১৮ লাখ কোটির দেনা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানো যাবে কি

২০০৮-০৯ অর্থবছরে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট বরাদ্দ ধরা হযেছিল মাত্র ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা।

ওয়ান-ইলেভেনখ‍্যাত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষিত এই পাঁচ অঙ্কের বাজেটকে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ধাপে ধাপে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করে।

সে হিসাবে স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের প্রথম বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ বাজেট ১ হাজার ১৪ গুণ বেশি। তবে এই বিশাল অঙ্কের বাজেটের সঙ্গে দুর্নীতির বিস্তৃতিও যে বিশাল গতিতে বেড়েছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এটি ঠিক, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিটি অর্থবছরে দেশে দৃশ‍্যমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব‍্যাহত ছিল বটে, কিন্তু লাগামহীন লুটপাটের অদৃশ্য কালো হাত ধীরে ধীরে পুরো উন্নয়নের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। যার শেষ পরিণতি ঘটে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার মাধ্যমে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও ন‍্যায‍্যতার দাবিতে ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান একদিকে যেমন ক্ষমতাপ্রত‍্যাশী দলগুলোর প্রতি কঠোর বার্তা দিয়েছে, অন‍্যদিকে বিগত সরকারের বিশাল ঋণের বোঝা সামলে নিতেও বর্তমান সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তবু সার্বিক বিপত্তি ঠেলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমূল সংস্কার এনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখন অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

যদিও বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা বা গড়ে তোলা একটি শক্তপোক্ত পদ্ধতিকে রাতারাতি পরিবর্তন করে তার সুফল পাওয়া খুব সহজ কাজ হবে না। শুধু নির্দিষ্টসংখ্যক মানুষকে বা পদ-পদবির পরিবর্তন করেও সহজে এ পরিবর্তন আনা যাবে না।

যেকোনো পরিস্থিতিতে একটি সামগ্রিক পরিবর্তন আনতে হলে সমস্যার শিকড়ে পৌঁছে বিদ‍্যমান পদ্ধতির ত্রুটিগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। এরপর ত্রুটিগুলোকে দূরীকরণে কাঠামোগত পরিবর্তন করাটা আগে প্রয়োজন। নতুবা ছাত্র-জনতার এ অর্জন একসময় গতি হারাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আরেকটু খোলাসা করে বললে, একটি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সময়টিকে সতর্কতার সঙ্গে যথাযথভাবে কাজে লাগানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এই সময়ে ভুল করলে সেটি সংশোধনের জন্য আবারও নতুন কোনো আন্দোলনের প্রয়োজন হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ এই গণজাগরণের সময়টিকে কাজে লাগিয়ে সুযোগসন্ধানী গ্রুপগুলোর দরজা বন্ধ করে দিতে হবে, যেন কোনো খারাপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

বিশেষ করে ছাত্র-জনতা যে উদ্দেশ্য সাধনে রক্ত ঝরিয়েছেন এবং জীবন উৎসর্গ করেছেন, তা যেন কোনো প্রকারে নস্যাৎ না হয়।

বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, দেশটি কখনোই দুর্নীতিমুক্ত ছিল না। হয়তো কখনো সেটি কমেছে আবার কখনো সেটি আকাশ ছুঁয়েছে। আবার কখনো দুর্নীতি ও উন্নয়ন একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। অর্থাৎ সমাজ থেকে ঘুষখোর ও চাটার গোষ্ঠী কখনো বিদায় নেয়নি।

বরং মাঝেমধ্যে তারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেয়ে ক্ষমতার মসনদে বসে দুর্নীতি ও লুটপাটকে একটি ভিন্ন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সে জন্যই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি বরগুনার এক জনসভায় আফসোস করে বলেছিলেন, ‘আমি যা ভিক্ষা করে আনি, সব চাটার গুষ্টি চেটে খেয়ে ফেলে, আমার গরিব পায় না।’

বিভিন্ন তথ‍্য–উপাত্ত ঘেঁটে দেখা যায় যে বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনার বিষয়টি খুবই জটিল ও দুরূহ কাজের মধ্যে একটি। যদিও বিগত সরকার অর্থ পাচারকারীদের টাকা ফেরত আনার জন্য কালোটাকা সাদা করার অনেক সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছিল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

এত বড় গণ-অভ্যুত্থানের পর যে সবাই ভয় পেয়ে সাধু-সন্ন‍্যাসী হয়ে যাবে, এমনটি ভাবারও কোনো কারণ নেই।

বিগত কয়েক দিনের পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনগুলো পড়লে বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী হায়দার হোসেনের গানের কথা থেকে ‘কী দেখার কথা, কী দেখছি,/ কী শোনার কথা, কী শুনছি’—এই লাইনগুলো কানে বাজছে।

বিগত সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর বাসার পিয়নের ৪০০ কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার ঘটনা পুরো জাতির বিবেককে নাড়া দেয়। প্রশ্ন ওঠে, বাসার পিয়ন যদি এই বিপুল অর্থের মালিক হন, তাহলে বড় বড় কর্তাব‍্যক্তি কী করেছেন?

তাঁরাও একেকজন বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে গেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং ভবিষ্যতে এমন অবারিত সুযোগ-সুবিধাগুলোকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে হবে। তাহলে জনসাধারণের মধ্যে স্বস্তি আসবে।

বিগত সরকারের আমলে ব‍্যাংকিং খাতের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও অর্থের নয়ছয়ের খতিয়ানের পরিসরকে একটি কাঠামোগত রূপ দেওয়া হয়েছে বললে ভুল হবে না।
ফলে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। সে হিসাবে জাতীয় বাজেটের তুলনায় ২০০৮ থেকে ২০২৪ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ২২ দশমিক ৪৯ শতাংশ থেকে ২২ দশমিক ৮৪ শতাংশ হয়েছে।

আরও পড়ুন

সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ও শঙ্কার বিষয় হলো গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে অন্তত ১১ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ পাচার করা অর্থের পরিমাণ সর্বশেষ জাতীয় বাজেটের প্রায় ১ দশমিক ৩৮ গুণ, যা আমাদের জাতীয় মাথাব‍্যথার কারণে পরিণত হয়েছে।

দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ১০০০–১৫০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) ২০২০ সালে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়।

ইতিমধ্যে বর্তমান সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে অর্থ পাচার রোধে এবং পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব‍্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এই বিপুল অর্থ আদৌ ফেরত আনা সম্ভবপর হবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।

বিভিন্ন তথ‍্য–উপাত্ত ঘেঁটে দেখা যায় যে বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনার বিষয়টি খুবই জটিল ও দুরূহ কাজের মধ্যে একটি। যদিও বিগত সরকার অর্থ পাচারকারীদের টাকা ফেরত আনার জন্য কালোটাকা সাদা করার অনেক সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছিল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

বরং নানা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশের বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ডসহ অন্তত ১০টি দেশে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুয়ায়ী, ২০০৯ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। সে হিসাবে, আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ।

মোদ্দাকথা, দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ রেখে ক্ষমতা ছেড়েছে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে অংশগ্রহণমূলক আর্থিক নীতির বাস্তবায়ন, সঠিক রাজস্ব নীতি গ্রহণ, মুদ্রাস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে হ্রাসকরণ, পর্যাপ্ত রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধিকরণ, বাজার সিন্ডিকেট দূরীকরণসহ সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে ক্রমাগত উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে আশা করা যায়। ততক্ষণ পর্যন্ত সবাইকে যথাসম্ভব ধৈর্যের পরিচয় দেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

  • এম এম মাহবুব হাসান ব‍্যাংকার ও উন্নয়ন–গবেষক
    ই-মেইল: [email protected]