দুই রুটে চলাচলকারী ফেরি থেকে ৩৫০ কোটি টাকা আয় হয় বিআইডব্লিউটিএর। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আয় প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তারা ১৯টি নতুন ফেরি রুট চিহ্নিত করেছে। আর বর্তমান চালু রুটেও ফেরির সংখ্যা বাড়ানো হবে। আর সবচেয়ে অগ্রাধিকারের তালিকায় নাকি আছে চিলমারী থেকে রৌমারী রুট। বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানিয়েছে, এটি চালু হলে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হবে।
শুধু কি তা-ই, ঢাকা থেকে রৌমারী বাসে আসতে লাগে ৪ ঘণ্টা। কুড়িগ্রাম থেকে যেখানে বাসে ঢাকা যেতে লাগে ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা, ট্রেনে ১১ ঘণ্টা; সেখানে ফেরি হলে বড়জোর সাড়ে ৫ ঘণ্টা লাগবে। লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড় নতুন রুট তৈরি হবে।

‘চোখের সামনে ভারতের বিশাল জাহাজ যাবে, কিন্তু চিলমারী-রৌমারী ফেরি চলবে কুন দিন’—একই প্রশ্ন রমনা ঘাটের দোকানি নুর আমিনের (৫০)। আর কুড়িগ্রাম-রংপুরবাসীকে সেই নাটোর ঘুরে বাড়ির কাছের সিরাজগঞ্জে ফিরে ঢাকা যেতে হয় ১১ ঘণ্টায়। বাসে জ্যাম থাকলে তো দুই দিন। সেখানে রৌমারী হয়ে কুড়িগ্রাম জেলা সদর থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টায় ঢাকা যাওয়া যায় ফেরি যোগাযোগ থাকলে। কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাটবাসী কেমনে সহ্য করে!

৩.

‘জাহাজ বান্ধার পন্টুন টাইমমতো সরায় নাই, এলা শুকনাত পইড়ছে। সেই পন্টুন পানিত নেওয়ার জইন্যে জাগি ওঠা জমি কাইটবের নাইগছে বিআইডব্লিটিএর ড্রেজার।’ এমনটা জানালেন চিলমারীর রমনা ঘাটের মতিয়ার রহমান (৫০), তারা (৪০), প্রতুলসহ (৩৫) কয়েক নারী-পুরুষ।

উল্লেখ্য, ভারতের ‘গঙ্গাবিলাস’ প্রমোদতরি বন্দরে এলে যাতে পন্টুনে বাঁধা যায়, তার জন্য পন্টুন মূল নদীতে সরানোর জন্য চর কাটা হচ্ছে। বালু কিনারে না ফেলে রাখা হচ্ছে স্রোতের মধ্যে। এতে একদিকে প্রবাহ আটকে যাওয়ার ভয়, অন্যদিকে তীর সংরক্ষণ প্রকল্প ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন ব্রহ্মপুত্রপাড়ের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা। অথচ পানি থাকতে পন্টুনটা সরিয়ে নিলে এত ব্যয় করে ড্রেজিং করতে হতো না!
নব্বইয়ের দশকে ডাকাতি ও একজন ব্যবসায়ী খুনের ঘটনায়  চিলমারী-বাহাদুরাবাদ রেল সংযোগের অংশ হিসেবে স্টিমার সেবাটি বন্ধ হয়ে যায়। তার পর থেকে চিলমারী আরও প্রান্তিক আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সারা দেশ থেকে। তার আগে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের সঙ্গে নৌযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরে সেটি চালু হলেও অভ্যন্তরীণ রুটে ফেরি যোগাযোগটি আর চালু হয়নি।

আগে রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলা কয়েকটি নদীর কারণে জামালপুর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। (মুক্তিযুদ্ধে রৌমারী মুক্তাঞ্চল হওয়ার এটাও অন্যতম কারণ) কিন্তু বর্তমানে রৌমারীর সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় চিলমারী-রৌমারী ফেরি চালু হলেই ঢাকা বাড়ির কাছে হবে। চিলমারী উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মান্নান সরকার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যেখানে ভারতে বিশাল জাহাজ যাচ্ছে, নিয়মিত কয়লা ও পাথর আমদানি-রপ্তানি চলছে, সেখানে ওপাড়ে রৌমারীর সঙ্গে ফেরি চলাচল না হওয়ার তো কারণ নেই। আর এটা হলেই ঢাকা আমাদের পড়শি জেলা হয়।'

রেল-নৌযোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জামিউল ইসলাম (৩৫) বলেন, এর আগে ধরলা সেতু হওয়ার পর তার ফেরিগুলো ধরলাপাড়েই নষ্ট হয়ে গেল। এবারও পদ্মা সেতু হওয়ার পর ফেরিগুলো বিআইডব্লিউটিএ কি ফেলে রাখবে? একদিকে আমরা ফেরির অভাবে দেশের অর্থনীতির মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছি, অন্যদিকে দক্ষিণবঙ্গে ফেরি পতিত থাকে। এ কেমন ফাজলামো কুড়িগ্রামবাসীর সঙ্গে?

আরও পড়ুন

‘চোখের সামনে ভারতের বিশাল জাহাজ যাবে, কিন্তু চিলমারী-রৌমারী ফেরি চলবে কুন দিন’—একই প্রশ্ন রমনা ঘাটের দোকানি নুর আমিনের (৫০)। আর কুড়িগ্রাম-রংপুরবাসীকে সেই নাটোর ঘুরে বাড়ির কাছের সিরাজগঞ্জে ফিরে ঢাকা যেতে হয় ১১ ঘণ্টায়। বাসে জ্যাম থাকলে তো দুই দিন। সেখানে রৌমারী হয়ে কুড়িগ্রাম জেলা সদর থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টায় ঢাকা যাওয়া যায় ফেরি যোগাযোগ থাকলে। কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাটবাসী কেমনে সহ্য করে! বৈষ্ণব পদাবলীর পদকর্তা চন্ডীদাসের আক্ষেপের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে হয়, ‘কেমনে বাঁধিব হিয়া/ আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়/ আমার আঙিনা দিয়া।’