অন্তর্ভুক্তিহীন নির্বাচন কি ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করবে

অন্তর্ভুক্তি সম্ভাব্য চরমপন্থা প্রতিরোধ করে, সমাজে সেতুবন্ধ তৈরি করে এবং নির্বাচন–পরবর্তী প্রতিশোধের ভয় কমিয়ে গণতান্ত্রিক আস্থা বাড়াবে। অন্তর্ভুক্তিহীন নির্বাচন ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করবে কি না, তা নিয়ে লিখেছেন মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার

সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারণা অনুসারে, দীর্ঘ মেয়াদে আধিপত্যশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষের চিন্তাচেতনা ও আচরণকে ধীরে ধীরে বদলে দেয়। গত ১৭ বছরে বাংলাদেশে ‘তুমি আমার পক্ষে, না হলে বিপক্ষে’—এই বিভক্তির রাজনীতি জেনারেশন জেড-কে এমন এক মানসিকতায় অভ্যস্ত করেছে, যেখানে ভিন্নমত শুনলেই তারা দ্রুত উপসংহারে পৌঁছে যেতে বা শেষ কথা বলে দিতে চায়; ভিন্নমত, বিতর্ক বা প্রশ্নের জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউটিউবভিত্তিক ‘ইনফ্লুয়েন্সার রাজনীতি’; চটকদার শিরোনাম, অযাচিত আবেগ, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব, যা মানুষকে আরও ‘দুই ভাগে বিভক্ত’ চিন্তার মধ্যে আটকে দিচ্ছে। ফলে বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা সালাহউদ্দিন আহমদের মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের খণ্ডিত বক্তব্য বা মন্তব্য প্রচার করে তাঁদের ‘ভারতপন্থী’ হিসেবে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে, যা আগের স্বৈরাচারী আমলের মানসিকতার পুনরাবৃত্তির মতো।

এই ট্যাগিং সংস্কৃতির ফলে গবেষক, নীতিনির্ধারক ও লেখকেরা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশে অনীহা বোধ করেন। কারণ, যেকোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ করলেই তাঁরা ট্যাগিংয়ের শিকার হওয়ার শঙ্কায় থাকেন। অথচ বিশ্লেষক–গবেষকদের কাজই হলো জটিল বাস্তবতাকে প্রশ্ন করা এবং ব্যাখ্যা করা। ট্যাগিং ও দ্রুত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়ার সংস্কৃতি সেই বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তাশীল পরিসরকে সংকুচিত করছে।

আত্মসমালোচনা: ব্যক্তি, দল ও রাষ্ট্র

ইসলামের অন্যতম দালিলিক ভিত্তি হলো হাদিস। একটি সহিহ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে বুদ্ধিমান, যে নিজের আত্মসমালোচনা করে এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস ৪২৬০)।

এই নীতি ব্যক্তিগত উন্নতির মতোই রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারণা অনুসারে, যে জনগোষ্ঠী আত্মসমালোচনায় সক্ষম, তারাই টেকসই রাষ্ট্র গড়তে পারে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা কি বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থরক্ষার মূল চাবিকাঠি? রোহিঙ্গা সংকট, ভারত–চীন প্রতিযোগিতা, ইন্দো–প্যাসিফিক উত্তেজনা—এসব জটিল বাস্তবতায় আমাদের অবস্থান কী হবে, সেটিও এখন মৌলিক প্রশ্ন।

অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হলে সেটা ‘কার পক্ষে’ কিংবা ‘কার বিপক্ষে’ যাবে—এভাবে চিন্তাভাবনার সময় শেষ। পাশাপাশি আমাদের নীতি হওয়া উচিত, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কিন্তু সবার আগে বাংলাদেশ’, এ রকম বাস্তববাদী রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মসমালোচনা কোনো দুর্বলতা নয়; বরং সঠিক নীতিনির্ধারণের প্রথম ধাপ।

ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তি : জাতীয় চার্টারের প্রয়োজন

আত্মসমালোচনা আমাদের আরও গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়: কীভাবে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে? বর্তমান বাংলাদেশের মতো বিভক্ত সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং সব নাগরিককে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা—এই দুই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন একটি সর্বজনীন ‘ন্যাশনাল জাস্টিস অ্যান্ড ট্রানজিশন চার্টার’।

