‘মাছে ভাতে বাঙালি’র পাতে আগের মতো মাছ পড়ে না। বড়জোর শাক পড়ে। তবে বিরাট আনন্দের কথা হলো, যখন বড় বড় রুই কাতলা থেকে ছোট ছোট ঢ্যালা-মলা মাছ মৎস-মেলা ছাড়াই ম্যালা পরিমাণ মিলত, তখনও ‘শাকে-ভাতে বাঙালি’ ছিল; এখনো আছে। আদ্যিকাল থেকে আমাদের হাটে-মাঠে-ঘাটে আছে শত পদের শাক। এর মধ্যে একটা হলো পাটশাক। গাছতলার থানকুনি-কুড়ানি থেকে পাঁচতলার মহারানি—কে না কচি বগী পাটশাকের ভক্ত? শোনা যায়, মিসরের রানি ক্লিওপেট্রাও ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখতে দুই বেলা পাট শাক খেতেন।
তো সেই পাটশাক, মানে পাটের পাতার চেহারা-সুরত, আকার-আকৃতি পকাৎ করে বদলে গেছে। ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবসে রাজধানীর বিজয় সরণি মোড়ে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সৌজন্যে টাঙানো ফেস্টুনের পাটের পাতার ছবি এ বিষয়ে প্রামাণ্য তথ্য দিয়েছে। তবে সেসব তথ্য অস্বীকার করে কিছু লোক ফেসবুকে বলে বেড়াচ্ছে, যে পাতার ছবি দেখা গেছে, সেটা নাকি পাটের পাতা না, সেটা নাকি গাঁজা গাছের পাতা!
আমাদের সোনালি আশের ‘গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকি?’ —এমন একটা নস্টালজিক ইমোশন মাখা আক্ষেপ থেকে পাটের সুদিন ফেরানোর জন্য মন্ত্রণালয় যখন প্রচার চালাচ্ছে, ঠিক তখন পাট পাতাকে গাঁজার পাতা বলে কি তারা গাঞ্জাখুরি অপপ্রচার চালাতে চাচ্ছে?
এটা ঠিক যে, ফেস্টুনে যে পাতাটির ছবি বসানো হয়েছিল, সে পাতাটির ধরন একটু নতুনমতো। একটা ডাঁটায় পাঁচটি ‘প্র-ডাঁটা’ (প্রশাখা টাইপের আরকি!)। দুটি প্রডাঁটা ডানে, দুটি বামে; আর ডান বামের মাঝখান দিয়ে সামনের দিকে গেছে একটি। প্রতিটি প্রডাঁটায় একটি করে ‘উপ-পাতা’। সব মিলিয়ে ‘একটি কুঁড়ি দুটি পাতা’র মতো ‘ফাইভ ইন ওয়ান’ টাইপের পাতা। সে পাতার কিনার আবার কুমিরের লেজের মতো ‘খাঁজ কাটা, খাঁজ কাটা’। এটাতেই প্যাঁচ লেগে গেছে। তার চেহারা দাঁড়িয়েছে অবিকল গাঁজা গাছের পাতার মতো। তাতেই পাট বিদ্বেষীরা পট পট করে ‘গাঁজার পাতা! গাঁজার পাতা!’ বলে ফেসবুকের পাড়া-মহল্লা মাথায় করছে। ‘ক্যানাবিস’ লিখে গুগলে সার্চ দেওয়ার পর মনিটরে ভেসে ওঠা ছবির স্ক্রিনশট পর্যন্ত দিয়ে দিচ্ছে। আরও কী কী সব প্রমাণ হাজির করছে।
অথচ সাঁইজি বলে গেছেন, ‘ওরে পাগলা, চর্ম চোখই সব না, অন্তরের চোখই আসল চোখ। দুই নয়নে যা দেখি, তার খুব অল্পই সত্যি; বাকি সব মায়া, সব মিথ্যে।’ মুখনিঃসৃত সেই ধুম্রাচ্ছন্ন সাধু বাক্যের মর্মবাণী ধরে ভাবের ঘোরে অন্তর্চক্ষু দিয়ে চাইলে বোঝা যায়, এক বৃন্তের খাঁজ কাটা পাতা মাত্রেই গাঁজার পাতা নয়।
একজন সরকারি কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পাট ও পাট জাতীয় ফসলের ৫৩টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈকত চন্দ্র হালদার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই ছবিটি পাটের নতুন জাত মেস্তা পাতার। ওই পাটের পাতাটিই এমন।’ কিন্তু সমস্যা হলো, পাট বলতে মানুষ পাটকেই বোঝে, মেস্তাকে নয়। মেস্তায় পাটের মতো আশ হয় বটে, কিন্তু তাঁকে কেউ পাটের দলে ফেলে না।
সর্বোপরি, এটি যদি নতুন জাতের মেস্তার পাতার ছবি হয়েও থাকে, তবু সেটি পাটের পাতার ছবি হিসেবে দিলে যে তাতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে, এটি ভাবতে তাঁরা ভুলে গেছেন। আর এটি ঠিক কোন প্রজাতির মেস্তা পাতার ছবি তাও সৈকত চন্দ্র হালদার বলতে ভুলে গেছেন। তিনি সেই জাতটির নাম বললে ফট করে তার পাতার ছবি বের করা যেত। কিন্তু কর্মকর্তারা অব্যক্ত ভাষায় গানে গানে সবাইকে যেন কানে কানে বলে দিয়েছেন, ‘না, না, তার নাম বলব না...নাম বলব না।’
বিজ্ঞানী জগদীশ বসু থাকলে হয়তো ওই কর্মকর্তার সুরে সুর মিলিয়ে ঠিকই বলতেন, ‘বিশ্বে কত লক্ষ পদের পাট বংশীয় উদ্ভিদ রহিয়াছে, তাহারা এলায়িত কুন্তলে কোথায় কোন অরণ্যে তাহাদের পত্রপল্লব প্রসারিত করিয়া আছে, তাহার কতখানিই বা আমরা জানি?’
