কার্বন আর প্লাস্টিক নামক ধরিত্রীঘাতী দানব বধ করতেই হবে

সমগ্র বিশ্ব এখন জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই–অক্সাইডের বর্তমান ঘনত্ব ৪২১ পিপিএম একটি বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বলা হচ্ছে, এই ঘনত্ব ১০ হাজার বছর আগে থেকে ১৮ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত শিল্পবিপ্লবের সময়কালীন ২৮০ পিপিএম থেকে প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০০৯ সালে জাতিসংঘের ১৫তম জলবায়ু সম্মেলন সামনে রেখে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই–অক্সাইডের ঘনত্ব ৩৫০ পিপিএমে সীমিত রাখার প্রয়াসে লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে দেশে দেশে বড় ধরনের ক্যাম্পেইন হয়েছিল।

এসব সামাজিক আন্দোলনে মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি হলেও বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই–অক্সাইডের ঘনত্ব বেড়েই চলছে, যা ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ।

জীবাশ্ম জ্বালানির অতি ব্যবহার বায়ুমণ্ডলের এই ঘনত্ব বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ। পাশাপাশি নির্বিচার বন উজাড় করা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করা এবং জৈব জ্বালানি পোড়ানোর মতো মানুষের নানাবিধ ক্রিয়াকলাপও অনেকাংশে দায়ী।

যদিও এখানে ব্যক্তি খাত ও সরকারি খাত টেকসই উন্নয়ন–প্রচেষ্টায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে, যেখানে আর্থিক খাত ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী এজেন্ট মাত্র।

আরও পড়ুন

এটা ঠিক, আর্থিক খাত বর্তমানে পরিবেশগত দায়বদ্ধতার পাশাপাশি টেকসই আর্থিক ব্যবস্থার বিকাশকেও উৎসাহিত করছে।

ফলে এটি বিশ্ব ধরিত্রী দিবসের ঐতিহাসিক শিক্ষা পরিপালনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, কমিউনিটিসহ সহস্রাধিক স্থানে প্রায় দুই কোটি মানুষের অংশগ্রহণে প্রথম এই দিবসটি পালিত হয়েছিল।

ওই বৃহত্তম পরিবেশগত প্রতিবাদ কর্মসূচির দিনটিই এখন ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস’ হিসেবে মানবেতিহাসে বিশেষভাবে জায়গা করে নিয়েছে।

‘ধরিত্রী বনাম প্লাস্টিক’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বিশ্বের অন্তত ১৯৩ দেশের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে ৫৪তম এই ধরিত্রী দিবসটি পালন করছে।

গত ৭৪ বছরে বিশ্বে প্লাস্টিকের উৎপাদনের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৫০ সালেও বিশ্বে মাত্র ২০ লাখ টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হতো, যা ২০২২ সালে বেড়ে ৪০ কোটি টনের বেশি এসে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৩৫ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে, যার মধ্যে ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ টন বর্জ্য মহাসাগরে যায়। এগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

আরও পড়ুন

পৃথিবীতে প্লাস্টিক উৎপাদনের পরিমাণ কম হলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবও কমে আসবে। এ লক্ষ্যে ২০৪০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে প্লাস্টিক উৎপাদনের পরিমাণ অন্তত ৬০ ভাগ কমিয়ে আনার চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এ জন্য সব শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, সরকার, গির্জা, বিভিন্ন ইউনিয়ন, ব্যক্তি এবং এনজিওগুলোকে একত্র করে মানবস্বাস্থ্য ও পৃথিবী নামক গ্রহের প্রতিবেশিক স্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে প্লাস্টিক বন্ধ করার অনুরোধসহ আগামী প্রজন্মের জন্য একটি প্লাস্টিক-মুক্ত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার অটল প্রতিশ্রুতির আহ্বান জানানো হয়েছে।

ধরিত্রী দিবসের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে আর্থিক খাতের টেকসই এবং দায়িত্বশীল অর্থায়নের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

বিশেষ করে বারাক ওবামার শাসনামলে ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো চালু হওয়া গ্রিন ব্যাংকিংয়ের সর্বশেষ ধারণা ও পরিকল্পনার ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশে ২০০৯ সালে এই গ্রিন ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হলেও ২০১১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রিন ব্যাংকিং–বিষয়ক সার্কুলার জারি করে এবং ২০২০ সালে বাংলাদেশে ‘সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স পলিসি’ গৃহীত হয়।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রিন ব্যাংকিং খাতে ৭৪ হাজার ৫১ মিলিয়ন টাকার বেশি এবং টেকসই আর্থিক নীতিমালার আওতায় প্রায় ৯ লাখ ৭ হাজার ৩৯ মিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করা হয়।

বাংলাদেশে উভয় ক্ষেত্রেই ক্রমাগত বিনিয়োগ বাড়ছে। তবে বিশ্বে ২০২২ সালে সাসটেইনেবল বা টেকসই আর্থিক বাজারের আকার ছিল প্রায় ৪ হাজার ৫৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩২ সালের মধ্যে প্রায় ২৯ হাজার ১১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

গ্রিন ব্যাংকিং খাতে ও টেকসই আর্থিক নীতিমালার আওতায় শুধু বিনিয়োগের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, একটি আর্থিক ব্যবস্থাকে টেকসই এবং দায়িত্বশীল করে তৈরি করতে হলে আর্থিক বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর (যেমন গ্রিন ব্যাংক, টেকসই সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি, গ্রিন এনার্জি কোম্পানি, সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ, টেকসই প্রযুক্তি কোম্পানি, গ্রিন রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, করপোরেট গ্রিন বন্ড ইস্যুইং কোম্পানি এবং টেকসই কৃষি ও খাদ্য কোম্পানি) যোগাযোগ বাড়াতে হবে।

পাশাপাশি প্রতিটি কোম্পানিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে সচেষ্ট হতে হবে।

এ কথা সত্য যে অর্থ মূলত সম্পদ বরাদ্দ এবং বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে আসছে। ঐতিহাসিকভাবে মুনাফাকে সর্বাধিকীকরণে প্রায়ই পরিবেশগত উদ্বেগগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো।

ফলে তারা অনেক সময় প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের কারণে পরিণত হয়েছে, যেটা জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতাকে আরও বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করেছে বা এখনো করছে।

যা হোক, বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলোতে পরিবেশগত বিবেচ্য বিষয়গুলোকে একীভূত করার অপরিহার্যতা স্বীকার করার কারণে জোয়ারটি ক্রমশ ভালোর দিকে মোড় নিচ্ছে।

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস পৃথিবী নামক এই গ্রহকে রক্ষা এবং সংরক্ষণ করার জন্য আমাদের সম্মিলিত দায়িত্বের মর্মস্পর্শী অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।

বিশেষ করে স্টেকহোল্ডারদেরকে তাদের অনুশীলনগুলো পুনর্মূল্যায়ন করতে এবং টেকসই নীতিমালাগুলোকে পালন করতে প্ররোচিত করছে।

এ ছাড়া ধরিত্রী দিবস পরিবেশগত টেকসই উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারকে একত্র করতে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমর্থনের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে।

জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে অপসারণের মাধ্যমেই হোক বা নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের প্রচারের মাধ্যমেই হোক, ধরিত্রী দিবস আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিবেশবান্ধব প্রয়াসের দিকে মূলধন জোগাতে উৎসাহিত করে। তদুপরি জলবায়ু-সম্পর্কিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের টাস্কফোর্সের (টিসিএফডি) মতো উদ্যোগগুলোর স্বচ্ছতা ও মান বাড়াচ্ছে, যা বিনিয়োগকারীদের জলবায়ু-সম্পর্কিত ঝুঁকি মোকাবিলা এবং সুযোগ সম্পর্কে সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে।

যেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকার, অলাভজনক সংস্থা এবং তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা অর্থপূর্ণ পরিবর্তন সাধনে এবং পরিবেশগত সমস্যাগুলো মোকাবিলায় সচেতনতা বাড়াতে একত্র হয়।

ফলে গ্রিন বন্ড এবং ইমপ্যাক্ট বিনিয়োগ তহবিল থেকে শুরু করে টেকসই ঋণদানের অনুশীলন এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য আর্থিক উপকরণগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে লিভারেজ করা হচ্ছে।

এই রূপান্তরটি কেবল নৈতিক প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি লাভজনক বাজার সৃষ্টির সুযোগকেও কাজে লাগানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা।

একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টেকসই অর্থায়ন ইতিবাচক পরিবেশগত ফলাফল বিস্তারকারী একটি বিশিষ্ট শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের টেকসই কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন করার জন্য একটি পরিবেশ, সামাজিক ও শাসনগত (ইএসজি) মানদণ্ড মেনে চলছে।

এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়নের মাধ্যমে শুধু আর্থিক আয়কে নয়, বরং সমাজ ও পরিবেশের ওপর বিস্তৃত প্রভাবকেও বিবেচনা করা হচ্ছে।

ধরিত্রী দিবস বিনিয়োগ কৌশলগুলো পুনরুদ্ধার করতে এবং স্থায়িত্বশীল উদ্দেশ্যগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য একটি বার্ষিক অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে।

জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে অপসারণের মাধ্যমেই হোক বা নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের প্রচারের মাধ্যমেই হোক, ধরিত্রী দিবস আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিবেশবান্ধব প্রয়াসের দিকে মূলধন জোগাতে উৎসাহিত করে।

তদুপরি জলবায়ু-সম্পর্কিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের টাস্কফোর্সের (টিসিএফডি) মতো উদ্যোগগুলোর স্বচ্ছতা ও মান বাড়াচ্ছে, যা বিনিয়োগকারীদের জলবায়ু-সম্পর্কিত ঝুঁকি মোকাবিলা এবং সুযোগ সম্পর্কে সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে।

ধরিত্রী দিবস অংশীদারত্বমূলক এবং সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবনকে অনুপ্রাণিত করে এবং আর্থিক ব্যবস্থাজুড়ে টেকসই অনুশীলন গ্রহণকে উৎসাহিত করে আসছে।

যার দরুন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তাদের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে জড়িত হওয়ার এবং টেকসই কর্মকাণ্ডে প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শনের একটি সুযোগ হিসেবে কাজ করে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট কৌশল এবং রিপোর্টিং ফ্রেমওয়ার্কগুলোতে পরিবেশগত বিবেচ্য বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে তারা নিজের খ্যাতি বাড়াতে পারে, দায়িত্বজ্ঞানহীন বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে এবং অর্থের নিয়ন্ত্রক হিসেবে ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।

এভাবে ধরিত্রী দিবস টেকসই ও দায়িত্বশীল অর্থায়নকে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে গভীর তাৎপর্য বহন করে থাকে।

  • এম এম মাহবুব হাসান ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক
    ই-মেইল: [email protected]