দক্ষিণ আফ্রিকার ‘কনভেনশন ফর আ ডেমোক্রেটিক সাউথ আফ্রিকা নেগোসিয়েশনস’, চিলির ‘ন্যাশনাল অ্যাকর্ড’ ও নেপালের ‘কম্প্রিহেনসিভ পিস অ্যাগ্রিমেন্ট’ দেখিয়েছে, দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসন বা সমাজে গভীর মেরুকরণের পর একটি দেশে স্থিতিশীলতার ভিত্তি তৈরি করতে হয়। এটা তখনই তৈরি হয়, যখন রাজনৈতিক দল, সংখ্যালঘু, নারী–যুব প্রতিনিধি ও পেশাজীবীরা একটি অভিন্ন সনদে সম্মত হয়ে রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ থেকে আলাদা করতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের একটি চার্টার শুধুই কাম্য নয়; বরং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের জন্য অপরিহার্য।

 এ–জাতীয় সনদের কেন্দ্রবিন্দু হবে একটি স্পষ্ট অঙ্গীকার—শেখ হাসিনা সরকারের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, হত্যা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা। এই জবাবদিহি শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বে সীমিত থাকবে না; বরং পুলিশ, র‍্যাব, প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার অপরাধে জড়িত সদস্যদের ওপরও সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।

এই সনদে স্বাক্ষর করে প্রতিটি গোষ্ঠী জাতির সামনে ঘোষণা করবে যে বিচারপ্রক্রিয়া কোনোভাবেই রাজনৈতিক দর–কষাকষি বা প্রভাব খাটানোর বিষয় হবে না। এটি হবে একধরনের ‘সামাজিক চুক্তি’ (সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট), যার উদ্দেশ্য হলো, রাষ্ট্রের ন্যায়বিচারকে দীর্ঘ মেয়াদে অব্যাহত রাখা এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও যেন অপরাধীরা পার পেয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করা।

আরও পড়ুন

অপরাধী ও মূল্যবোধভিত্তিক সমর্থকদের মধ্যে পার্থক্য

ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তির কাঠামো বাস্তবায়নে বর্তমান বাংলাদশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি সংবেদনশীল প্রশ্ন সামনে আসে—অপরাধে জড়িত নন, এমন আওয়ামী সমর্থকদের কীভাবে দেখা হবে?

বাংলাদেশে এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা কোনো বিগত আমলে গুম, খুন, দুর্নীতি বা দখলের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। তাঁরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক মূল্যবোধের কারণে। তাঁদের অপরাধী গোষ্ঠীর সঙ্গে এক করে দেখা ন্যায়সংগত নয় এবং এটি গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক পরিসরে এ ধরনের কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। স্পেনের স্বৈরশাসক ফ্রাঙ্কো–পরবর্তী রূপান্তর এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন মডেল দেখায় যে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা হলেও মূল্যবোধভিত্তিক সাধারণ সমর্থকদের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে এটিকে বলা হয় ‘ভ্যালুজ-বেজড সাপোর্টার্স ইনক্লুশন’ (মূল্যবোধভিত্তিক সমর্থকদের অন্তর্ভুক্তি), যেখানে অপরাধী ও মতাদর্শগত সমর্থককে আলাদা করে দেখা হয়।

বাংলাদেশেও একই নীতি প্রযোজ্য হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগের সেসব সমর্থক, যাঁরা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করবেন যে তাঁরা শেখ হাসিনা বা বিগত সরকারের অপরাধের বিচারে কোনো আপস চান না; বরং আইনের শাসন ও গণতন্ত্রকেই সমর্থন করেন, তাঁদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতরে রাখা রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের পক্ষে ইতিবাচক হবে।

এই অন্তর্ভুক্তি সম্ভাব্য চরমপন্থা প্রতিরোধ করে, সমাজে সেতুবন্ধ তৈরি করে এবং নির্বাচন–পরবর্তী প্রতিশোধের ভয় কমিয়ে গণতান্ত্রিক আস্থা বাড়াবে, যা একই রকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়া বহু দেশের স্থিতিশীলতার ভিত্তি হয়েছে।

আরও পড়ুন

ট্যাগিং দেওয়ার আগে কিছু প্রশ্ন

এই লেখায় যে যুক্তিগুলো দেওয়া হলো তাতে অনেকে হয়তো আমাকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ বা ‘ভারতের দালাল’ বলে ট্যাগ দিতে চাইবেন; এটাই এখন আমাদের সমাজের পরিচিত রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ট্যাগ দেওয়ার আগে একটি মৌলিক প্রশ্ন করা উচিত: বর্তমানে নির্বাচনী প্রচারণায় নানা প্রতিশ্রুতি, সুবিধা কিংবা প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল খোলামেলাভাবে আওয়ামী লীগের ভোটারদের ভোট চাইছে। এভাবে ভোট চাওয়া নিয়ে কি কেউ আপত্তি তুলেছেন?

রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই যখন আওয়ামী লীগের সমর্থকদের একটি ‘বৈধ ভোটব্যাংক’ হিসেবে ধরে নিয়েছে, তখন অপরাধে জড়িত নন, এমন কর্মী–সমর্থকদের শর্ত সাপেক্ষে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হবে কেন? রাজনৈতিক দলগুলো যেটি বাস্তবে করছে, সেটি রাষ্ট্রনীতির ভাষায় তুলে ধরলেই কেন ট্যাগিংয়ের শিকার হতে হবে?

সমাজ ও রাজনীতিকে ‘একরূপ’ করার বিপদ

ইতিহাসবিদ এবং দার্শনিক তত্ত্ববিদ হান্না আরেন্ট তাঁর অরিজিন্স অব টোটালিটারিয়ানিজম বইতে দেখিয়েছেন, যখন কোনো রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক শক্তি নাগরিকদের একটিমাত্র পরিচয়ের মধ্যে ঠেলে দিতে চায়, তখন সমাজে নৈতিক বহুত্ব ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে জুয়ান লিঞ্জ তাঁর টোটালিটারিয়ান অ্যান্ড অথরিটারিং রেজিমস বইয়ে লিখেছেন, জোরপূর্বক রাজনৈতিক ঐক্য সামাজিক পতনের দিকে প্রথম পদক্ষেপ।

ইতিহাস থেকে দেখা গেছে, হিটলার, মুসোলিনি, আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তা কিংবা কম্বোডিয়ার খেমার রুজ—তাঁরা সবাই ‘যারা আমাদের সঙ্গে নয়, তারা জাতির শত্রু’, এ ধরনের ভাষায় সমাজকে বিভক্ত করে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেই দুর্বল করেছেন। বাংলাদেশেও এর প্রতিধ্বনি দেখা যাচ্ছে।

কিছু দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকদের বলছে, ‘পুরোনো পরিচয় ভুলে আমাদের সঙ্গে মিশে যান।’ অতীতে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাও একই ধরনের বর্জনমূলক ভাষা ব্যবহার করেছেন। আর আজ সেটিই শুধু ব্যক্তি পরিবর্তিন হয়ে ফিরে আসছে; কিন্তু মনস্তত্ত্ব অপরিবর্তিত—বিরোধী পরিচয় মুছে ফেলা।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টিভেন লেভিটস্কি ও ড্যানিয়েল জিবলাট তাঁদের হাউ ডেমোক্রেসি ডাই বইতে দেখিয়েছেন, যখন রাজনৈতিক দলগুলো অন্য দলের ভোটারদের ‘আত্তীকৃত’ বা ‘নিশ্চিহ্ন’ করতে চায়, তখন গণতন্ত্র দুর্বল হয়। কারণ, এতে নাগরিকের স্বাধীন রাজনৈতিক পরিচয়ের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আরও পড়ুন

বাদ দিলে নিরাপত্তা দুর্বল হয়

কোনো জনগোষ্ঠীর একাংশকে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে ঠেলে দিলে জাতীয় নিরাপত্তা দুর্বল হয়—এটি কোনো তত্ত্ব নয়, বাস্তবতা। ভারতের কাশ্মীরের অস্থিরতা এ রকম রাজনৈতিক বর্জনের ফল। শক্তিশালী অর্থনীতি থাকা সত্ত্বেও এসব অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ তাদের নিরাপত্তা ও কূটনীতিকে চাপের মুখে ফেলেছে। পাকিস্তান তো ভেঙে পড়েছে প্রতিনিয়ত বিরোধী পক্ষকে ‘জাতির শত্রু’ বানানোর রাজনীতির কারণেই।

 প্রশ্ন হলো, ১৮ কোটি মানুষের একটি ছোট দেশে অপরাধে জড়িত নন, এমন আওয়ামী লীগ–সমর্থকদের পুরোপুরি রাজনৈতিকভাবে বাদ দেওয়া হয়, তাহলে সেই শূন্যতা ব্যবহার করবে কারা? বাহ্যিক শক্তি, আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও বৈশ্বিক খেলোয়াড়েরা? মনে রাখতে হবে, শূন্যতা মানেই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাঝুঁকি।

ভূরাজনীতি : ব্যবহার ও পরিত্যাগের খেলা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একধরনের অদ্ভুত উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক কিছু দল যেন মনে করছে, তারা কোনো অদৃশ্য আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়েছে এবং সেই শক্তির ভরসায় তারা আওয়ামী লীগকে ‘চিরতরে মুছে ফেলার’ ভাষা ব্যবহার করছে; কিন্তু ভূরাজনীতি কি এতটা সরল?

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো ‘পরাশক্তি’ খুব কম ক্ষেত্রেই কোনো দলকে স্থায়ীভাবে বাদ দেয়; বরং তারা বিভিন্ন দলকে বিবেচনায় ধরে রাখে। পশ্চিমা বিশ্ব কখনোই দক্ষিণ এশিয়ার একটি পুরোনো, বৃহৎ ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তিকে পুরোপুরি বাতিল করে দেবে না। কারণ, ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে এ রকম সেক্যুলার রাজনৈতিক দল সব সময়ই তাদের কাছে একটি ‘পোটেনশিয়াল ব্যালেন্সিং ফোর্স’।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় পশ্চিমা বিশ্ব, মূলত যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলায় আফগানিস্তানের মুজাহিদিনদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিল। অনেক ধর্মীয় সংগঠনের নেতারা পাকিস্তানের মাটিতে দাঁড়িয়ে তখন ‘ফ্রিডম ফাইটার’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রই তাঁদের সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

রাজনৈতিক দার্শনিক স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন বইতে দেখিয়েছেন, যে শক্তিকে কোনো এক সময় ‘স্বাধীনতার রক্ষাকবচ’ বলা হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তাকে ‘সভ্যতার শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে; অর্থাৎ পরাশক্তিগুলোর কৌশল প্রায়ই ‘ব্যবহার এবং বাতিল’ নীতিতে চলে।

আজ রাশিয়া বা চীন আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রভাবশালী। বৈশ্বিক শক্তির মেরুকরণ আবার স্পষ্ট হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা বিশ্ব দক্ষিণ এশিয়া ও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে নিজেদের প্রভাব ফিরিয়ে আনতে চাইছে। ফলে কিছু ধর্মভিত্তিক দল হয়তো সাময়িক সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু মনে রাখা জরুরি, পশ্চিমাদের কাছে কোনো দল নয়; বরং স্বার্থই মূল বিষয়। যখনই ‘ব্যালান্স’ করার প্রয়োজন পড়বে, তখনই সেক্যুলার কোনো দলকে সামনে নিয়ে আসা হতে পারে।

পাকিস্তানের ইতিহাস এ ক্ষেত্রে নিখুঁত উদাহরণ; কখনো ইসলামপন্থীদের ব্যবহার, কখনো আবার তাদের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা। সুদানও আজ একই চক্রে পড়েছে; পশ্চিমাদের সরাসরি হস্তক্ষেপ নেই, কিন্তু তাদের মিত্ররাষ্ট্রগুলোকে দিয়ে দেশটিকে অস্থিতিশীল রাখা হচ্ছে। 

বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক দলগুলো যদি এই ভূরাজনৈতিক সমীকরণ না বোঝে এবং আজকের সমর্থনকে চিরস্থায়ী বলে মনে করে, তবে ভবিষ্যতে তারা যে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে, এর দায় অন্যের ওপর চাপানোর সুযোগ থাকবে না। তাই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া খুব জরুরি।

পরিশেষে গণতন্ত্র টিকে থাকে তখনই, যখন রাষ্ট্র শত্রু খোঁজা বন্ধ করে নাগরিকদের আস্থার জায়গা তৈরি করে। আজকের বাংলাদেশেও প্রয়োজন সেই একই বোধ ও বিবেচনা, প্রয়োজন আইনের শাসন, জবাবদিহি ও অন্তর্ভুক্তি।

  • মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

    *মতামত লেখকের নিজস্ব