ইটপাটকেলের জবাবে গুলি চালানো কীভাবে ‘খেলা’ হতে পারে?

নয়াপল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। গতকাল বুধবার
ছবি: প্রথম আলো

আওয়ামী লীগ নেতারা কয়েক মাস ধরে বলে আসছেন, ‘খেলা হবে।’ বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মুখেই এ কথা আমরা বারবার শুনে আসছি। গতকাল বুধবার তিনি আবারও বললেন, ‘ফুটবল মাঠে খেলা হচ্ছে, রাজনীতির মাঠেও খেলা হবে। নির্বাচনেও খেলা হবে।’ কক্সবাজারের জনসভায় তিনি যখন রাজনীতি ও নির্বাচনের খেলার কথা বলছেন, ঠিক একই সময়ে রাজধানীর মিরপুরে চলছিল ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ক্রিকেট সিরিজ।

আবার একই সময়ে নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে যে ঘটনা ঘটে গেল, সেটিই যেন সব খেলাকে ছাপিয়ে গেল। সেটি হওয়াই স্বাভাবিক নয় কি! সাধারণ মানুষের মধ্যেও আলোচনা তৈরি হয় যে—খেলা কি শুরু হয়ে গেল! প্রশ্ন উঠতে পারে, ইটপাটকেলের বিপরীতে গুলি চালানো কীভাবে ‘খেলা’ হতে পারে?

নয়াপল্টনে গতকাল সারা দিন কী ঘটেছে, সেটি কারও অজানা নয়। একজন নিহত হয়েছেন। তার মানে কেউ বিধবা হলেন, কেউ হলো এতিম। সেটিই আমরা দেখলাম। এ দেশের রাজনৈতিক সহিংসতায় এটিই যেন চিরায়ত বাস্তবতা। যখন রাষ্ট্রীয় জবরদস্তি, সরকারের অগণতান্ত্রিক মনোভাব, পুলিশি হামলা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীদের মারমুখী অবস্থান উপস্থিত থাকে সেই বাস্তবতা হয়ে ওঠে আরও সংকটপূর্ণ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি এমন আচরণ অতীতে নানা সময়ে বহুবার দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। গতকাল আবারও দেখল।

সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল, তার আঁচ বুঝতে সন্ধ্যার পর হাজির হলাম নয়াপল্টন এলাকায়। ফকিরেরপুল মোড় থেকেই পুলিশের ব্যারিকেড। মানুষের হাঁটাচলা নেই বললেই চলে। নয়াপল্টন এলাকার গলির ভেতরে ভেতরে আর বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিচে অল্পবিস্তর মানুষের জটলা। এর মধ্যেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দিকে এগিয়ে চললাম।

বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দিকে যেতেই দেখা গেল ট্রাক থেকে পুলিশ তারকাঁটার ব্যারিকেড ফেলছে।

গোটা রাস্তা পুলিশ আর পুলিশের গাড়ি। বেশ কিছু প্রিজন ভ্যানও। আর আছেন সংবাদকর্মীরা। কোনো কোলাহল নেই। পিচঢালা রাস্তার দিকে তাকালে মনে হবে, পরিত্যক্ত এক যুদ্ধক্ষেত্র। এর মধ্যেই বিকট আওয়াজ। ট্রাক থেকে পুলিশ তারকাঁটার ব্যারিকেড ফেলছে, সেটিরই শব্দ। এতেই গোটা এলাকা যেন খান খান। নয়াপল্টন রোডে যেসব অলিগলি এসে মিশেছে, সেগুলোর সামনে এসব ব্যারিকেড বসানো হচ্ছে। অলিগলির গেটগুলোও লাগানো। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, আগামীকাল মানে আজকের প্রস্তুতি। পুলিশ কাউকে আর নয়াপল্টনে ঢুকতে দেবে না। পাশ দিয়ে দুজন হেঁটে ফকিরেরপুলের দিকে চলে যাচ্ছিলেন কথা বলতে বলতে। তাঁদের কেউ একজন বলছিলেন, মানুষের জোয়ার শুরু হলে কিছুই ঠেকাতে পারবে না।

বারবার একাধিকজনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম, সবাই এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। মূলত বেশির ভাগই হাঁটছিলেন। কীভাবে নিরাপদে এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন, সেই পেরেশানিই তাঁদের চোখেমুখে। একেবারে ফুটপাতের ঘা ঘেঁষে কেউ ফকিরেরপুলের দিকে আবার কেউ কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড়ের দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটছিলেন। এর মধ্যে এক–দুজনকে পেয়ে গেলাম। তাঁদের কথাবার্তা শুনে বেশ মজা পাওয়া গেল। একজনের গায়ে সিকিউরিটি গার্ডের পোশাক। কোনো কোম্পানির সিল লাগানো সাদা শার্ট ইন করা সুপারভাইজারের মতো আরেকজন তাঁকে বোঝাচ্ছিলেন, কেউ যদি ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তিনি কী বলবেন। সিকিউরিটি গার্ডকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন: ‘বিএনপি নেতা-কর্মীরা রাস্তা আটকিয়ে এখানে ভিড় জমাচ্ছিল। সেখানে পুলিশ এসে তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তখনই পুলিশের ওপর বিএনপির নেতা-কর্মীরা অতর্কিত হামলা চালায়।’ এরপর দুজনেই হাসতে হাসতে কিছুদূর গিয়ে এক ব্যাংকের ভবনের ভেতরে ঢুকে গেলেন। কোনো ঝামেলা থেকে বাঁচতে এখন এর চেয়ে নিরাপদ বয়ান আর কী হতে পারে!

এমন সময় কয়েক পা এগোতেই ভয়াবহ আওয়াজ। আগের অভিজ্ঞতা থেকেই তাৎক্ষণিকভাবে বুঝলাম, বোমা বিস্ফোরণ। তাড়াতাড়ি ফুটপাতের এক পাশে অন্ধকার দোকানের নিচে সেঁটিয়ে গেলাম। বিএনপি কার্যালয়ের দিকে তাকাতেই রাস্তার ওপর ধোঁয়া উড়তে দেখলাম। তবে রাস্তাজুড়ে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, কোনো দৌড়াদৌড়ি নেই। সেটি দেখে আবার রাস্তায় নেমে এলাম। পেয়ে গেলাম পুলিশের বোম ডিসপোজাল ইউনিটের এক কর্মকর্তাকে। জিজ্ঞাসা করলাম, কী ঘটল। তিনি বললেন, ককটেল নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। বিএনপি কার্যালয়ের ভেতরে ককটেলগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই বোমা পুলিশই বিএনপি কার্যালয়ে নিয়ে ঢুকেছে।

বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পুলিশের অবস্থান। বুধবার রাত নয়টায়।
রাজনৈতিক সমাবেশ এ দেশের সাংবিধানিক অধিকার। সেটি যেকোনো রাজনৈতিক পক্ষের জন্যই সত্য। সেই অধিকার বিএনপি তার কার্যালয়ের সামনে বিভিন্ন সময় পেয়েও এসেছে। পুলিশ ও প্রশাসন সেসব সমাবেশ করতে তেমন বাধাও দেয়নি। কিন্তু ১০ ডিসেম্বর সেই একই জায়গায় সমাবেশ করতে দিতে সরকার কেন অনড় বুঝে আসে না। বিএনপিকেও কেন সেই একই জায়গাতেই সমাবেশ করতে হবে?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও একটি ভিডিও গতকাল থেকে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ বিএনপি কার্যালয়ে ঢুকছে আর তাদের একজনের হাতে প্লাস্টিকের বাজারের ব্যাগ। ভারী বস্তুবোঝাই সেটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই একে পুলিশের বোমা বহন বলে দাবি করেছেন। এই ভিডিওটি নিয়ে অবশ্য পুলিশের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কেন বোমা রাখতে যাবে বিএনপি?

এরই মধ্যে রাস্তার উল্টো পাশে আরেক দফা বোমা নিষ্ক্রিয় করা হলো। জানতে পারলাম, আগে আরেক দফা বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। মোট তিন দফায় ১৫টি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হলো, যেগুলো বিএনপি কার্যালয় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের।

গোটা কাজটি পরিচালনা করছিল বোম ডিসপোজাল ইউনিট। পুলিশ সদস্যদের অনেকেই সড়ক বিভাজকের ওপর বসে আছেন। বলা যায়, সারা দিনের দায়িত্ব পালন শেষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। দু-একজন হকার ঝালমুড়ি, পানি, মুড়ি-চিড়ার মোয়া, সিগারেট নিয়ে ঘুরছেন। পুলিশ সদস্যরাও এটা-সেটা কিনে খাচ্ছিলেন। বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পুলিশের একটি হুডওয়ালা ভ্যান দাঁড়িয়েছিল। সাংবাদিকেরা সেদিকে এগিয়ে গেলেন। দেখতে পেলাম, বিএনপি অফিস থেকে চাল-ডালের বস্তা, ভোজ্যতেলের বোতল গাড়িতে তোলা হচ্ছে। ধারণা করি, সমাবেশ উপলক্ষে আসা নেতা-কর্মীদের খাবারদাবার আয়োজনের জন্য এসব কিনে রাখা হয়েছিল।

সে সময় একজন টিভি সাংবাদিক বিএনপি কার্যালয়ের দিকে ঢুকলেন। পুলিশও কিছু বলল না বা বাধা দিল না। ফলে আরও সাংবাদিক ঢুকলেন কার্যালয়ের ভেতরে। ভেতরে ঢুকতেই অন্ধকার সিঁড়ি। মুঠোফোনের আলো জ্বালিয়ে উঠতে হলো। কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজালো গন্ধ। চোখ কিছুটা জ্বালাপোড়াও করছিল। পাঁচতলা ভবনে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের অফিস। প্রতিটি তলাতেই ঢুকে দেখা গেল, দরজা ভাঙা। রুমগুলোও তছনছ হয়ে আছে। একজন সাংবাদিক মুঠোফোনে ভিডিও করতে করতে বলছিলেন, ‘কোথাও কেউ নেই। সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে।’ সেখানে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হচ্ছিল না কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজালো গন্ধের কারণে। ফলে নিচে নেমে আসতে বাধ্যই হলাম।

ককটেল নিষ্ক্রিয় করার পর। বুধবার রাত নয়টার দিকে। বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে, নয়াপল্টন।

পুলিশের পাশেই সড়ক বিভাজকের ওপর বসলাম। তখনই আরেকটি ঘটনা ঘটল। পাশে সাদা পোশাকধারী একজন আরেকজনকে বলছিলেন, ‘ওদেরকে এখন বেরিয়ে আসতে বল। কেউ ধরবে না।’ একজন বিএনপি কার্যালয়ের নিচে একটি শাটারে ধাক্কা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে শাটার খুলে ভেতর থেকে দুজন বেরিয়ে এসে ফুটপাত ধরে ফকিরেরপুলের দিকে দৌড়ে ছুটলেন।

আমিও উঠে তাঁদের পিছু নিলাম। প্রায় পাঁচ মিনিট হেঁটে ধরে ফেললাম তাঁদের। ভয়ার্ত চেহারা। কাহিনি কী?—জিজ্ঞাসা করলে বড় বড় দম ফেলে জানালেন, তাঁরা ডিজিটাল ব্যানারের কাজ করেন। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ উপলক্ষে বিএনপি অফিসে ব্যানার লাগানোর অর্ডার পেয়েছিলেন। এসেই পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে আটকে পড়েন। কয়েক ঘণ্টা আটকে থাকার পর ফোনে এর–ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারলেন। নাম বলতে চাইলেন না। জানালেন বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। শুধু বলছিলেন, ‘ভাই আমরা সাধারণ মানুষ। কষ্ট করে কামাই করে খাই। আমরা কোনো ঝামেলার মধ্যে নেই। কথা শুনে ও চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন জান ফিরে পেয়েছেন তাঁরা।’

রাত ১০টা বেজে গেছে। সাংবাদিকদেরও ঘরবাড়ি আছে। সারা দিন সংবাদ সংগ্রহ শেষে এবার ফেরার পালা। অনেকে শেষ মুহূর্তের আপডেট দিয়ে অফিস হয়েই ফিরবেন। নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে একটি রিকশা নিয়ে আমিও রওনা দিলাম ঘরের দিকে। রাস্তাঘাটে তেমন মানুষ বা গাড়ি চলাচল নেই। মিন্টো রোডে রমনা পার্ক এলাকায় এসে আরও ফাঁকা ফাঁকা লাগল। কিছুটা শীতও অনুভূত হলো। রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। জানতে চাইলাম, ঘটনার কী শুনলেন, সে সময় তিনি কোথায় ছিলেন? বললেন, সদরঘাট ছিলেন। শুনেছেন পুলিশের গুলিতে বিএনপির একজন মারা গেছেন। আরও জানতে চাইলাম, ‘সামনে কী হবে?’
তিনি বললেন, ‘পরিস্থিতি খুব খারাপ হবে।’
‘তো ভোট কি হবে?’
‘কিসের ভোট? গত দুইবার তো কোনো ভোটই দিতে পারি নাই।’
‘ভোট দিতে পারেননি বলতে ভোটকেন্দ্রে যেতে দেয়নি নাকি আপনার ভোট অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছে?’

‘আরেহ ভাই, ভোটই তো হয় নাই।’

সড়ক বিভাজকে বসে আছেন পুলিশ সদস্যরা। বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে, নয়াপল্টন।

বিএনপির এই সমাবেশের লক্ষ্যও ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়া। সেটিই তাঁরা দুই মাস ধরে বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে বলে আসছেন। সেসব সমাবেশে পরিবহন ধর্মঘটের নামে নানাভাবে বাধা দেওয়া ও প্রতিবন্ধকতা তৈরির আমাদের কারও অজানা নয়।

রাজনৈতিক সমাবেশ এ দেশের সাংবিধানিক অধিকার। সেটি যেকোনো রাজনৈতিক পক্ষের জন্যই সত্য। সেই অধিকার বিএনপি তার কার্যালয়ের সামনে বিভিন্ন সময় পেয়েও এসেছে। পুলিশ ও প্রশাসন সেসব সমাবেশ করতে তেমন বাধাও দেয়নি। কিন্তু ১০ ডিসেম্বর সেই একই জায়গায় সমাবেশ করতে দিতে সরকার কেন অনড় বুঝে আসে না। বিএনপিকেও কেন সেই একই জায়গাতেই সমাবেশ করতে হবে? এমন অনেক প্রশ্নের পর শেষ যে প্রশ্নটায় থামতে হয়, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে, মানুষের ভোটের অধিকার আদায়ের দাবিতে কেন একজন রাজনৈতিক কর্মীকে গুলি খেয়ে মরতে হবে?

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক