মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে কেন আমি পদত্যাগ করেছি

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অফিস অব নিয়ার ইস্টার্ন অ্যাফেয়ার্সের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক সাবেক কর্মকর্তা অ্যানেল শেলিনভিডিও থেকে সংগৃহীত

গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমা ব্যবহার করে আসছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এই বোমা হামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার শিশুসহ ৩২ হাজার মানুষ মারা গেছেন।

অগণিত মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন। খাদ্য অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার অভিযোগ করেছেন যে ইসরায়েল গাজার ২০ লাখ মানুষকে অনাহারে থাকতে বাধ্য করছে।

দাতাগোষ্ঠীর নেতারা সতর্ক করেছেন এই বলে যে যথেষ্ট খাদ্যসহায়তার ব্যবস্থা না করা গেলে এসব মানুষও মারা পড়বেন।

তারপরও ইসরায়েল রাফায় অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করছে। গাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে এই রাফাতেই আশ্রয় নিয়েছেন। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা রাফায় অভিযানের ফলাফল অকল্পনীয় হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন।

পশ্চিম তীরে সশস্ত্র বসতি স্থাপনকারী ও ইসরায়েলি সৈন্যরা মার্কিন নাগরিকসহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। গণহত্যাবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের এসব ক্রিয়াকলাপ গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হতে যেসব শর্ত থাকতে হয়, তার সব কটিই পূরণ করছে। আর এই গণহত্যার বাস্তবায়ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কূটনীতিক ও সামরিক সহায়তায়।

আরও পড়ুন

গত বছর আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কাজ করেছি। পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের কাজে আন্তরিক ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি, আরও বিশ্বাস করি যে তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মানবাধিকার ইস্যুটি। কিন্তু, ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস ইসরায়েলের যে কর্মকাণ্ড ‘গণহত্যা’ বলে বিবেচিত হতে পারে বলে মন্তব্য করেছে, সেই কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সক্রিয় ভূমিকা রাখছে এবং আমি নিজেও এই সরকারের একজন প্রতিনিধি।

এই ভাবনা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। যে প্রশাসন নির্বিচার নির্যাতনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে, আমার পক্ষে সেই প্রশাসনের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। সে কারণেই আমি পদত্যাগ করেছি।

এই যুদ্ধের কারণে মানবাধিকারের পক্ষে ওকালতির নৈতিক যে দৃঢ়তা যুক্তরাষ্ট্রের ছিল, তার সবটাই নিঃশেষ হয়ে গেছে। নাগরিক সমাজের সঙ্গে আমি যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। আমার অফিস মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত সাংবাদিকদের সাহায্য চেয়েছিল।

ফেসবুকে ২৫ বছর বয়সী মার্কিন বিমানবাহিনীর সদস্য অ্যারন বুশনেলের শেষ পোস্টটি আমাকে আন্দোলিত করে। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা অনেকেই নিজেদের জিজ্ঞাসা করি, যদি দাসপ্রথার যুগে আমাদের জন্ম হতো, তাহলে আমরা কী করতাম? অথবা দক্ষিণের জিম ক্রো? কিংবা অ্যাপারথেইড? আমার দেশ যদি গণহত্যায় লিপ্ত হতো, আমরা কী করতাম? উত্তরটা হলো, তোমরা তা–ই করছ। এখনই তা–ই করছ।’

কিন্তু যখন বেসরকারি সংস্থাগুলো জানতে চাইল যে গাজায় গ্রেপ্তার হওয়া বা মৃত ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের যুক্তরাষ্ট্র কোনো সহযোগিতা করতে পারবে কি না, আমি খুবই হতাশ হয়ে দেখলাম যে আমার সরকার তাদের সুরক্ষা দিতে কিছুই করতে ইচ্ছুক নয়।

কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের (সিপিজে) হিসাবে গাজার এই যুদ্ধে ৯০ জন সাংবাদিক নিহত হন। ১৯৯২ সাল থেকে সিপিজে সংঘাতকালীন প্রাণহানির হিসাব রাখছে। তারা বলছে, এত প্রাণহানি এর আগে কখনো ঘটেনি।

এভাবে পদত্যাগ করায় আমি খুব সম্ভবত ভবিষ্যতে আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজের সুযোগ পাব না।

আরও পড়ুন

সত্যি বলতে, এটা জানতে পেরে আমি একটু দুঃখও পেলাম। শুরুতে আমি প্রকাশ্যে পদত্যাগ করার কথা ভাবিনি। কারণ, পররাষ্ট্র দপ্তরে আমার কাজ ছিল স্বল্পমেয়াদি। আমাকে নেওয়া হয়েছিল দুই বছরের চুক্তিতে।

আমি ভাবিনি, প্রকাশ্যে পদত্যাগের ঘোষণা দিল ভীষণ একটা নাড়া পড়ে যাবে। কিন্তু, যখন আমি আমার সহকর্মীদের কাছে পদত্যাগের পরিকল্পনার কথা বলতে শুরু করলাম, তাঁরা আমাকে বললেন, ‘দয়া করে আমাদের হয়ে আপনি কথা বলুন।’

সরকারের ভেতরে থেকেও অনেকেই গত কয়েক মাস নীতিগত পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করেছেন। যখন ব্যর্থ হয়েছেন, তখন কথা বলেছেন প্রকাশ্যে। আমি ও আমার সহকর্মীরা একদিকে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি, অন্যদিকে আমাদেরই সরকার দিনের পর দিন হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র, বোমা, ক্ষুদ্রাস্ত্র ও অন্যান্য প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলকে সাহায্য করেছে।

এমনকি এ কাজে তারা কংগ্রেসকেও পাশ কাটিয়ে গেছে। মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন বা মানবিক সহায়তা বিতরণে বাধা দানকারী কোনো রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আইনত নিষিদ্ধ। অথচ যুক্তরাষ্ট্র সেই আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। আমি প্রশাসনের এই ভূমিকায় আতঙ্কিত বোধ করি।

আরও পড়ুন

বাইডেন প্রশাসনের নিজস্ব নীতি অনুযায়ী, ‘অস্ত্র হস্তান্তর বৈধ হবে তখনই, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রহীতা দেশ—দুটিই যেকোনো ক্ষতি থেকে বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেবে। বেসামরিক জনগণের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করেই যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ থেকে নিজেদের স্বকীয়তা প্রমাণ করবে।’

কিন্তু যে রাষ্ট্রপতি এই মহৎ নীতি প্রণয়ন করলেন, তিনিই সরাসরি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেই পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন যে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিচ্ছে না। কংগ্রেসে কয়েকজন ডেমোক্র্যাট নেতার চাপে পড়ে প্রশাসন নতুন করে নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। এই নীতিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে বৈদেশিক সামরিক সহায়তা হস্তান্তরে যেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন না হয়, তা নিশ্চিত করা হবে।

তারপরও অতি সম্প্রতি পররাষ্ট্র দপ্তর নিশ্চিত করেছে যে তারা ইসরায়েল যুদ্ধ ও মানবিক সহায়তা বণ্টনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করছে না। এমন এক সময় পররাষ্ট্র দপ্তর এই দাবি করল, যখন পর্যাপ্ত মানবিক সহায়তা গাজায় ঢুকছে না এবং যুক্তরাষ্ট্রকে অভুক্ত গাজাবাসীর জন্য আকাশ থেকে খাদ্যসহায়তা ফেলতে হচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের এই আচরণ তামাশা ছাড়া কিছু নয়। তারা আইনও মানছে না, নির্দোষ ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যের কথাও ভাবছে না।

অনেকেই এই যুক্তি দেখাচ্ছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রভাব ইসরায়েলের ওপর নেই। তবে সাবেক ইসরায়েলি মেজর ইৎজহাক ব্রিক গত নভেম্বরে বলেন, ‘ইসরায়েলের মিসাইল, বোমা ও যুদ্ধবিমান সবই আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যে মুহূর্তে এই সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে, সেই মুহূর্তে যুদ্ধও বন্ধ হয়ে যাবে। সবাই জানে যে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া আমরা যুদ্ধ করতে পারব না। ব্যস।’

এখন ইসরায়েল লেবাননে অভিযান চালানোর কথা ভাবছে। এই আশঙ্কা আঞ্চলিক সংঘাত তৈরি করতে পারে, যার ফলাফল হবে ভয়াবহ। যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাত চায় না। কিন্তু তাই বলে গাজা বা অন্যত্র ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণের জন্য অস্ত্রসরবরাহ বন্ধেরও কোনো উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্র নেয়নি। ইসরায়েলের অতি ডানপন্থী সরকারকে সমর্থন দিয়ে বাইডেন এই অঞ্চলকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছেন, যার দরুন মার্কিন সেনারাও ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।

এসব কারণে আমার সহকর্মীদের অনেকেই প্রতারিত বোধ করছেন। আমি আমার কথা লিখছি, কিন্তু আমি আসলে আরও অনেকের প্রতিনিধিত্ব করছি। এর মধ্যে রয়েছে ফেডস ইউনাইটেড ফর পিস। এটি সরকারি কর্মকর্তাদের একটি মঞ্চ, যে মঞ্চ থেকে সারা দেশের ত্রিশটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিভাগের কর্মকর্তারা তাঁদের সক্ষমতা অনুযায়ী যুদ্ধবিরতির পক্ষে সবাইকে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প পররাষ্ট্র দপ্তরকে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিলেন। তাই বাইডেন যখন আবারও এই দপ্তরকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন, তখন সবাই তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তাঁদের অনেকের কাছেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান, তাকে আমেরিকার নৈতিক নেতৃত্বের প্রকাশ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু সেই একই প্রশাসন ইসরায়েলের অবৈধ দখল ও গাজার ধ্বংসযজ্ঞকে সমর্থন করেছে।

ফেসবুকে ২৫ বছর বয়সী মার্কিন বিমানবাহিনীর সদস্য অ্যারন বুশনেলের শেষ পোস্টটি আমাকে আন্দোলিত করে। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা অনেকেই নিজেদের জিজ্ঞাসা করি, যদি দাসপ্রথার যুগে আমাদের জন্ম হতো, তাহলে আমরা কী করতাম? অথবা দক্ষিণের জিম ক্রো? কিংবা অ্যাপারথেইড? আমার দেশ যদি গণহত্যায় লিপ্ত হতো, আমরা কী করতাম? উত্তরটা হলো, তোমরা তা–ই করছ। এখনই তা–ই করছ।’

আমি আসলে আর পেরে উঠছিলাম না। আমি আশা করি, আমার এই পদত্যাগ ইসরায়েলের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রত্যাহারে ভূমিকা রাখবে। আমার এই পদত্যাগ মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা বিশ লাখ ফিলিস্তিনির জন্য, বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানের স্বার্থে।

  • অ্যানেল শেলিন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অফিস অব নিয়ার ইস্টার্ন অ্যাফেয়ার্সের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক সাবেক কর্মকর্তা। গাজা যুদ্ধে গণহত্যা বন্ধে মার্কিন সরকারের উদ্যোগহীনতার প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন

    সিএনএনে প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত।