এক মেধাবী অনামিকের গল্প

ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্ররা আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের সময়ে বোর্ডের পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান করাটা বিশেষ মর্যাদার বিষয় ছিল। যারা মেধাতালিকায় স্থান পেত, তাদের প্রতি আমার উৎসাহের কমতি ছিল না। তারা দেখতে কেমন, কী রকম পোশাক পরে, কীভাবে কথা বলে, কী খায়, কী বিষয়ে আগ্রহ—এ বিষয়ে আমার বিশেষ কৌতূহল ছিল। এখন যেমন আমাদের ছোট-বড় সবার ক্রিকেটারদের প্রতি আগ্রহ, আমারও সে রকম আগ্রহ ছিল মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে।

আমি খুবই ভাগ্যবান। বুয়েটের সিএসই বিভাগের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে দেশের সবচেয়ে ভালো ছাত্রদের দেখার জন্য আমাকে অনেক দূর যেতে হয়নি। আমার বিভাগে করিডরে যারা হাঁটে; আমার সামনে কিংবা পেছনে, কাছে কিংবা দূরে—সবাই মেধাস্থানপ্রাপ্ত মেধাবী ছাত্র। তাদের কেউ কেউ জীবনে কোনো পাবলিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়নি।

এমন একজন হলো চট্টগ্রামের মোহাম্মদ মঞ্জুর মুর্শেদ। শুধু আমি না; এমনকি মেধাবী ছাত্ররাও তার সম্পর্কে খুবই উৎসাহী ছিল। সারা পৃথিবীতে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে বিস্ময়কর প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যায়। কার্লসেন, গ্যারি কাসপারভ কিংবা কাপাব্লাংকা দাবায়, টেরেন্স টাও কিংবা গাউস গণিতে, সংগীতে মোৎসার্ট অসামান্য প্রতিভাধর মানুষ।

কিছু দেশে প্রতিভাবান শিশুদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ রয়েছে এবং তাদের এই মেধা এগিয়ে নেওয়ার জন্য কর্মসূচি কিংবা স্কুলও রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে এ রকম কর্মসূচি নেই। প্রয়োজনীয় সুযোগের অভাবে এই মেধাবী শিশুদের প্রতিভার যথাযথ বিকাশ হয় না এবং তারা হারিয়ে যায়।

আমাদের দেশে অবশ্য আমরা কোভিডের টিকা আবিষ্কার, চিরন্তন গতির যন্ত্র, অথবা জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করে রাতারাতি দেশকে সম্পদশালী করার আশা দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অকার্যকারিতা ও অসারতা প্রমাণ করে জাতিকেই বিজ্ঞানবিমুখ করছি।

দরিদ্র মানুষ যেমন লটারির টিকিট কিনে ধনী হওয়ার চেষ্টা করে, আমাদের মধ্যেও কোনো অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি আগ্রহ রয়েছে, যার ফলে এভারেস্ট বিজয়ী কিংবা খুদে কম্পিউটার বিস্ময়ের জন্ম হয়েছে, তাদের নিয়ে আমরা অনেক প্রচার করেছি; এমনকি শিশু-কিশোরদের পাঠ্যপুস্তকে তাদের বিস্ময়কর প্রতিভাকে উপস্থাপন করেছি। কৈশোর পেরোনোর আগেই ছেলেমেয়েরা জানতে পেরেছে আমরা যা তাদের বলেছি, সে কথা সত্য নয়। এর ফলে সমাজের প্রতি আমরা তাদের আস্থা তৈরি করতে পারিনি।

এমনকি ছোট-বড় প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও এ রকম অসাধারণ প্রতিভাধরদের খুঁজে বেড়ানো এবং তাদের মিডিয়ার সামনে অতি উৎসাহের সঙ্গে উপস্থাপন করার প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু পরিশেষে বিশ্বসভায় আমাদের অর্জন যে ক্রমে ক্ষীণতর হচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এরপরও আমি আট বছরের এক শিশুর কথা বলব। তার উচ্চশিক্ষিত এবং অনুকরণীয় মূল্যবোধসম্পন্ন মা-বাবা তার সম্পর্কে লিখতে আমাকে বারণ করেছেন। তাও আমি তার সম্পর্কে লিখব; অবশ্য তার পরিচয় না দিয়ে। অর্থাৎ আমার লেখা থেকে তার মা-বাবার কিংবা তার নিজের কোনো ক্রেডিট পাওয়ার সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা তা চানও না।

মা চান তার ছেলেটি অতীব সাধারণ মানুষের মতো বড় হোক, সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ বুঝুক; তাহলেই তিনি সন্তুষ্ট। বাবা তার জন্য অনেক ছবির বই কিনে এনে তার শোবারঘরে রাখেন কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই। ছেলেটি খুশিমতো পড়ে। তার ওপর কোনো রকম চাপ নেই। তার আগ্রহের বিকাশ ঘটানোর জন্য তাঁরা তার পছন্দের বই কিনে আনেন। আমার সময় স্বল্পতা ছিল। আবার খুবই মেধাবী বেশ কয়েকজন মানুষ ছেলেটি সম্পর্কে আমাকে বলেছে, তাই লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।