তবে শুধুমাত্র ভাবের জগতে ঘুরলে যাঁদের চলে না, সেই গবেষকেরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের প্রচারে যে ছবি দেখা যাচ্ছে তা পাট পাতার নয়। পাটের জিন বিন্যাস আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী হাসিনা খান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও প্লান্ট টেক্সনমিস্ট ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেছেন, এটা কোনোভাবেই পাট পাতা নয়। মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেছেন, দেশে প্রধানত দুটি প্রজাতির পাটের চাষ হয়। এর মধ্যে একটির পাতা মিষ্টি, আরেকটার পাতা তিতা। সাধারণ মানুষের কাছে দেশি ও তোষা এই দুই ধরনের পাট পরিচিত। তিনি বলেছেন, পাট ছাড়া অন্যান্য প্রজাতির উদ্ভিদ থেকেও তন্তু পাওয়া যায়। তবে তা পাট নয়।
গবেষকদের বাইরে যাঁরা পাটখেত বিষয়ক নানা ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসেছেন, তাঁরাও বলছেন এটি পাট পাতা বা মেস্তা পাতা নয়।
এই ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ছোট, কিন্তু এর মধ্য দিয়েই বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অথর্ব, অদক্ষ গাঁজাপ্রেমী লোকের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। তাঁরা বলছেন, কর্মকর্তারা এখনো ভুল স্বীকার করেননি, বরং এটিকে নতুন প্রজাতির পাটের পাতা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে সেই নব আবিষ্কৃত জাতের গাঁজাসদৃশ পাট সবার সামনে হাজির করা হোক
এদের বাইরে একটি বিরাট অংশের মানুষ এই পাতাকে গাঁজার পাতা বলে দাবি করে দাবির পক্ষে তথ্য প্রমাণ দিচ্ছেন। আপনারা প্রশ্ন করতেই পারেন, ‘রতনে রতন চেনে, গাঁজা চেনে কে?’
আসলে বাঙালির মধ্যে যে গাঁজা খায়, সে যেমন গাঁজার পাতা চেনে, আবার যে খায় না, তারও চেনার কথা। কারণ বাঙালির গাঁজাপ্রেম তো আজকের নয়। অ্যালেন গিন্সবার্গ, বব মার্লেদেরও বহু আগে টেকচাঁদ ঠাকুর, হুতোম গাঁজা নিয়ে লিখেছেন। বাংলায় গাঁজার সরকারি কৃষিকর্ম শুরু হয়েছিল ১৯০৬ সালে ‘নওগাঁ গাঁজা সোসাইটি’র হাত ধরে।
তো, সেই বাঙালির গাঁজার পাতা না চেনার কথা না। কিন্তু সরকারের কর্মকর্তাদের কথায় তো ভরসা না করেও উপায় নেই। কাড়ি কাড়ি বেতন নেওয়া বিরাট বিরাট কর্মকর্তারা সামান্য একটা পাটের পাতা চিনবেন না, এটা তো গাঞ্জাখোরেও বিশ্বাস করবে না।
অনেকে বলাবলি করছেন, ভুল করে পাটের পাতার ছবির জায়গায় যদি গাঁজার পাতার ছবি চলে গিয়েই থাকে; এতে কী এমন হয়েছে?
পাল্টা জবাবে আরেক গ্রুপ বলছে, এই ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ছোট, কিন্তু এর মধ্য দিয়েই বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অথর্ব, অদক্ষ গাঁজাপ্রেমী লোকের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। তাঁরা বলছেন, কর্মকর্তারা এখনো ভুল স্বীকার করেননি, বরং এটিকে নতুন প্রজাতির পাটের পাতা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে সেই নব আবিষ্কৃত জাতের গাঁজাসদৃশ পাট সবার সামনে হাজির করা হোক। তাঁদের মতে, এই পাতাকে ‘পাটের পাতা’ বললে খালাকে শালা বলতে হয়; ছালার দোকানের নাম রাখতে হয় ‘বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়’।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক