নেপালেও দেখা গেল ইন্টারনেট বন্ধ করলে উল্টো ফল হয়

পার্লামেন্টের বাইরে দাঙ্গা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বিক্ষোভকারীরা। কাঠমান্ডু, নেপাল, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ছবি: এএফপি

কাঠমান্ডুর রাস্তায় যা ঘটেছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার কাছে নতুন কিছু নয়। তরুণদের ঢল, কারফিউ অমান্য, ভবনে আগুন, গুলির শব্দ, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নেপালি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘোষণা—এর সবই এ অঞ্চলে সম্প্রতি দেখা গেছে। প্রতারণা, ঘৃণা আর বিভ্রান্তি ঠেকানোর নামে নেপালের সরকার বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু এতে সমস্যা কমেনি, বরং আন্দোলন আরও তীব্র হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে ডিজিটাল ব্ল্যাকআউট কোনো সমাধান নয়, বরং তা জনগণের ক্রোধকে আরও বাড়িয়ে দেয়—এ বাস্তবতা কেন দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা বুঝতে চাইছেন না?

নেপালের ঘটনা বাংলাদেশের কাছে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন সরকারি চাকরিতে কোটার প্রশ্ন থেকে শুরু হয়ে ডিজিটাল দমননীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। সেই সময় দেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা ঘটে।

আরও পড়ুন

 দুটি ঘটনার সংকট ভিন্ন হলেও ভুলটা একই—সামাজিক অস্থিরতা মোকাবিলায় ডিজিটাল জোরজবরদস্তি। যুক্তিটা সব সময় একই। সরকার মনে করেছে গুজব, প্রতারণা ও ঘৃণাবাদ ঠেকাতে ইন্টারনেট বন্ধ করতে হবে। কিন্তু ফল হয় উল্টো। এতে আতঙ্ক ছড়ায়, গুজবের বাজার গরম হয় আর সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়।

মানুষ যখন প্রতিদিনের তথ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, সরকারও বাস্তব সময়ে কথা বলার ক্ষমতা হারায়। সেই শূন্যস্থান ভরে যায় জল্পনা ও সন্দেহে। নেপালের রক্তক্ষয় আর তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার দেখিয়ে দিয়েছে, ব্ল্যাকআউট কোনো শৃঙ্খলা আনে না, বরং ক্ষোভের আগুন বাড়ায়।

তরুণ প্রজন্মের দাবি একটাই, তাঁদের নাগরিক অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করবেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উৎপাত থাকবেই, কিন্তু জেন-জির কণ্ঠস্বর থামানো যাবে না।

বাংলাদেশ ২০২৪ আর নেপাল ২০২৫—দুটি ঘটনার মধ্যে চারটি মিল পাওয়া যায়। প্রথমত, যুবসমাজ এসব নিষেধাজ্ঞাকে সরাসরি তাদের বাক্‌স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ মনে করে। এতে আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়। বাংলাদেশের তরুণেরা বিকল্প চ্যানেল, অফলাইন সংগঠন আর প্রমাণ সংরক্ষণের পথ বেছে নিয়েছিলেন। নেপালের তরুণেরাও দুর্নীতিবিরোধী দাবির পাশাপাশি প্ল্যাটফর্ম খোলার দাবিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, নেটওয়ার্ক বন্ধ হলে সরকার নিজেই অন্ধকারে চলে যায়। গুজব প্রতিহত করা যায় না, বরং আরও ছড়ায়।

বাংলাদেশের দীর্ঘ ব্ল্যাকআউট গুজবের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল; নেপালের এক দিনের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারও প্রমাণ করে যে তথ্যশূন্যতা জবরদস্তি শাসনের অনুকূলে যায় না।

তৃতীয়ত, বিক্ষোভে গুলি চালানো রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ঢাকা হোক বা কাঠমান্ডু, শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালালে সরকারের বৈধতা দ্রুত হারায়। নিহত ব্যক্তিদের নাম, শিশুর মৃত্যুর খবর ও হাসপাতালের বর্ণনা সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।

চতুর্থত, একবার ‘জরুরি’ ডিজিটাল ব্যবস্থা শুরু হলে তা নিয়মে পরিণত হয়। নির্বাচন, প্রতিবাদ বা নিরাপত্তার অজুহাতে বারবার এ পদ্ধতি ব্যবহার হয়। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এর প্রমাণ আর নেপালের ঘটনাও সেই সতর্কতা নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে।

 দমননীতি চাপ তৈরি করে, সেই চাপ প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশ্বাস ভেঙে দেয় আর প্রতিটি ধাপে প্রতিরোধ ও দমন একসঙ্গে তীব্র হয়। শেষে বিস্ফোরণ ঘটে আর ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে বা পাল্টে যায়। নেপালের ৪৮ ঘণ্টার ঘটনায় এই চক্র দেখা গেছে ছোট আকারে; বাংলাদেশের ২২ দিনের ব্ল্যাকআউটে সেটি বড় আকারে ঘটেছে।

আরও পড়ুন

এবার প্রশ্ন হলো, দক্ষিণ এশিয়ার করণীয় কী? প্রথমে ব্ল্যাকআউটের বদলে সীমিত ব্যবস্থা নিতে হবে, যেটি হবে স্বল্প সময়ের, নির্দিষ্ট পরিসরে ও আদালতের তত্ত্বাবধানে। প্রতিটি পদক্ষেপে প্রমাণ, সময়সীমা ও পর্যালোচনার শর্ত থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত, আগে থেকেই সংকটকালে তথ্য দেওয়ার জন্য আলাদা চ্যানেল তৈরি করতে হবে। সরকার, সাংবাদিক আর ফ্যাক্টচেকার একসঙ্গে কাজ করলে গুজব ঠেকানো সহজ হবে। তৃতীয়ত, জনগণকে নয়, অপরাধীদের নিশানা করতে হবে। প্রতারণা, ঘৃণাবাদ আর উসকানির নেটওয়ার্ককে আইনের আওতায় আনতে হবে। সাধারণ ব্যবহারকারীর কণ্ঠ বন্ধ করা যাবে না।

চতুর্থত, সংবেদনশীল সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নতুন ভাইরাল কনটেন্ট ধীর করা, ভুয়া ছবি-ভিডিওতে সতর্কবার্তা দেওয়া জরুরি।

শিশু ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা আগে নিশ্চিত করতে হবে। ঘৃণামূলক আক্রমণ বা ডিপফেক কনটেন্ট দ্রুত সরাতে বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিবাদ দমনে পুলিশের আচরণ হতে হবে মানবিক ও স্বচ্ছ। ভিড় নিয়ন্ত্রণে গুলি নিষিদ্ধ করতে হবে, পুলিশের পোশাকি পরিচিতি ও বডিক্যামের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং ঘটনার প্রতিবেদন সাত দিনের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে।

স্থানীয়ভাবে আস্থা গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও এনজিওর সহযোগিতায় ফ্যাক্টচেকিং ও মিডিয়া শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আঞ্চলিক চুক্তির মাধ্যমে প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, তারা ব্ল্যাকআউট করবে না, বরং গুজব দমনে একসঙ্গে কাজ করবে। সরকারগুলোকেও নিয়মিত জানাতে হবে কতবার কনটেন্ট সরানো হয়েছে বা জরুরি আদেশ জারি হয়েছে।

প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়া বড় বাজার, কিন্তু ঝুঁকিও অনেক। সংকটকালে ভাইরাল ধীর করা, স্থানীয় নিরাপত্তা টিম গড়া আর স্বাধীন অডিট চালানো জরুরি।

সবশেষে দক্ষিণ এশীয় সরকারগুলোর জন্য বার্তা স্পষ্ট—বিভ্রান্তি, প্রতারণা আর ঘৃণাবাদ বাস্তব সমস্যা, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেট বন্ধ করে সমাধান হবে না। এই অঞ্চলের সরকারগুলোর তথ্যব্যবস্থার ধারণাও বড্ড সেকেলে। নেপালের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ আর বাংলাদেশের রক্তপাত একই শিক্ষা দেয়—সমাধান দমনে নয়, বুদ্ধিদীপ্ত নিয়ন্ত্রণে।

তরুণ প্রজন্মের দাবি একটাই—তাদের নাগরিক অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করবেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উৎপাত থাকবেই, কিন্তু জেন-জির কণ্ঠস্বর থামানো যাবে না। এ পথেই দক্ষিণ এশিয়া বাক্‌স্বাধীনতা আর সামাজিক সংহতির ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে।

  • রিজওয়ান-উল-আলম সহযোগী অধ্যাপক, মিডিয়া, কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়