হাতে শুধু রাতের দ্বিতীয়ার্ধ এবং সকালবেলা। রাতের দ্বিতীয়ার্ধে সে ঘুম, সকালে আবার বিশেষ মেধাবী শিশুদের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে। খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। আমি হাল ছাড়লাম না। অনেক সকালে জেগে উঠেছি, তার শব্দ পেলেই কাছে যাব। তা-ই হলো। তাকে অনেক ছোটবেলায় দেখেছি। তার বাচনভঙ্গি পরিপক্ব মানুষের মতো, ধীরস্থির শব্দচয়ন যথেষ্ট উচ্চশিক্ষিত মানুষের মতো। বক্তব্য ও স্বর তার বয়সের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ভাবছি, দেশে তরুণ, কিশোর কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব কিংবা বিশ্লেষণক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য যেসব ধাঁধা আমি ধরে থাকি এবং যা অনেকটা যুগ যুগ ধরেই আমি সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করছি, সেগুলো দিয়ে শুরু করব। এমন সময় তার বাবা আমাকে বললেন, ইদানীং তার ট্রায়াঙ্গুলার সংখ্যাকে পূর্ণসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে তার অবশিষ্টের গুণাবলির প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বাবার কথা শুনে সে মুহূর্তের মধ্যে তার ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা শুরু করল এবং বিভিন্ন সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে তার যে অবশিষ্ট হয়, তার চক্রের দৈর্ঘ্য প্রমাণ শুরু করল। ভাজক জোড় হলে কী আর বিজোড় হলে কী এবং প্রমাণের অকাট্যতাও তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে এই ভাগশেষগুলো অবলীলাক্রমে লিখে গেল নির্ভুলভাবে। কোথাও আমার মনে হলো ভুল। পরে দেখলাম, আমিই ভুল। সে সব শুদ্ধ লিখে যাচ্ছে।

আমি তাকে বললাম, সে 3n+1 সমস্যাটি জানে কি না। আরও জানালাম অতি সম্প্রতি সর্বকনিষ্ঠ ফিল্ডস মেডেল বিজয়ী টেরেন্সটাও প্রোবাবিলিটিস্টিক্যালি দেখিয়েছেন যে প্রতিসংখ্যার সংখ্যাচক্রই প্রায় সীমিত সংখ্যায় পৌঁছে। ঘটনাটি জেনে সে বলল, তারপরও এমন পূর্ণসংখ্যা থাকতে পারে, যার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটবে এবং সংখ্যাটি এত বড় হতে পারে যে আমরা কম্পিউটার ব্যবহার করেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব না। এরপর সমস্যা ১৯৬ নিয়ে কথা বললাম। এই সমস্যা বলে হয় একটি সংখ্যা প্যালিনড্রম (সোজা এবং উল্টাভাবে লিখলে একই সংখ্যা হবে) না হয় তার বিপরীতক্রমে লেখা সংখ্যার সঙ্গে যোগ করতে থাকলে অবশেষে প্যালিন্ড্রম পাওয়া যাবে। সেখানেও সে অর্থবোধক যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিল। এবার ধরার ধুলায় নেমে আমি তাকে বিভিন্ন ধাঁধা ধরলাম। যেমন যে বলে, ‘আমি মিথ্যাবাদী’ সে আসলে কী। কিংবা একটি রাস্তা দুই ভাগে ভাগ হয়ে একটি ডাকঘরের দিকে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গেছে। ভাগের ওখানে একজন দারোয়ান, যে জানে রাস্তা দুটির গন্তব্য। সে সত্য বলে না মিথ্যা বলে, জানা নেই।

তাকে মাত্র একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতে হবে। এ ধরনের সমস্যা বছরের পর বছর আমাদের ছাত্ররা সমাধান করতে পারছে না। অথচ এই আট বছর বয়সী মুহূর্তের মধ্যেই উত্তর বলে দিচ্ছে। ১৩ কেজি পর্যন্ত যেকোনো পূর্ণ কেজি ওজন সর্বনিম্ন কতগুলো বাটখারা দিয়ে একবারে মেপে দেওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে তার প্রশ্ন বাটখারা পাল্লার উভয় দিকে ব্যবহার করা যাবে কি না। আমার প্রশ্নের অসম্পূর্ণতা সে মুহূর্তের মধ্যেই ধরিয়ে দিল। যখন তাকে বললাম স্কুলে গেলে ছয় কিলোমিটার দ্রুতিতে আর ফিরে এলে চার কিলোমিটার দ্রুতিতে, গড় দ্রুতি কত? মুহূর্তের মধ্যে বলল, সংখ্যাটি ৫ নয়; যদিও আমাদের ছাত্ররাও মুহূর্তের মধ্যেই বলতে পারে তবে উত্তরটি ঠিক তার বিপরীত। আমি লক্ষ করলাম, প্রতিটি প্রশ্নের পর সে সামান্য একটু ভাবে। এটা আমি বিজ্ঞানী পল আরডসের মধ্যেও দেখেছি।

ইতিমধ্যে একাধিক ভাষায় সে প্রোগ্রাম লিখতে পারে যদিও তার আকর্ষণ বিশ্লেষণী ক্ষমতায়। সে ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে প্রোগ্রাম লিখতেও শিখেছে। একবার যখন তার দাঁত পড়ল, সে ভাবল, একটি ফাংশন দিয়ে সে দাঁত একে ফেলবে। কত ফাংশন আছে তার থেকে সে সঠিক ফাংশন কিছুটা ট্রায়াল এররের মধ্য দিয়ে বের করল এবং ফাংশনের বিভিন্ন অংশও সঠিকভাবে স্কেল করে ঠিক দাঁত বানিয়ে ফেলল। লক্ষণীয় হলো, ইকুয়েশনটি যে পুরোপুরি সিমেট্রিক না, তা-ও কিন্তু সে বুঝেশুনে করেছে। তার অনুমানের প্রখরতায় আমি রীতিমতো মুগ্ধ হলাম।

একবার কয়েকজন সাথী এসেছে রুবিকস কিউবের প্রতিযোগিতা করবে। সে তখন বলল, একটু অপেক্ষা করো, এমনভাবে প্রতিযোগিতার আয়োজন করব, যাতে সবাই সমান সুযোগ পায়, কে কে পরবর্তী রাউন্ডে উঠবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সব ধরনের পারমুটেশন কম্বিনেশন বিশ্লেষণ করে তবেই ম্যাচগুলো ঠিক করা হলো। ৬ বছরের একটি ছেলের জন্য এত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা অবশ্যই তার অস্বাভাবিক মেধার পরিচয় বহন করে। ওই বয়সে সে ৪ বাই ৪ বাই ৪ রুবিকস কিউব মেলাতে স্বচ্ছন্দ।

আমার মনে হয়, তার বাবা-মা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তার স্বাভাবিক বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে, সমাজে তাকে অতি মেধাবী প্রমাণ করার জন্য কৃত্রিমতার আশ্রয় নেয়নি। আমার এই লেখার বিষয়ে তাদের যথেষ্ট অনাগ্রহ, বিরোধিতা রয়েছে। একটি ছবি দিলে খুব ভালো হয়, কিন্তু তারা এ বিষয়ে একেবারেই নারাজ। তারা শিশুটির ওপর কোনো রকম বাড়তি চাপ দিতে রাজি না। শিশুটি যেন মূল্যবোধ ও আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বড় হতে পারে সেখানেও তারা অত্যন্ত চৌকসভাবে কোনো রকম জোরাজুরি না করে শিশুটিকে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেয়। যেমন সে ৫ মিনিট কিংবা ১০ মিনিটের মধ্যেই স্কুলের জন্য রওনা হতে পারে। যদিও না যাওয়ার অপশন রইল না, তা-ও তো তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রইল। এ কাজগুলো নিঃসন্দেহে শিশুর আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে।

পরিশেষে দাঁত আঁকার জন্য তার ইকুয়েশন এবং তার গ্রাফ দিয়েই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। এই মা-বাবার থেকে আমাদের শেখার আছে। নিজের সন্তানটির যদি বিশেষ মেধা থাকে তা নিয়ে রাজ্য তোলপাড় করার দরকার নেই। তাতে শিশুর অমঙ্গল বই মঙ্গল হবে না। আপনার শিশু থেকে সমাজের যদি কোনো লাভ হয়, অন্য লোকেরাই আগ্রহ নিয়ে আপনার শিশুর কাছ যাবে, তাকে নিয়ে জাতীয় দৈনিক কিংবা টেলিভিশন চ্যানেল যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। ফার্মার শেষ উপপাদ্য প্রমাণকারী এন্ড্রু উয়াইলস কিন্তু মিডিয়ার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছিলেন, নীরবে নিভৃতে কাজ করার জন্য এমনকি বিয়ে থেকে বিরত থাকতে চেয়েছিলেন। প্রকৃত কাজের মানুষ কখনো নিজে মিডিয়ার কাছে যাবে না। যারা কাজের পরিবর্তে মিডিয়ার কাছে ঘুরঘুর করে, তাদের রীতিমতো সন্দেহ করা যায়।

প্রতিটি শিশু-কিশোরের স্বভাবজাত দক্ষতা কোনো না কোনো বিষয়ে রয়েছে। আমরা মা-বাবারা তার সেই প্রতিভার বিকাশে যদি প্রভাবক হিসেবে কাজ করি, তাহলেই একটি শ্রেয়তর ভবিষ্যৎ বংশধর তৈরি করতে পারব। ছেলেটির নাম যেহেতু বলতে পারলাম নাম, তার নাম হোক অনামিক। অনামিক প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে উঠুক, জীবনের রস-গন্ধ-শব্দ-আনন্দ—সব উপভোগ করেই তার শ্রেয়তর গণিতের মেধাকে বিকশিত করুক, এই কামনা রইল।

  • মোহাম্মদ কায়কোবাদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক